ড. আনোয়ার হোসেন : কনেপক্ষ থেকে বরকে বিয়ের সময় বা তার আগে-পরে শর্ত করে সরাসরি বা আকার ইঙ্গিতে দাবি করে, অথবা প্রথা হিসেবে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা অর্থ-সম্পদ ও টাকা-পয়সা নেয়া বা দেয়াকে যৌতুক বলে। শরিয়তের বিধানে যৌতুক সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। যৌতুক একটি নিপীড়নমূলক প্রথা। যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি; যা নারী নির্য্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্মীয় এবং আইনগত দিক থেকে অবৈধ এ কুপ্রথার শিকার হয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী নিগৃহীত হচ্ছেন।
দেশে যৌতুকবিরোধী কড়া আইন থাকা সত্ত্বেও বন্ধ করা যাচ্ছে না এই ঘৃণ্য প্রথা। তবে শরিয়া, ব্যক্তিগত আইন বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো আইনে যৌতুক অনুমোদিত নয়। যৌতুকের বলি হয়ে দেশে প্রতি বছর অনেক নারী প্রাণ হারান। যৌতুক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যৌতুক গ্রহণকারী সমাজ ও পরিবারের কাছে ঘৃণিত, নারীর্য্যাতিক, শ্রম শোষক, পৌরুষের দিক থেকে দুর্বল মনের পরিচায়ক, ব্যক্তিত্বের দিক থেকে লজ্জাজনক।
সমাজে প্রচলিত হওয়ায় অনেকেই যৌতুককে নিজেদের অধিকার হিসেবে ভাবে এবং নিজেকে অপরাধী মনে করে না। কতশত নারী নীরবে নিভৃতে দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে তার হিসাব নেই। তাই যৌতুকের পরিসংখ্যান হিসাব করা কঠিন। পত্রিকা খুললেই যৌতুকের জন্য নির্য্যাতন নিয়ে প্রতিবেদন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। শুধু যে অশিক্ষিতদের মধ্যে যৌতুক আদান-প্রদান হয় তা নয়। শিক্ষিত ব্যক্তিরাও এই জঘন্য কাজ করে আসছেন। যৌতুক হইলো অসম্মানের বিষয়। যৌতুক ভিক্ষা করার চেয়েও অসম্মানজনক। যে ছেলে যৌতুক চায়, সে কনের বাড়িতে আসে ডাকাত হয়ে আর যায় চোর হয়ে। অর্থাৎ অন্যায় ভাবে মাথা উচু করে আসে, নিয়ম বইিভূতভাবে মাথা উঁচু করে চোর স্টাইলে চলে যায়। মাঝে মধ্যে মসজিদে দেখি, কখনোবা আমার অফিসেও আসে কিছু লোক। এসে কান্নাকাটি করে বলে মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য নিতে আসছি। যে যুবক ওই মেয়েটাকে বিয়ে করবে, সে কি জানে না কনের বাবা মা ভিক্ষা করে তাকে যৌতুক নামের ভিক্ষা দিবে? এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা একে অন্যের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)।
যৌতুক এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। আমাদের চারপাশে বিয়ের সময় বা বিয়ের পরে যৌতুকের জন্য নারী নির্য্যাতনের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় এ ঘটনা মৃত্যু পর্য্যন্ত গড়ায়। যৌতুকের জন্য সাংসারিক জীবনে নেমে আসে অশান্তি। অনেক সময় সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম বা ভেঙেও যাচ্ছে। এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গ্রাম থেকে শহরে, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত -সর্বত্রই এই ব্যাধি হানা দিচ্ছে। গ্রামে এটি দৃশ্যমান ও প্রকাশ্য। সেখানে বলাই হয় যে, যৌতুক না দিলে মেয়ের বিয়ে হবে না। মেয়ের বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হয়। আবার শহরে নানান ‘ফরম্যাটে’ যৌতুক দেয়া এবং নেয়া হচ্ছে। এখানে উচ্চবিত্তরা চাকরি, গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক-নানা কায়দায় যৌতুক দিচ্ছে-নিচ্ছে।
