ঢাকা ০৭:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫

রংপুরে গাছের পাতা থেকে হচ্ছে তেল, প্রতি লিটারের দাম ৫০ হাজার!

  • আপডেট সময় : ০৪:১৭:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৫
  • ২৮ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

রংপুর সংবাদদাতা: গাছের পাতা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে এমন এক তেল, যার প্রতি লিটারের দাম ৫০ হাজার টাকা। তেল উৎপাদনের সময় পাতা থেকে যে পানি বের হয়, সেটিও বিক্রি হয় প্রতি লিটার অন্তত হাজার টাকায়। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটিই বাস্তব।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নের শ্রীকান্ত গ্রামে এমনই এক মূল্যবান গাছের চাষ শুরু করেছেন প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ।

দেখতে ঝাউ গাছের মতো হলেও এটি আসলে অস্ট্রেলিয়ার দুর্লভ টি-ট্রি গাছ। এই গাছের পাতা থেকেই তৈরি হয় বিশ্ববিখ্যাত টি-ট্রি অয়েল, যা ত্বকের নানা রোগ প্রতিরোধে ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে ব্যবহৃত হয়।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হরিশচর গ্রামের তরুণ প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ চাকরি করতেন তাইওয়ানের একটি বহুজাতিক কম্পানিতে। সেখানেই তিনি জানতে পারেন টি-ট্রি গাছের তেলের বাজারমূল্য ও চিকিৎসাগত গুরুত্ব।

তখনই মনে জাগে ভাবনা-নিজ দেশে এই গাছ চাষ করবেন। দেশে ফিরে ২০২০ সালে পীরগাছার শ্রীকান্ত গ্রামে এক একর জমি লিজ নেন আরিফ। শুরু করেন পরীক্ষামূলক চাষ। তবে শুরুটা সহজ ছিল না।

বিদেশ থেকে চারা আনতে নানা জটিলতার মুখে পড়তে হয় তাকে। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে অল্প কিছু বীজ সংগ্রহ করেন। বীজ থেকে চারা তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধা এলেও পাশে ছিলেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট। অবশেষে ৪০টি চারা উৎপাদনে সফল হন তিনি।

সেই চারাগুলো থেকেই কাটিং পদ্ধতিতে বর্তমানে তার এক একরের প্রকল্পে রয়েছে দুই হাজারের বেশি টি-ট্রি গাছ। এরপর ধীরে ধীরে নিজস্ব ডিস্টিলারি স্থাপন করে আধুনিক পদ্ধতিতে পাতার তেল উত্তোলন শুরু করেন আরিফ। সেই তেল দেশের বিভিন্ন প্রসাধনী ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন তিনি। পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছেন। টি-ট্রি পাতার তেল থেকে পাওয়া হাইড্রোসল ওয়াটারও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাছের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক ডিস্টিলেশন ইউনিট। প্রতিদিন সকালে শ্রমিকরা গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে মেশিনে দেন। এরপর স্টিম ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ধরে গরম করা হয়। তাপের প্রভাবে পাতা থেকে ধীরে ধীরে বের হয় তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার।

প্রতি ব্যাচে ৫০ কেজি পাতা প্রক্রিয়াজাত করে দিনে তিন ব্যাচে প্রায় দেড় লিটার তেল উৎপাদন হয়। চীন থেকে ছোট একটি মেশিন এনে সেটি বিশ্লেষণ করে স্থানীয়ভাবে ৫০০ লিটার ধারণক্ষমতার যন্ত্র তৈরি করেছেন আরিফ নিজেই। এখন সেই মেশিন দিয়েই নিয়মিত তেল ও হাইড্রোসল উৎপাদন করছেন।

গত তিন বছরে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৫০ লিটার টি-ট্রি অয়েল এবং ৫ হাজার লিটার হাইড্রোসল ওয়াটার। এ বছর উৎপাদন দ্বিগুণ হবে বলে আশা এই উদ্যোক্তার।

