ঢাকা ১০:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫

যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরো দুই মাইলফলক

  • আপডেট সময় : ০২:০৯:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ অক্টোবর ২০২২
  • ৯১ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : গোপালগঞ্জ ও নড়াইলের সীমান্তে দেশের প্রথম ছয় লেইনের মধুমতি সেতু এবং শীতলক্ষ্যা নদীর উপরে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল সোমবার বেলা ১২টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গোপালগঞ্জ, নড়াইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং নারায়ণঞ্জ সেতু প্রান্তে যুক্ত হয়ে সেতু দুটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। দুটি সেতুই সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিটে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের। মধুমতি সেতু খুলে দেওয়া হলে নড়াইল যশোরসহ এই অঞ্চলের মানুষদের সড়কপথে সরাসরি ঢাকা যাতায়াত করতে পারবে। আর তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের ২০ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে আনবে বলে আশা করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি আজ সত্যিই খুব আনন্দিত যে আমরা এ সেতু দুটি সম্পন্ন করতে পেরেছি। এজন্য আমাদের দুটি বন্ধুপ্রতিম দেশ সৌদি আরব এবং জাপান তাদের সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই-তাদের সহযোগিতায় আজকে আমরা বাংলাদেশের উন্নতি করতে পারছি।”
বাংলাদেশে আরো উন্নয়ন প্রকল্প চলছে এবং বন্ধুপ্রতিমগুলো সেসব ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “আজকে সৌদি আরব থেকে এখানে আরো যাতে বিনিয়োগ আসে, আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইনভেস্টমেন্ট আনার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। জাপান আমাদের অনেকগুলো কাজ করে দিয়েছে।”
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এই দুটি সেতু, যাতে আমাদের দেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নতুনভাবে ত্বরান্বিত হবে।
“এবং সেই জন্যই আমি মনে করি যে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সেই সাথে সাথে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, বিশেষ করে আজকে আমরা সাউথ এশিয়ার এমন একটা জায়গায় আছি, আমাদের সঙ্গে অন্যান্য দেশগুলো যেমন নেপাল, ভুটান, ভারত তাদের যে একটা সংযোগ হবে, ব্যবসা বাণিজ্য বাড়বে।”
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি এই যোগাযোগের ফলে আমাদের এইসব অবহেলিত অঞ্চলগুলো আরো বেশি উন্নতি লাভ করবে।”
অনুষ্ঠানে সেতুগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ভিডিও কনফারেন্স সঞ্চালনা করেন। অন্যদের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসেফ ঈসা আল দুহাইলান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
মধুমতি সেতু : নড়াইলের লোহাগড়ার উপজেলা এবং গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীর ওপর নির্মিত মধুমতি সেতুটি দেশের প্রথম ছয় লেইনের সেতু। যা ৬৯০ মিটার দীর্ঘ এবং প্রস্থ ২৬ দশমিক ১ মিটার। সেতুর উভয় পাশে ৬ লেইনের সংযোগ সড়ক রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য দাড়িয়েছে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার।
সেতু উদ্বোধন হওয়ায় নড়াইল যশোরসহ এ অঞ্চলের মানুষ সড়কপথে সরাসরি ঢাকা যাতায়াত করতে পারবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও এ সেতু ভূমিকা রাখবে বলে সরকার আশা করছে। নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০০৮ সালে নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভায় কালনা ঘাটে এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি ‘কালনা সেতু’ নামে এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে কালনা সেতুর নাম পরিবর্তন করে সরকার প্রধান নিজে নদীর নামে ‘মধুমতি সেতু’ নামকরণ করেন বলে জানান তারা সহকারি প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস।
এ কে এম নাসিম ওসমান সেতু : নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর উপজেলার মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে চালু হওয়া তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটি নাম পেয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান সেতু। সোয়া কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই সেতুর দুই পাশে প্রায় দেড় কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক থাকছে। সেতুটা ছয় লেন বিশিষ্ট। চার লেন দিয়ে চলবে দ্রুতগতির যানবাহন, বাকি দুই লেনে চলবে ধীর গতির যানবাহন। সেতুটি চালুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের দূরত্ব অন্তত ২০ কিলোমিটার কমবে বলে আশা করছে সরকার। সড়ক ও জনপথ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, “এখন থেকে ওই দুই পথের (চট্টগ্রাম ও সিলেট) যাত্রীদের ঢাকা হয়ে চলাচল করতে হবে না। সেই কারণে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে যাত্রীদের। দক্ষিণের যাত্রীরা পদ্মা সেতু দিয়ে মুন্সীগঞ্জ হয়ে শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে মদনপুর হয়ে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট যেতে পারবেন।”
রোববার দুপুরে সেতুটি পরিদর্শনকালে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজও বলেন, “এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর সাথে সংযোগ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের। “যারা খুলনা, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এলাকার মানুষ তারা পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই সরাসরি কিন্তু চট্টগ্রাম যেতে পারবে। সেক্ষেত্রে একটা বড় দূরত্ব কমে যাবে।” ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যয় কমে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই ছোট জেলায় ৮০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে এবং অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ এই অংশে বসবাস করেন। তারা এক মিনিটে ওই পাড়ে যেতে পারবেন। নৌকার জন্য তাদের অপেক্ষা যে করতে হতো বা খরচ হতো, সেটা আর করতে হবে না।” সড়ক ও জনপদ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ আশা করছেনশীতলক্ষ্যা সেতু চালু হলে পঞ্চবটি বিসিক শিল্প এলাকা, পঞ্চবটি মোড়, চাষাঢ়া মোড়, সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জের চট্টগ্রাম সড়ক বা ঢাকার পোস্তগোলা ও শনির আখড়া রুটে যানবাহনকে তীব্র যানজটের সম্মুখীন হতে হবে না।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আরেকটি স্বপ্নপূরণ : পদ্মা সেতুর পর দক্ষিণে আরেকটি স্বপ্নের সেতু, যেটিকে বলা হচ্ছে ‘নতুন অর্থনৈতিক করিডোর’ সেই ‘মধুমতি সেতু’ উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের এই সেতুটির কারণে নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহসহ এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতিও ত্বরান্বিত হবে। এটিকে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। এই সেতুর কারণে কলকাতার সঙ্গে ঢাকা দূরত্ব অনেক কমলো। এই সেতু যশোর-নড়াইলের পাশাপাশি বাংলাদেশকে সাব-রিজিনিওয়াল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে যুক্ত করবে। ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। তারা জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা। সেতুটি নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। এই সেতুর সরাসরি সুফল পাবে খুলনা বিভাগের ১০ টিসহ আরও কয়েকটি জেলার লাখ লাখ মানুষ। তারা আরও জানান, সেতুটির কারণে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব কমে আসবে ১১৫ কিলোমিটার। আশপাশের অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে দূরত্ব কমবে ৯০-৯৮ কিলোমিটার। এই সেতু দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়তে সময় ও অর্থ বাঁচাবে। এছাড়া দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে ঢাকা চট্টগ্রামের দূরত্বও কমবে, সাশ্রয় হবে সময়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশি দেশে ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০০৮ সালে নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভায় কালনা ঘাটে এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি ‘কালনা সেতু’ নামে এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে কালনা সেতুর নাম পরিবর্তন করে নদীর নামে ‘মধুমতি সেতু’ নামকরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেতুটি নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য জেলাসহ এই অঞ্চলের মানুষের পক্ষে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই সেতু পুরো দেশের আর্থ-সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভূত উন্নতি সাধন করবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব অংশীজন, মধুমতি নদীর দুই পাড়ের ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছিলো। সেতুটি তাদের জীবনমান বদলে দেবে।
ঢাকাসহ সারা দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নড়াইল হাব হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, দেশের ইতিহাসে সার্ভিসলেনসহ ৬ লেনের সেতু এটিই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে উপহার দিয়েছেন এটি। এদিন সড়ক ও জনপদের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্প পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, সোমবার দিবাগত রাত ১২টায় যান চলাচলের জন্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সেতুটি। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় ১৭টি সেতুর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে এটি প্রথম চালু হচ্ছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়া- উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে সেতুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া পদ্মা সেতুর সুফল পুরোপুরি সুফল পেতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই অঞ্চলের স্থলবন্দরসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যও সেতুর কানেকশন জরুরি ছিল। এই অঞ্চলের সাব-রিজিনিওয়াল কানেক্টিভিটি মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করবে মধুমতি সেতু। প্রকল্প পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক প্রকল্পের আওতায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। রাস্তাঘাট নির্মিত হবে অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে। এটা একটা সাপ্লিমেন্টারি প্রজেক্ট। অন্যান্য যে প্রকল্প তৈরি হবে, তা এটার কমপ্লিমেন্টারি। ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প সাবমিট করা হয়েছে। সেটি হলে এই অংশের পুরোপুরি সুফলটা পাবো। তিনি বলেন, মধুমতি সেতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ধনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন আর্টস টাইপ। সেতুতে ১৫০ মিটার স্প্যান রয়েছে, বড় স্প্যান দিয়েছি আমরা। যে ট্রেডিশনাল পিসি গার্ডার আই সেকশন দিয়ে ৪৫-৪৮ মিটারের বেশি বসানো যায় না। নদীর স্রোতধারা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আর্টস টাইপ স্প্যান দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নৌ চলাচলের কোন সমস্যা নেই।
মধুমতি সেতু পারাপারের জন্য বড় ট্রাক ৫৬৫টাকা, তিন বা ততধিক এক্সসেলের ট্রাক ৪৫০টাকা, দুই এক্সসেলের মাঝারি ট্রাক ২২৫ টাকা, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাস ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকাপ, রূপান্তরিত জিপ ও রেকার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটো টেম্পো, অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ২৫টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিকশা, ভ্যান ও বাইসাইকেলে পাঁচ টাকা করে টোল দিতে হবে।
এই সেতু প্রকল্প ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেতু নির্মাণে ৬০৮.৫৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬৩.৩৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে এবং ৩৪৫.২০ কোটি টাকা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) থেকে এসেছে।
ওয়াকওয়েসহ সেতুটিতে ৩৮টি স্প্যান রয়েছে। পাঁচটি নদীতে এবং ৩৩টি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে। হাঁটার পথসহ সেতুটির প্রস্থ ২২.১৫ মিটার। এছাড়া, ছয়লেনের টোল প্লাজা এবং দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোডও নির্মাণ করা হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের, ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি : নড়াইলে নির্মিত দেশের প্রথম ৬ লেন বিশিষ্ট মধুমতি সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাই বদলে দেবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এর সুফল পাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ পুরো দেশের মানুষ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ এবং ভারতীয় পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই সেতু। নড়াইল-যশোরের ব্যবসায়ীরা বলেন, এই অঞ্চলে মৌসুমি শাক-সবজি, ফল-মূল, খাদ্যশস্য, ফুল এবং মাছ উৎপাদন হয় ব্যাপক পরিসরে। তা ছাড়া ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের পণ্য দেশের বৃহত্তর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব পণ্য ও জিনিসপত্র সড়কপথে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। পণ্য সরবরাহ চেইনে এখন মধুমতি সেতু পরিবর্তন আনবে, পুরো ব্যবস্থা গতিশীল হবে। কম সময়ে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। নড়াইলের লোহাগড়ায় মধুমতি নদীর কালনা পয়েন্টে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় মধুমতি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, নড়াইল-যশোরসহ এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদন হয়। অন্যান্য ফসলেরও উর্বর ক্ষেত্র অঞ্চলটি। যা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এসব পণ্য মূলত মাগুরা হয়ে এবং কালমা ফেরি হয়ে ট্রাকযোগে পরিবহন করা হয় হতো এতদিন। ফলে দীর্ঘ যানজটে পচনশীল অনেক পণ্য নষ্ট হতো কিংবা তাজা চেহারা উবে যেতো। এখন পণ্য পরিবহনের বেশিরভাগই হবে মধুমতি সেতু দিয়ে পরিবহন করা হবে। এতে সময় বাঁচবে এবং ভোগান্তিও কমবে। রিয়াজুল ইসলাম নামে নড়াইল সদরের এক শাক-সবজি ব্যবসায়ী বলেন, নিজ জেলা ও পার্শ্ববর্তী যশোর থেকে আসা পণ্য তিনি ঢাকার কাওরান বাজারে পাঠিয়ে থাকেন। আগে মাগুরা হয়ে পণ্যভর্তি ট্রাক পাঠাতেন। এখন থেকে মধুমতি সেতু দিয়ে পণ্য পাঠানো হবে। সময় সাশ্রয় হবে, ট্রাক ভাড়াও কমবে।
ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য বিপণনকারী তমিজউদদীন বললেন, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচসহ নানা ধরনের পণ্য আসে দেশে। বেনাপোল দিয়ে এসব পণ্যের একটি বড় অংশ আনা হয়। যার অনেকাংশ মাগুরা হয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে যায়। এখন ওই রুটের বদলে মধুমতি সেতু দিয়ে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটি একটি পরিবর্তন আনবে। নড়াইলের মাদ্রাসা বাজারের শিমু শারমিন বলেন, আমরা ঢাকায় থাকি। প্রায়ই বাড়িতে আসা হয়। ফেরিতে ভোগান্তি হতো। এখন পদ্মা সেতু ও মধুমতি সেতু হওয়ায় সুবিধা হলো। নড়াইলবাসী এবং ঢাকায় থাকা নড়াইলের মানুষের জন্য এটি আনন্দের বিষয়। এ ছাড়াও সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসায় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুঁটির শিল্প বেগবান হবে। ছোট-বড় উদ্যোক্তার সংখ্যাও বাড়বে। সরকপথে যাতায়াত বাড়বে। নতুন নতুন গণপরিবহন নামবে। সব মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে হাওয়া লাগবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তবে কালনা ফেরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘাটসংলগ্ন কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্তদের বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজতে হবে। ঘাট সংলগ্ন মূল সড়কের পাশে ৫ বছর ধরে মুদি দোকান করছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব মো. লিয়াকত আলী। তিনি বলছিলেন, ‘সংসার চালাই এই দোকান করে। এখন আর এটি সেভাবে চলবে না। তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও মানুষের উপকার হবে এটাই বড় বিষয়।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরো দুই মাইলফলক

আপডেট সময় : ০২:০৯:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ অক্টোবর ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক : গোপালগঞ্জ ও নড়াইলের সীমান্তে দেশের প্রথম ছয় লেইনের মধুমতি সেতু এবং শীতলক্ষ্যা নদীর উপরে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল সোমবার বেলা ১২টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গোপালগঞ্জ, নড়াইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং নারায়ণঞ্জ সেতু প্রান্তে যুক্ত হয়ে সেতু দুটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। দুটি সেতুই সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিটে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের। মধুমতি সেতু খুলে দেওয়া হলে নড়াইল যশোরসহ এই অঞ্চলের মানুষদের সড়কপথে সরাসরি ঢাকা যাতায়াত করতে পারবে। আর তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের ২০ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে আনবে বলে আশা করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি আজ সত্যিই খুব আনন্দিত যে আমরা এ সেতু দুটি সম্পন্ন করতে পেরেছি। এজন্য আমাদের দুটি বন্ধুপ্রতিম দেশ সৌদি আরব এবং জাপান তাদের সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই-তাদের সহযোগিতায় আজকে আমরা বাংলাদেশের উন্নতি করতে পারছি।”
বাংলাদেশে আরো উন্নয়ন প্রকল্প চলছে এবং বন্ধুপ্রতিমগুলো সেসব ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “আজকে সৌদি আরব থেকে এখানে আরো যাতে বিনিয়োগ আসে, আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইনভেস্টমেন্ট আনার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। জাপান আমাদের অনেকগুলো কাজ করে দিয়েছে।”
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এই দুটি সেতু, যাতে আমাদের দেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নতুনভাবে ত্বরান্বিত হবে।
“এবং সেই জন্যই আমি মনে করি যে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সেই সাথে সাথে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, বিশেষ করে আজকে আমরা সাউথ এশিয়ার এমন একটা জায়গায় আছি, আমাদের সঙ্গে অন্যান্য দেশগুলো যেমন নেপাল, ভুটান, ভারত তাদের যে একটা সংযোগ হবে, ব্যবসা বাণিজ্য বাড়বে।”
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি এই যোগাযোগের ফলে আমাদের এইসব অবহেলিত অঞ্চলগুলো আরো বেশি উন্নতি লাভ করবে।”
অনুষ্ঠানে সেতুগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ভিডিও কনফারেন্স সঞ্চালনা করেন। অন্যদের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসেফ ঈসা আল দুহাইলান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
মধুমতি সেতু : নড়াইলের লোহাগড়ার উপজেলা এবং গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীর ওপর নির্মিত মধুমতি সেতুটি দেশের প্রথম ছয় লেইনের সেতু। যা ৬৯০ মিটার দীর্ঘ এবং প্রস্থ ২৬ দশমিক ১ মিটার। সেতুর উভয় পাশে ৬ লেইনের সংযোগ সড়ক রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য দাড়িয়েছে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার।
সেতু উদ্বোধন হওয়ায় নড়াইল যশোরসহ এ অঞ্চলের মানুষ সড়কপথে সরাসরি ঢাকা যাতায়াত করতে পারবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও এ সেতু ভূমিকা রাখবে বলে সরকার আশা করছে। নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০০৮ সালে নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভায় কালনা ঘাটে এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি ‘কালনা সেতু’ নামে এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে কালনা সেতুর নাম পরিবর্তন করে সরকার প্রধান নিজে নদীর নামে ‘মধুমতি সেতু’ নামকরণ করেন বলে জানান তারা সহকারি প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস।
এ কে এম নাসিম ওসমান সেতু : নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর উপজেলার মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে চালু হওয়া তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটি নাম পেয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান সেতু। সোয়া কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই সেতুর দুই পাশে প্রায় দেড় কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক থাকছে। সেতুটা ছয় লেন বিশিষ্ট। চার লেন দিয়ে চলবে দ্রুতগতির যানবাহন, বাকি দুই লেনে চলবে ধীর গতির যানবাহন। সেতুটি চালুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের দূরত্ব অন্তত ২০ কিলোমিটার কমবে বলে আশা করছে সরকার। সড়ক ও জনপথ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, “এখন থেকে ওই দুই পথের (চট্টগ্রাম ও সিলেট) যাত্রীদের ঢাকা হয়ে চলাচল করতে হবে না। সেই কারণে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে যাত্রীদের। দক্ষিণের যাত্রীরা পদ্মা সেতু দিয়ে মুন্সীগঞ্জ হয়ে শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে মদনপুর হয়ে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট যেতে পারবেন।”
রোববার দুপুরে সেতুটি পরিদর্শনকালে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজও বলেন, “এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর সাথে সংযোগ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের। “যারা খুলনা, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এলাকার মানুষ তারা পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই সরাসরি কিন্তু চট্টগ্রাম যেতে পারবে। সেক্ষেত্রে একটা বড় দূরত্ব কমে যাবে।” ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যয় কমে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই ছোট জেলায় ৮০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে এবং অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ এই অংশে বসবাস করেন। তারা এক মিনিটে ওই পাড়ে যেতে পারবেন। নৌকার জন্য তাদের অপেক্ষা যে করতে হতো বা খরচ হতো, সেটা আর করতে হবে না।” সড়ক ও জনপদ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ আশা করছেনশীতলক্ষ্যা সেতু চালু হলে পঞ্চবটি বিসিক শিল্প এলাকা, পঞ্চবটি মোড়, চাষাঢ়া মোড়, সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জের চট্টগ্রাম সড়ক বা ঢাকার পোস্তগোলা ও শনির আখড়া রুটে যানবাহনকে তীব্র যানজটের সম্মুখীন হতে হবে না।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আরেকটি স্বপ্নপূরণ : পদ্মা সেতুর পর দক্ষিণে আরেকটি স্বপ্নের সেতু, যেটিকে বলা হচ্ছে ‘নতুন অর্থনৈতিক করিডোর’ সেই ‘মধুমতি সেতু’ উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের এই সেতুটির কারণে নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহসহ এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতিও ত্বরান্বিত হবে। এটিকে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। এই সেতুর কারণে কলকাতার সঙ্গে ঢাকা দূরত্ব অনেক কমলো। এই সেতু যশোর-নড়াইলের পাশাপাশি বাংলাদেশকে সাব-রিজিনিওয়াল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে যুক্ত করবে। ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। তারা জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা। সেতুটি নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। এই সেতুর সরাসরি সুফল পাবে খুলনা বিভাগের ১০ টিসহ আরও কয়েকটি জেলার লাখ লাখ মানুষ। তারা আরও জানান, সেতুটির কারণে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব কমে আসবে ১১৫ কিলোমিটার। আশপাশের অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে দূরত্ব কমবে ৯০-৯৮ কিলোমিটার। এই সেতু দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়তে সময় ও অর্থ বাঁচাবে। এছাড়া দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে ঢাকা চট্টগ্রামের দূরত্বও কমবে, সাশ্রয় হবে সময়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশি দেশে ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০০৮ সালে নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভায় কালনা ঘাটে এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি ‘কালনা সেতু’ নামে এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে কালনা সেতুর নাম পরিবর্তন করে নদীর নামে ‘মধুমতি সেতু’ নামকরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেতুটি নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য জেলাসহ এই অঞ্চলের মানুষের পক্ষে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই সেতু পুরো দেশের আর্থ-সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভূত উন্নতি সাধন করবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব অংশীজন, মধুমতি নদীর দুই পাড়ের ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছিলো। সেতুটি তাদের জীবনমান বদলে দেবে।
ঢাকাসহ সারা দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নড়াইল হাব হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, দেশের ইতিহাসে সার্ভিসলেনসহ ৬ লেনের সেতু এটিই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে উপহার দিয়েছেন এটি। এদিন সড়ক ও জনপদের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্প পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, সোমবার দিবাগত রাত ১২টায় যান চলাচলের জন্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সেতুটি। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় ১৭টি সেতুর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে এটি প্রথম চালু হচ্ছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়া- উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে সেতুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া পদ্মা সেতুর সুফল পুরোপুরি সুফল পেতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই অঞ্চলের স্থলবন্দরসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যও সেতুর কানেকশন জরুরি ছিল। এই অঞ্চলের সাব-রিজিনিওয়াল কানেক্টিভিটি মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করবে মধুমতি সেতু। প্রকল্প পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক প্রকল্পের আওতায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। রাস্তাঘাট নির্মিত হবে অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে। এটা একটা সাপ্লিমেন্টারি প্রজেক্ট। অন্যান্য যে প্রকল্প তৈরি হবে, তা এটার কমপ্লিমেন্টারি। ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প সাবমিট করা হয়েছে। সেটি হলে এই অংশের পুরোপুরি সুফলটা পাবো। তিনি বলেন, মধুমতি সেতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ধনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন আর্টস টাইপ। সেতুতে ১৫০ মিটার স্প্যান রয়েছে, বড় স্প্যান দিয়েছি আমরা। যে ট্রেডিশনাল পিসি গার্ডার আই সেকশন দিয়ে ৪৫-৪৮ মিটারের বেশি বসানো যায় না। নদীর স্রোতধারা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আর্টস টাইপ স্প্যান দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নৌ চলাচলের কোন সমস্যা নেই।
মধুমতি সেতু পারাপারের জন্য বড় ট্রাক ৫৬৫টাকা, তিন বা ততধিক এক্সসেলের ট্রাক ৪৫০টাকা, দুই এক্সসেলের মাঝারি ট্রাক ২২৫ টাকা, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাস ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকাপ, রূপান্তরিত জিপ ও রেকার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটো টেম্পো, অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ২৫টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিকশা, ভ্যান ও বাইসাইকেলে পাঁচ টাকা করে টোল দিতে হবে।
