শাহানা হুদা রঞ্জনা
দেশের আইন যেখানে বলেছে যৌতুক চাইলেই অপরাধ, সেখানে যৌতুকের জন্য ‘হালকা’ বা ‘ভারী’ জখম দুটোই অপরাধ। অপরাধের জন্য শাস্তিই প্রাপ্য, সালিশ বা আলোচনার মাধ্যমে মধ্যস্থতা নয়। এরপরও বাদী যদি বিবাদীর সাথে আলোচনার মাধ্যম ‘হালকা জখম’র জন্য সমঝোতা করতে চান, করবেন। কিন্তু রাষ্ট্র আইন করে মধ্যস্থতায় বাধ্য করতে পারে না। জখম হালকা হলেও এটা নির্যাতন। এ ধরনের অপরাধে ভুক্তভোগী নারীকে মধ্যস্থতার দিকে ঠেলে দেওয়া হলে, ‘হালকা জখম’ টাইপের নির্যাতন বেড়ে যেতে পারে।
এই দেশে এমন অনেক নারী আছেন যাদের কাছে ‘হালকা জখম’ও বড় জখম হয়ে দাঁড়ায়। তাদের মান-সম্মান বিঘ্নিত হয়, তারা আর কোনোভাবেই স্বামীর সংসারে থাকতে চান না এবং স্বামী বা স্বামীর পরিবারের শাস্তি চান, সেখানে ভুক্তভোগী নারীকে এখন থেকে মামলার আগে মধ্যস্থতায় যেতে হবে কেন?
আইন সংশোধন করে রাষ্ট্র তাকে বাধ্য করছে মামলা না করতে। কিন্তু কেন বাধ্য করছে বা করবে? সায়কা আহমেদ একজন চাকরিজীবী, তাও তাকে প্রায়ই যৌতুকের কারণে আজেবাজে কথা শুনতে হতো। এসব নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে স্বামী তাকে চড় মারে। সায়কা পরদিনই স্বামীর নামে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। মামলায় স্বামীর শাস্তিও হয়েছিল। বিয়েটা আর টেকেনি, তাতে সায়কার দুঃখও হয়নি। কারণ প্রতিদিন এই মানসিক নিপীড়ন তাকে কোণঠাসা করে ফেলছিল। সায়কার মতো অনেক নারীই আছেন, যারা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চান।
যৌতুকের কারণে ‘সাধারণ জখম’র শিকার নারীদের এখন থেকে মামলার আগে মধ্যস্থতায় যেতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’ সংশোধন করে মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করে ১ জুলাই অধ্যাদেশ জারি করেছে। অপরাধের পক্ষে অদ্ভুত সংশোধনী নিয়ে এলো সরকার। প্রশ্নটা হচ্ছে অসংখ্য সমস্যা নিয়ে খাবি খাওয়ার মাঝখানে অন্তর্বর্তী সরকার হঠাৎ কেন এই ইস্যু নিয়ে তড়িঘড়ি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল? নারীর বিচার চাওয়ার অধিকার সীমিত করার এই পরিকল্পনা কেন করা হলো? এর আগে কি সরকার কারো সাথে এ বিষয়ে মতবিনিময় করেছে?