দেশ থেকে যৌতুক প্রথা দূর করতে বাংলাদেশের সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছিল। ওই আইনে বলা হয়েছিল, যৌতুক গ্রহণকারী ও যৌতুক প্রদানকারী উভয়ই সমান অপরাধী। তারা উভয়েই সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বিয়ে কোনো সওদা বা বাণিজ্য নয়, আর্থিক লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়। এটি একটি পবিত্র বন্ধন। এ দ্বারা এক জোড়া মানব-মানবীর পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্য স্থাপিত হয়। একজন আরেকজনের জন্য হালাল হয়। এটি কোনো আর্থিক বা বৈষয়িক জিনিস নয়, বেহেশতি নেয়ামত। এই বন্ধন প্রথম অনুষ্ঠিত হয় বেহেশতে প্রথম মানব-মানবী হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর মধ্যে। আর এ বন্ধন ঘটিয়েছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মৌলিক নির্দেশনার আলোকে যৌতুক নিষিদ্ধ বিষয় বলে বিভিন্ন কারণে মূল্যায়িত হয়। ইসলাম নারীকে আর্থিক সামর্থ্য দানের লক্ষ্যে এবং তার সম্ভ্রমকে সম্মান জানানোর জন্য ‘মাহর’ নির্ধারিত করে দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, নারীদের তাদের মোহরানা সন্তুষ্টচিত্তে দিয়ে দাও। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রী মোহরানা নির্ধারণ করল পরিমাণে যাই হোক; কিন্তু মনে মনে তা পরিশোধের ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে কিয়ামতের দিন ব্যভিচারী হিসেবে উঠবে।’
বতর্মান সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলামের অন্য সব বিধান, নিয়ম অনুসরণ করা হলেও দেনমোহর নির্ধারণ করা হয় নামেমাত্র। অনেকটা যেন নিয়ম রক্ষার বিষয়। আদায় করার সদিচ্ছা থাকে না অনেকের মাঝেই। অথচ দেনমোহর বিয়ে বৈধ করার মাধ্যমও বটে। বিয়েতে দেনমোহর প্রদান প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন; এমনকি কারো মাঝে মোহরানা প্রদানের ইচ্ছা না থাকলে তার প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এমন ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে কম বা বেশি দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে করল; অথচ তার অন্তরে দেনমোহরের সে হক আদায়ের আদৌ কোনো ইচ্ছাই নেই, সে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে ব্যভিচারী হিসেবে উপস্থিত হবে। ইসলামের পক্ষ থেকে দেওয়া নারীর স্পষ্ট অধিকার দেনমোহর আদায়ের প্রবণতা না থাকলেও যৌতুক নেওয়ার তোড়জোর রয়েছে সমাজে অনেকের মাঝে। কিন্তু যৌতুক একটি নিপীড়নমূলক প্রথা। পবিত্র কোরআনের (সুরা নিসা) বর্ণিত হয়েছে, ‘নারীদের খুশিমনে তাদের মোহর প্রদান করো বিয়ের ক্ষেত্রে দেনমোহরের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেনমোহর কনে ও তার পিতা-মাতার জন্য সম্মানের বিষয়।’
বাংলাদেশে অভিনব পদ্ধতিতে যৌতুক নেওয়ার কিছু অপকৌশল বিষয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। যেমনপাত্রপক্ষ বলে আমরা কিছুই চাই না, কেবল আপনাদের মেয়েটা কে সাজিয়ে দিলে হবে।যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে পাত্রীকে সাজানোর সকল দায়িত্ব এবং সকল খরচ পাত্র এর উপর বর্তায়।কেবলমাত্র অজ্ঞতার কারণে এখনো বাংলাদেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং গরিব মেয়েদের যৌতুকের ফাঁদে পড়ে জীবন নরকে পরিণত হয়ে উঠছে। যৌতুক নিয়ে আসতে পারে নাই বলে গৃহবধূর ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছু নাই। কিছু বললেই শাশুড়ি বলে সবার বউ আসছে কত কিছু নিয়ে, আর আমার ছেলের বউ মুখ ছড়া কিছু নিয়ে আসেনি। অর্থাৎ কথা বলাটাই যেন অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুকের এমন ভার্সন আছে যা শুনলে আমি আঁতকে উঠি। যেমন ধরুন, দেবর বিদেশ যাবে। এ অবস্থায় টাকা নেওয়ার কেবল একটা জায়গা আছে, ওই গরিব নববধূর মা-বাবা। অপারগত প্রকাশ করলে