শুরুতে গ্রামবাসীর অনেকেই আরিফের প্রকল্পকে হাস্যকর ভাবতেন। অনেকে বলেছিলেন, গাছের পাতা থেকে আবার তেল হয় নাকি! কিন্তু সময়ই বদলে দিয়েছে সেই ধারণা। গাছ বড় হওয়ার পর যখন পাতা থেকে তেল বের হতে শুরু করল, সবাই অবাক হয়ে দেখল সম্ভাবনার এক নতুন দিক।

আরিফ বলেন, শুরুতে কেউ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আমি জানতাম এটা সম্ভব। এখন আমার উৎপাদিত তেল দেশ-বিদেশে যাচ্ছে। এটা শুধু আমার স্বপ্ন নয়, বাংলাদেশেরও সম্ভাবনা।

টি-ট্রি তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার বিশ্বব্যাপী স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে ব্যবহৃত হয়। ত্বক সতেজ রাখা, খুশকি দূর করা, ব্রণ ও ফাংগাস প্রতিরোধে এর জুড়ি নেই।

আরিফ আরও বলেন, ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে শুরু করা এই প্রজেক্ট এখন রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করছে। সরকার যদি রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করে, তবে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থান-দুটোই বাড়বে।

চলতি বছর তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্য নিয়েছেন। বর্তমানে তার বাগানে কাজ করছেন ১৫ জন শ্রমিক। আগামীতে বৃহৎ পরিসরে চাষ করে আরও কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা করছেন এই উদ্যোক্তা।

পীরগাছার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, টি-ট্রি গাছের চাষ এই এলাকার জন্য একেবারে নতুন হলেও ফলন ভালো হচ্ছে।

পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আসাদুজ্জামান আরিফের উদ্যোগ কৃষি উদ্ভাবনের দারুণ উদাহরণ। কৃষি বিভাগ শুরু থেকেই তাকে সহায়তা করেছে এবং ভবিষ্যতেও এমন উদ্যোক্তাদের পাশে থাকবে। এ ছাড়া এ গাছের চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিবে কৃষি বিভাগ।

ওআ/আপ্র/০৯/১১/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

রংপুরে গাছের পাতা থেকে হচ্ছে তেল, প্রতি লিটারের দাম ৫০ হাজার!

আপডেট সময় : ০৪:১৭:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৫

রংপুর সংবাদদাতা: গাছের পাতা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে এমন এক তেল, যার প্রতি লিটারের দাম ৫০ হাজার টাকা। তেল উৎপাদনের সময় পাতা থেকে যে পানি বের হয়, সেটিও বিক্রি হয় প্রতি লিটার অন্তত হাজার টাকায়। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটিই বাস্তব।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নের শ্রীকান্ত গ্রামে এমনই এক মূল্যবান গাছের চাষ শুরু করেছেন প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ।

দেখতে ঝাউ গাছের মতো হলেও এটি আসলে অস্ট্রেলিয়ার দুর্লভ টি-ট্রি গাছ। এই গাছের পাতা থেকেই তৈরি হয় বিশ্ববিখ্যাত টি-ট্রি অয়েল, যা ত্বকের নানা রোগ প্রতিরোধে ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে ব্যবহৃত হয়।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হরিশচর গ্রামের তরুণ প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ চাকরি করতেন তাইওয়ানের একটি বহুজাতিক কম্পানিতে। সেখানেই তিনি জানতে পারেন টি-ট্রি গাছের তেলের বাজারমূল্য ও চিকিৎসাগত গুরুত্ব।

তখনই মনে জাগে ভাবনা-নিজ দেশে এই গাছ চাষ করবেন। দেশে ফিরে ২০২০ সালে পীরগাছার শ্রীকান্ত গ্রামে এক একর জমি লিজ নেন আরিফ। শুরু করেন পরীক্ষামূলক চাষ। তবে শুরুটা সহজ ছিল না।

বিদেশ থেকে চারা আনতে নানা জটিলতার মুখে পড়তে হয় তাকে। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে অল্প কিছু বীজ সংগ্রহ করেন। বীজ থেকে চারা তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধা এলেও পাশে ছিলেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট। অবশেষে ৪০টি চারা উৎপাদনে সফল হন তিনি।