যৌতুকের জন্য জখম করা হলে, সেটা অপরাধ বলেই গণ্য হবে। সেখানে ‘সাধারণ জখম’ বিষয়টা যদি সালিশের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে যৌতুকের আইনি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। কারণ এই অধ্যাদেশ অনুসারে, প্রথমে ভুক্তভোগী নারীকে লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করতে হবে। যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ (ধারা ৩) শুধু যৌতুক দেওয়া-নেওয়া নয়, যৌতুক দাবি করাও একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শাস্তি সর্বনিম্ন এক বছর থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (ধারা ১১) অনুসারে যৌতুকের দাবি যদি শারীরিক নির্যাতনে গড়ায়, তাহলে তা আরও গুরুতর অপরাধ। এই ধরনের অপরাধের বিচারের জন্য রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩ ) এ। এই আইনের ১১ নম্বর ধারায় যৌতুকের জন্য নির্যাতনের বিভিন্ন শাস্তির কথা বলা আছে। যৌতুকের জন্য গায়ে হাত তোলা বা যে কোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতন মারাত্মক অপরাধ এবং এর জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। যৌতুকের জন্য মারধর, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা সবই অপরাধ এই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (ধারা ১১) অনুযায়ী। কারণ এখানে দাবির পাশাপাশি ‘নির্যাতন’ বা ‘জখম’ ঘটানো হয়েছে। (সাধারণ মারধরের জন্য ধারা ১১(গ), প্রযোজ্য)।
মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে কোনো পক্ষ প্রয়োজনে আদালতে মামলা করতে পারবে। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে এই নিষ্পত্তির জন্য আবেদন, আবেদন আমলে নেওয়া, সালিশ ইত্যাদি করতে গিয়ে সময় ক্ষেপণ হবে। যত বেশি সময় পার হবে, ততই ভিকটিমের ‘সাধারণ জখম’র অভিযোগ দুর্বল হয়ে পড়বে। জখমের চিহ্নও মুছে যেতে পারে। আর ভুক্তভোগীর ‘মানসিক জখম’ এর কী হবে? অনেক পরিবারে যৌতুক দিতে না পারার দায়ে নারীর গায়ে হাত তোলে না ঠিকই, কিন্তু মুখে গালিগালাজ ও খোটা দিতে ছাড়ে না। সবসময় বউকে তোপের মুখে রাখে, খেতে-পরতে দেয় না ঠিকমতো এবং অষ্টপ্রহর মানসিক চাপে রাখে। এসব নির্যাতনের বিচার কী হবে? এক্ষেত্রে মধ্যস্থতার কোনো পথ খোলা থাকে না। ভুক্তভোগী মেনে নিলে, মেনে নেবে, অন্যথায় মামলা করতে পারে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১১ ধারাটি যৌতুক-সংক্রান্ত। ১১ (গ) ধারায় উল্লেখ আছে- যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য নারীকে সাধারণ জখম (সিম্পল হার্ট) করে, তবে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর, অন্যূন দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এবার এই ধারা সংশোধন করে বলা হচ্ছে যৌতুকের কারণে ‘সাধারণ জখম’র শিকার নারীদের এখন থেকে মামলার আগে মধ্যস্থতায় যেতে হবে।
আইন উপদেষ্টা মনে করেন, শুরুতেই লিগ্যাল এইড অফিসে গেলে বিনা খরচে নারীরা কম সময়ের মধ্যে মধ্যস্থতার মাধ্যমে আপস করার সুযোগ পাবেন। আপস ব্যর্থ হলে ভুক্তভোগী নারীর মামলার অধিকার অবশ্যই বহাল থাকছে। অধ্যাদেশের ধারাটি নারীর অধিকারকে ব্যাহত করবে না, বরং সুসংহত করবে। এটিও একটি আইনি প্রক্রিয়া। এতে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ সময় ব্যয় হতে পারে। তিনি যতটা সহজে এ কথা বললেন, বিষয়টি সেরকম না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সাধারণ সালিশ প্রক্রিয়ার দুর্বলতা ও অকার্যকর হওয়া কারণেই আইনি ধারা বলবৎ করা হয়েছে। এখন অধ্যাদেশে ২১ (খ) ধারা যুক্ত করে বিচারপ্রার্থী নারীকে মধ্যস্থতার দিকে ঠেলে দেওয়ার মানে হচ্ছে তাকে নানাভাবে আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তাই ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারির পর এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত উঠে এসেছে। আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের অনেকেই মনে করছেন, এই সংশোধনী নারীর মামলা করার আইনি অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে। ভুক্তভোগীকে অপরাধীর সঙ্গে আপস করতে বাধ্য করবে।
যৌতুকের জন্য ‘সাধারণ জখম’-এর অপরাধটি উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ২০২০ সালে আপসযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। এই আপস বাদী যেভাবে চাইতো, সেভাবেই হতো। এই আপস মধ্যস্থতার জন্য নতুন বিধান আনতে হলো কেন? আইনগত সহায়তা তহবিলের অফিসের মাধ্যমে এমনিতেই মধ্যস্থতা করা যায়। এখন নতুন বিধান চালুর কারণে চাইলেও কোনো নারী বা তার পরিবার ‘সাধারণ জখম’-এর জন্য সরাসরি আইনের দ্বারস্থ হতে পারবেন না। যৌতুকের জন্য নারীর গায়ে হাত তোলার মতো অপরাধ কোনোভাবেই সালিশের আওতায় পড়তে পারে না।