বলে ওই যে ক্ষুদ্র ঋণ আছে না? ননদের বিয়ে হলেও একই অবস্থা। স্বামী অর্থনৈতিকভাবে কোন বিপদে পড়লে, অপারগতা প্রকাশ করলে বলে আমি তো এমনি চাই নাই, কর্জ হিসেবে চাচ্ছি। মনে হয় পৃথিবীতে কর্জ নেওয়ার ওই একটা জায়গা আছে। এবার নববধূর মা লজ্জায় পাশের বাড়ির প্রতিবেশীদের হাত-পা ধরে, পারে না যে কুকুর-বিড়ালেরও পা ধরে মেয়ের সুখের দিকে তাকিয়ে। এবার বাধ্য হয়ে টাকা কর্জ করে নেয়। দিন য়ার বছর যায়, ঋণ শোধ করার সময় হয় না। এক পর্য্যায়ে কজের্র টাকা ফেরত চাইতেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। বলে কত বড় ছোটলোক, এই কয়টা টাকা আবার মেয়ের জামাই থেকে চাচ্ছে।
আমাদের পাশের বাড়ির এক পরিবার রয়েছেন, যারা দারিদ্র নিমম্ন বসবাস করছেন। পরিবারের কর্তা অর্থাৎ সন্তানদের বাবা দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পূর্বে পরলোক গমন করেন। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ওই পরিবারের বড় মেয়ের বিয়ে হয়। বেশ উচ্চবিত্ত পরিবার এ বিয়ে হয়েছে শুনে খুবই পুলকিত হলাম। মেয়েটির আরো দুই ভাই এবং এক ছোট বোন রয়েছে। গত বছর ঈদুল আজহার সময় শুনতে পেলাম মেয়েটার শাশুড়ি বলল গরু কিনে না দিতে পারলেও কমসে কম বড় একটি খাসি কিনে দিতে। না হয় সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না। মেয়েটার হতভাগিনী মা বাধ্য হয়ে কর্জ করে কোনোমতে একটা খাসি কিনে পাঠালেন। তাও বিপত্তি, এত ছোট খাসি কেন? এটা দেখতে চোখে লাগছে না। এরকম দেওয়ার চেয়ে না দেওয়া ভালো। আরো কত খিস্তি খেউর কথা মেয়েটিকে শুনতে হলো। ঈদেরদিন পরিবারটি আলু ভর্তা,শুটকি ভর্তা ও কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে দিনাতিপাত করছে।
বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা এখনো বলবৎ থাকার কারণ হচ্ছে কিছু উচ্চবিত্ত। যারা মেয়ের জন্য খাট, পালং, স্বর্ণালঙ্কার, এয়ার কন্ডিশন এমনকি ঝাঁটা পর্য্যন্ত প্রস্তুত করে রাখেন। শুধু প্রস্তুত করে ক্ষান্ত হন না, পাড়া পড়শি কে ডেকে নিয়ে এসে দেখান। এতেই আমাদের নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র মেয়েদের উপর চাপ সৃষ্টি হয়।
যৌতুক থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে নারীর ক্ষমতায়ন অতীব জরুরী। প্রাথমিক হতে মাস্টার্স পর্যন্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব মেয়েদের অবৈতনিক পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মজীবী নারীকে কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। কর্মজীবী নারী ঊমির্র বিরুদ্ধে কয়েকটি বাক্য ফেসবুকে পোস্ট করার দায়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কিকি,একেবারে উদাহরণ ও ব্যাখ্যাসহ জাতিকে বুঝিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে একটা মহল যেন মরিয়া হয়ে উঠছে। যা নারীর ক্ষমতায়নের অন্তরায়। আশা করি বাংলাদেশ সরকার এই অন্তরায় শীঘ্রই দূরীভূত করবেন।
যৌতুকের বিরুদ্ধে আইনের সহায়তা নেয়ার পাশাপাশি যৌতুকবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজের মধ্যে যৌতুকের বিভিন্ন কুফল তুলে ধরতে হবে। যৌতুক প্রদান এবং গ্রহণকারী উভয়কে সমাজের চোখে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সামাজিকভাবে শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। মুসলিম সমাজের আলেমদের সরকারি আইনের পাশাপাশি মুসলিম আইন সম্পর্কে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকারিভাবে যৌতুক ও নারী নির্য্যাতন আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। লেখক: প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল