প্রযুক্তি ডেস্ক: মহাকাশ ভ্রমণের বিষয়টি সবসময়ই ব্যয়বহুল। কারণ প্রচলিত বিভিন্ন রকেটকে একবারই ব্যবহার করা যায়। ফলে প্রতিটি ফ্লাইটের পরে মহাকাশযানকে ফেলে দেওয়ার বিষয়টি মহাকাশ ভ্রমণকে করে তুলেছে অসম্ভব ব্যয়বহুল।
এমনই ছিল কয়েক দশক ধরে চলা মহাকাশ গবেষণার বাস্তবতা, যেখানে মহাকাশে পেলোড চালু করার পরে ফেলে দেওয়া হত বিভিন্ন রকেটকে। তবে, এতে পরিবর্তন এনেছে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেট প্রযুক্তির অগ্রগতি, যা মহাকাশ ভ্রমণকে আরও সাশ্রয়ী, সক্ষম ও টেকসই করে তুলছে। একইসঙ্গে এসব রকেট মহাকাশ গবেষণা ও উদ্ভাবনের নতুন যুগের পথও প্রশস্ত করছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
রকেটের পুনরায় ব্যবহারের ধারণাটি নতুন নয়। তবে প্রকৌশল ও প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে বর্তমানে বাস্তবে পরিণত হয়েছে এটি। কয়েকটি বড় সাফল্যের মধ্যে অন্যতম সাফল্যটি এসেছে ইলন মাস্ক প্রতিষ্ঠিত মহাকাশ গবেষণা কোম্পানি স্পেসএক্স-এর হাত ধরে।
২০১৫ সালে স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন ৯’ রকেট পৃথিবীর কক্ষপথে একটি স্যাটেলাইট পৌঁছে দেওয়ার পর তা সফলভাবে ভূমিতে ফিরে এসেছিল, যা প্রথমবারের মতো একটি রকেটকে একাধিক মিশনের জন্য পুনরায় ব্যবহারের বিষয়কে সম্ভব করে তোলে।
এই মাইলফলকটি মহাকাশ উৎক্ষেপণের ব্যয়কে নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনার সম্ভাবনা দেখিয়েছিল। স্পেসএক্স বলেছে, নতুন রকেট তৈরির তুলনায় একটি রকেটকে পুনরায় ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাঁচানো যেতে পারে।
পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন রকেটকে ডিজাইন করা হয়েছে মহাকাশে উৎক্ষেপণ এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশের সময় তীব্র তাপ ও চাপ সহ্য করার মতো করেই। মহাকাশে এদের পেলোড সরবরাহের পর পৃথিবীতে ফিরে আসতে অবতরণ প্যাড বা সমুদ্রে ভাসমান একটি প্ল্যাটফর্মে অবতরণ করে এসব রকেট।
রকেটের সুনির্দিষ্ট অবতরণ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে উন্নত ন্যাভিগেশন সিস্টেম ও এআই। বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’তে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, এআইয়ের বিভিন্ন অ্যালগরিদম কীভাবে এসব রকেটকে অবতরণের সময় এদের গতিপথ সামঞ্জস্য করতে সাহায্য করে। এমনকি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতেও রকেটের নিরাপদ ও নির্ভুল অবতরণকে সম্ভব করে তুলেছে এটি।
অন্যান্য কোম্পানিও পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন রকেট তৈরির প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে। যেমন– মার্কিন ই-কমার্স কোম্পানি অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের কোম্পানি ‘ব্লু অরিজিন’ তাদের ‘নিউ শেপার্ড’ রকেটের মহাকাশে সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। রকেটটিকে তারা ডিজাইন করেছে সাবঅরবিটাল ফ্লাইটের জন্য।
‘ফ্যালকন ৯’ রকেটের বিপরীতে ‘নিউ শেপার্ড’ রকেটটির নকশায় মনোযোগ ছিল মহাকাশ পর্যটনে। ‘নিউ শেপার্ড’-এর লক্ষ্য অল্প সময়ের জন্য যাত্রীদের মহাকাশের অভিজ্ঞতা দিয়ে আবার ফিরিয়ে আনা। ২০২১ সালে যাত্রীদের নিয়ে একটি মিশনও করেছে ‘ব্লু অরিজিন’। যাতে দেখা গেছে, অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের জন্য মহাকাশ ভ্রমণকে কীভাবে সাশ্রয়ী করে তুলতে পারে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেট।
খরচ কমিয়ে আনার বাইরেও রয়েছে এসব রকেটের নানাবিধ সুবিধা। দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে এরা। প্রচলিত বিভিন্ন রকেট প্রায়শই সমুদ্র বা মহাকাশে আবর্জনা ফেলে আসে, যা তৈরি করে পরিবেশ ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ। তাই রকেটের পুনরায় ব্যবহারের পদ্ধতিটি প্রযুক্তিকে বিশ্বজুড়ে আরও পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ ছাড়া, মহাকাশ গবেষণার গতিও বাড়িয়ে দিতে পারে এসব রকেট। ফলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট নিয়ে যাওয়া, এমনকি অন্যান্য গ্রহে বসতি স্থাপনের সম্ভাবনার জন্য নতুন পথ খুলে দিতে পারে এরা।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ‘আর্টেমিস প্রোগ্রাম’-এর লক্ষ্য হচ্ছে চাঁদে মানুষ পাঠানো। আর এসব মিশনকে আরও টেকসই ও ব্যয়বহুল করতে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেট প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করছে নাসা।
তবে এসব রকেটের মহাকাশে ভ্রমণের বিষয়টি এখনও চ্যালেঞ্জিং রয়ে গেছে। পুনরায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসব রকেটকে ফের নানারকম পরীক্ষা আর সারাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
এসব বাধার পরেও রকেটের পুনরায় ব্যবহারের প্রক্রিয়াটিকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তুলছে এর ক্রমাগত উদ্ভাবন। যেমন– স্পেসএক্স তার কিছু ফ্যালকন ৯ রকেটকে দশবারেরও বেশি পুনরায় ব্যবহার করেছে কোম্পানিটি, যা তাদের প্রযুক্তি, দক্ষতা আর নির্ভরযোগ্যতারই প্রতিফলন।