সেই চারাগুলো থেকেই কাটিং পদ্ধতিতে বর্তমানে তার এক একরের প্রকল্পে রয়েছে দুই হাজারের বেশি টি-ট্রি গাছ। এরপর ধীরে ধীরে নিজস্ব ডিস্টিলারি স্থাপন করে আধুনিক পদ্ধতিতে পাতার তেল উত্তোলন শুরু করেন আরিফ। সেই তেল দেশের বিভিন্ন প্রসাধনী ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন তিনি। পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছেন। টি-ট্রি পাতার তেল থেকে পাওয়া হাইড্রোসল ওয়াটারও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাছের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক ডিস্টিলেশন ইউনিট। প্রতিদিন সকালে শ্রমিকরা গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে মেশিনে দেন। এরপর স্টিম ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ধরে গরম করা হয়। তাপের প্রভাবে পাতা থেকে ধীরে ধীরে বের হয় তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার।

প্রতি ব্যাচে ৫০ কেজি পাতা প্রক্রিয়াজাত করে দিনে তিন ব্যাচে প্রায় দেড় লিটার তেল উৎপাদন হয়। চীন থেকে ছোট একটি মেশিন এনে সেটি বিশ্লেষণ করে স্থানীয়ভাবে ৫০০ লিটার ধারণক্ষমতার যন্ত্র তৈরি করেছেন আরিফ নিজেই। এখন সেই মেশিন দিয়েই নিয়মিত তেল ও হাইড্রোসল উৎপাদন করছেন।

গত তিন বছরে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৫০ লিটার টি-ট্রি অয়েল এবং ৫ হাজার লিটার হাইড্রোসল ওয়াটার। এ বছর উৎপাদন দ্বিগুণ হবে বলে আশা এই উদ্যোক্তার।

শুরুতে গ্রামবাসীর অনেকেই আরিফের প্রকল্পকে হাস্যকর ভাবতেন। অনেকে বলেছিলেন, গাছের পাতা থেকে আবার তেল হয় নাকি! কিন্তু সময়ই বদলে দিয়েছে সেই ধারণা। গাছ বড় হওয়ার পর যখন পাতা থেকে তেল বের হতে শুরু করল, সবাই অবাক হয়ে দেখল সম্ভাবনার এক নতুন দিক।

আরিফ বলেন, শুরুতে কেউ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আমি জানতাম এটা সম্ভব। এখন আমার উৎপাদিত তেল দেশ-বিদেশে যাচ্ছে। এটা শুধু আমার স্বপ্ন নয়, বাংলাদেশেরও সম্ভাবনা।

টি-ট্রি তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার বিশ্বব্যাপী স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে ব্যবহৃত হয়। ত্বক সতেজ রাখা, খুশকি দূর করা, ব্রণ ও ফাংগাস প্রতিরোধে এর জুড়ি নেই।

আরিফ আরও বলেন, ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে শুরু করা এই প্রজেক্ট এখন রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করছে। সরকার যদি রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করে, তবে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থান-দুটোই বাড়বে।

চলতি বছর তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্য নিয়েছেন। বর্তমানে তার বাগানে কাজ করছেন ১৫ জন শ্রমিক। আগামীতে বৃহৎ পরিসরে চাষ করে আরও কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা করছেন এই উদ্যোক্তা।

পীরগাছার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, টি-ট্রি গাছের চাষ এই এলাকার জন্য একেবারে নতুন হলেও ফলন ভালো হচ্ছে।

পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আসাদুজ্জামান আরিফের উদ্যোগ কৃষি উদ্ভাবনের দারুণ উদাহরণ। কৃষি বিভাগ শুরু থেকেই তাকে সহায়তা করেছে এবং ভবিষ্যতেও এমন উদ্যোক্তাদের পাশে থাকবে। এ ছাড়া এ গাছের চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিবে কৃষি বিভাগ।

ওআ/আপ্র/০৯/১১/২০২৫