আইন বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ফউজুল আজিম বলেন, ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অধ্যাদেশটিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১১ (গ) ধারার অপরাধটিকে বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার আওতায় আনা হয়েছে। যাতে নারীর ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা বাধা হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা আছে। এই ধারার ভুক্তভোগীকে ৩২ ধারা অনুযায়ী সরকার অনুমোদিত হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা ও সনদ নিতে হবে, হাসপাতাল থেকে তাকে থানায় পাঠানো হবে। তিনি প্রশ্ন করেন, এখন নতুন ব্যবস্থায় ভুক্তভোগী কোথায় যাবেন? হাসপাতালে না লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে? যদি নতুন বিধান অনুসারে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে ভুক্তভোগী যান, তাহলে চিকিৎসা সনদ না থাকার কারণে পরে সাধারণ জখমের অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে গ্রামে সালিশ প্রক্রিয়ায় যা হয়, অভিযুক্ত পক্ষ মধ্যস্থতায় আসতে ইচ্ছাকৃত দেরি করে বা আসে না। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতার জন্য অপেক্ষা করা নারীর যদি মেডিকেল পরীক্ষা না হয়, তাহলে তার সাধারণ জখমের আঘাত চিহ্ন চলে যায়। এতে ভুক্তভোগীর হয়রানি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ বিধান অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা নানাভাবে টিকে আছে। ধনী-দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত-কমশিক্ষিত, পেশাজীবী বা পেশাজীবী নয়, যে কোনো মেয়েই যৌতুকের কারণে নিপীড়িত হচ্ছেন। কেউ প্রকাশ করেন, কেউ প্রকাশ করেন না। অধিকাংশই মেনে নেন, কম নারী বেরিয়ে আসেন। মহিলা পরিষদ ২০২১ সালের এক জরিপে দেখেছে, নির্যাতনের শিকার নারীদের ৮৩ শতাংশই যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হন। ২০২৪ সালে রাজশাহীতে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত ২৪৫ জন নারী। পারিবারিক সহিংসতার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার যৌতুক। অসংখ্য মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে বর্বর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে যৌতুক নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে; যা বিয়ের আগে থেকে শুরু হয়ে চলতে থাকে। যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে কনের পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। আবার এ দাবি মেটাতে না পারলেই নেমে আসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের খড়্গ।
বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে যৌতুক। মেয়ের বয়স কম ও সুন্দর হলে যৌতুক কম, তাই অভিভাবকরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে চান। কিন্তু বিয়ের পর এই মেয়ের যখন বয়স বেড়ে যায়, সৌন্দর্য ও স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যায়, তখন আবার নতুন করে যৌতুকের দাবি ওঠে। যৌতুকের দাবিতে নববধূকে হত্যা, যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করা, যৌতুকের দাবিতে গর্ভবতী নারীর ওপর নির্যাতন, যৌতুক না পেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে, যৌতুকের জন্য গাছের সাথে দড়ি বেঁধে রাখার ঘটনাগুলো একদিনের নয়। ‘হালকা জখম’ দিয়ে শুরু হয়, ধীরে ধীরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। বড়, ছোট আঘাত, অপমান সহ্য করতে না পেরে অনেক নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।
সমাজে যৌতুককে স্বাভাবিক প্রথা হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা আছে। এমনিতেই যৌতুকের কারণে নিপীড়নের ঘটনা প্রায়ই আইনি প্রক্রিয়ায় পৌঁছায় না, কারণ সামাজিক চাপ এবং নারীর আইনি সচেতনতার অভাব। এর ওপর যখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, শাস্তি তুলে নেওয়ার বা লঘু করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তখন উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। আমরা ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ অধ্যাদেশটি পুনরায় বিবেচনার অনুরোধ করছি।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