এই সেতু প্রকল্প ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেতু নির্মাণে ৬০৮.৫৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬৩.৩৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে এবং ৩৪৫.২০ কোটি টাকা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) থেকে এসেছে।
ওয়াকওয়েসহ সেতুটিতে ৩৮টি স্প্যান রয়েছে। পাঁচটি নদীতে এবং ৩৩টি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে। হাঁটার পথসহ সেতুটির প্রস্থ ২২.১৫ মিটার। এছাড়া, ছয়লেনের টোল প্লাজা এবং দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোডও নির্মাণ করা হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের, ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি : নড়াইলে নির্মিত দেশের প্রথম ৬ লেন বিশিষ্ট মধুমতি সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাই বদলে দেবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এর সুফল পাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ পুরো দেশের মানুষ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ এবং ভারতীয় পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই সেতু। নড়াইল-যশোরের ব্যবসায়ীরা বলেন, এই অঞ্চলে মৌসুমি শাক-সবজি, ফল-মূল, খাদ্যশস্য, ফুল এবং মাছ উৎপাদন হয় ব্যাপক পরিসরে। তা ছাড়া ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের পণ্য দেশের বৃহত্তর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব পণ্য ও জিনিসপত্র সড়কপথে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। পণ্য সরবরাহ চেইনে এখন মধুমতি সেতু পরিবর্তন আনবে, পুরো ব্যবস্থা গতিশীল হবে। কম সময়ে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। নড়াইলের লোহাগড়ায় মধুমতি নদীর কালনা পয়েন্টে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় মধুমতি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, নড়াইল-যশোরসহ এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদন হয়। অন্যান্য ফসলেরও উর্বর ক্ষেত্র অঞ্চলটি। যা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এসব পণ্য মূলত মাগুরা হয়ে এবং কালমা ফেরি হয়ে ট্রাকযোগে পরিবহন করা হয় হতো এতদিন। ফলে দীর্ঘ যানজটে পচনশীল অনেক পণ্য নষ্ট হতো কিংবা তাজা চেহারা উবে যেতো। এখন পণ্য পরিবহনের বেশিরভাগই হবে মধুমতি সেতু দিয়ে পরিবহন করা হবে। এতে সময় বাঁচবে এবং ভোগান্তিও কমবে। রিয়াজুল ইসলাম নামে নড়াইল সদরের এক শাক-সবজি ব্যবসায়ী বলেন, নিজ জেলা ও পার্শ্ববর্তী যশোর থেকে আসা পণ্য তিনি ঢাকার কাওরান বাজারে পাঠিয়ে থাকেন। আগে মাগুরা হয়ে পণ্যভর্তি ট্রাক পাঠাতেন। এখন থেকে মধুমতি সেতু দিয়ে পণ্য পাঠানো হবে। সময় সাশ্রয় হবে, ট্রাক ভাড়াও কমবে।
ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য বিপণনকারী তমিজউদদীন বললেন, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচসহ নানা ধরনের পণ্য আসে দেশে। বেনাপোল দিয়ে এসব পণ্যের একটি বড় অংশ আনা হয়। যার অনেকাংশ মাগুরা হয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে যায়। এখন ওই রুটের বদলে মধুমতি সেতু দিয়ে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটি একটি পরিবর্তন আনবে। নড়াইলের মাদ্রাসা বাজারের শিমু শারমিন বলেন, আমরা ঢাকায় থাকি। প্রায়ই বাড়িতে আসা হয়। ফেরিতে ভোগান্তি হতো। এখন পদ্মা সেতু ও মধুমতি সেতু হওয়ায় সুবিধা হলো। নড়াইলবাসী এবং ঢাকায় থাকা নড়াইলের মানুষের জন্য এটি আনন্দের বিষয়। এ ছাড়াও সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসায় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুঁটির শিল্প বেগবান হবে। ছোট-বড় উদ্যোক্তার সংখ্যাও বাড়বে। সরকপথে যাতায়াত বাড়বে। নতুন নতুন গণপরিবহন নামবে। সব মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে হাওয়া লাগবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তবে কালনা ফেরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘাটসংলগ্ন কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্তদের বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজতে হবে। ঘাট সংলগ্ন মূল সড়কের পাশে ৫ বছর ধরে মুদি দোকান করছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব মো. লিয়াকত আলী। তিনি বলছিলেন, ‘সংসার চালাই এই দোকান করে। এখন আর এটি সেভাবে চলবে না। তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও মানুষের উপকার হবে এটাই বড় বিষয়।’