৬০ বছর বয়সী খাদিজা বলেন, “ভাবতে খুব ভালো লাগে, এই ১০ হাজার শিশু, যাদের আমি প্রসব করিয়েছি, তাদের কাউকে চোখের সামনে মরতে দেখতে হয়নি।” আর সেজন্যই তাকে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করা হয়েছে বলে জানান তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মা সুব্রামনিয়াম। তামিলনাড়ুর দক্ষিণে একটি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিন দশক কাজ করেছেন খাদিজা বিবি। এই সময়ে ভারতের মাতৃমৃত্যুর হার উচ্চ থেকে বৈশ্বিক গড়ের কাছাকাছি নেমে এসেছে। নার্স খাদিজা বিবি বলেন, কন্যা শিশুর জন্ম হলে অনেক অভিভাবকের যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হত, সেই মনোভাব ধীরে ধীরে বদলে যেতে দেখেছেন তিনি। সেইসঙ্গে তিনি দেখেছেন, মানুষ কীভাবে ধীরে ধীরে কম সন্তান নেওয়ার দিকে ঝুঁকেছে। ১৯৯০ সালে নার্স হিসেবে পেশাজীবন শুরুর সময়টায় খাদিজা নিজেই অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ”আমার তখন সাত মাস… তার পরও আমি অন্য নারীদের জন্য কাজ করছিলাম। আমি আবার কাজে ফিরি মোটে দুই মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে।”
পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে খাদিজা বিবি বলেন, “আমি জানি, প্রসব বেদনার সময় মেয়েরা কতটা অস্থির হয়ে ওঠে। তাই ওই সময় তাদের স্বস্তি ও সাহস জোগানোতে গুরুত্ব দিয়েছিলাম আমি।” বিবিসি লিখেছে, এ বছর জুনে দীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন খাদিজা। এখনও যেন চারপাশে স্নিগ্ধতার দ্যুতি ছড়ান তিনি। চেন্নাই শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভিল্লুপুরম গ্রামে তার ক্লিনিকে সি-সেকশন করার মত প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই। গর্ভবতী নারীর কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিলে তৎক্ষণাত তাকে জেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন খাদিজা বিবি। এ কাজে খাদিজার অনুপ্রেরণা হলেন তার মা জুলাইকা, যিনি নিজেও একজন ধাত্রী ছিলেন। খাদিজা বলেন, “আমি তো ছোটবেলায় সিরিঞ্জ নিয়ে খেলেছি। হাসপাতালের গন্ধের সঙ্গে আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম তখন থেকেই।”
দরিদ্র ও অর্ধ শিক্ষিত গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতেন খাদিজার মা। অল্প বয়সেই মায়ের এই কাজের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন খাদিজা। ওই সময় বেসরকারি হাসপাতাল ছিল না বললেই চলে। যে কোনো বয়স এবং শ্রেণি থেকে আসা নারীকে তখন সরকারি মাতৃসদনের ওপর ভরসা করতে হত। এই মাতৃসদনগুলোকে এখন সবাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে চেনে। কর্মজীবনের শুরুতে অনেক প্রতিকূলতার কথা উঠে আসে খাদিজার কথায়। তিনি বলেন, “তখন মোটে একজন ডাক্তার, সাতজন সহায়তাকারী আর অন্য দুজন নার্স ছিলেন। প্রথম কয়েক বছর কাজ করা সত্যিই খুব দুরূহ ছিল।
“আমি তো নিজের সন্তানের দিকে তাকানোরও সুযোগ পাইনি। পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতেও যোগ দিতে পারিনি। কিন্তু ওই দিনগুলো আমাকে মহামূল্যবান শিক্ষা দিয়েছে।”
১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে তখন প্রতি এক লাখ জীবিত শিশুর জন্মের বিপরীত ৫৫৬টি মাতৃমৃত্যুর ঘটনা দেখা যেত। ওই একই বছর ভারতে প্রতি হাজার জীবিত শিশুর জন্মের বিপরীতে ৮৮ জন নবজাতকের মৃত্যু ঘটে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে মৃত্যুহার পড়তির দিকে রয়েছে; প্রতি এক লাখ জীবিত শিশুর জন্মের বিপরীতে ৯৭টি মাতৃমৃত্যু এবং প্রতি হাজার জীবিত শিশুর জন্মের বিপরীতে ২৭টি শিশুমৃত্যু ঘটছে। নারীশিক্ষা ও গ্রামীণ স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগের কারণে এই উন্নতি ঘটেছে বলে মনে করেন খাদিজা। এখন সাধারণত প্রতিদিন দুয়েকটির বেশি প্রসবের কাজ থাকে না। কিন্তু আগের ব্যস্ততম দিনগুলোর কথা সহজেই মনে করতে পারেন খাদিজা। “২০০০ সালের ৮ মার্চ ছিল আমার জীবনের ব্যস্ততম দিন।”
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ওই দিন ক্লিনিকে হাঁটাচলার মাঝে অনেকেই খাদিজাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন। “আমি প্রসব বেদনা ওঠা দুজন গর্ভবতীকে দেখলাম আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি দুজনের সন্তান প্রসব করিয়ে দিলাম। এরপর আরও ছয় জন নারী ক্লিনিকে এলেন।” খাদিজার সেসময় একজন সহকারী ছিল। তবু কাজের ক্লান্তি মুছে গেল নিমিষেই। “যখন আমি কাজ সেরে ক্লিনিক থেকে বের হচ্ছি, আমি নবজাতকের কান্না শুনতে পেলাম। এ সত্যি অদ্ভুত এক অনুভূতি।” ৫০ জোড়া যমজ এবং একবার এক মায়ের তিন সন্তান প্রসব করানোর কথা মনে করতে পারেন খাদিজা বিবি। তার ভাষ্যে, বিত্তশালী পরিবারের নারীরা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পছন্দ করে। এখন সি-সেকশন করানোর তাগাদাও অনেক বেড়েছে। “আমার মা সন্তান প্রসব করানোর সময় অনেক মৃত্যু দেখেছেন। সি-সেকশন অনেক জীবন বাঁচিয়েছে। “আমার কর্মজীবনের গোড়ায় অনেক নারীকে দেখেছি অস্ত্রোপচারের কথা শুনে ভয় পেতে। আর এখন অনেকে স্বাভাবিক প্রসবে ভীত হয়ে পড়েন, অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের দিকেই ঝোঁক বেশি।” খাদিজা বিবিসিকে বলেন, গত তিন দশকে গ্রামের ঘরে ঘরে আয়-রোজগার বেড়েছে। কিন্তু সাথে অন্য জটিলতাও বেড়েছে। “গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আগে খুব একটা দেখা যেত না। কিন্তু এখন এই সমস্যা হরেদরে হচ্ছে।”
তবে সামাজিক চিন্তা-ভাবনায় বড় রকমের পরিবর্তন দেখতে পান খাদিজা। স্বামীরা এখন স্ত্রীর সন্তান প্রসবের মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে চান; এমন অনুরোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে বলে জানালেন খাদিজা। তিনি বলেন, ”আমি খারাপ সময় দেখেছি, আবার ভালো সময়ও দেখেছি। কন্যা সন্তান জন্ম হলে অনেক স্বামী তাদের স্ত্রীকে দেখতে পর্যন্ত যেত না। দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বার কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে অনেক নারী চোখের জলের বন্যা বইয়ে দিত।”
নব্বইয়ের দশকে লিঙ্গ ভিত্তিক গর্ভপাত ও শিশুহত্যার ঘটনার অভিযোগ অনেক বেশি দেখা যায়। সেসময় গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ অভিভাবকদের জানাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত সরকার। পরিবারের কাছে অনাকাঙ্খিত কন্যা সন্তানের জন্য তামিল নাড়ু সরকার ‘ক্রেডল বেবি স্কিম’ চালু করে। এখন সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে জানিয়ে খাদিজা বিবি বলেন, অনেক দম্পতি এখন দুটি সন্তান নেন; সন্তান ছেলে না মেয়ে, সেসব নিয়ে ভাবেন না। অবসরে পরের জীবন কীভাবে কাটবে তা নিয়ে গোছানো কোনো পরিকল্প নেই খাদিজার। তবে সামনে যে কিছু বিষয়ের অভাব অনুভব করবেন, সে কথা তিনি বিলক্ষণ জানেন। খাজিদা বলেন, “নবজাতকের প্রথম কান্না শোনার সেই মুহূর্ত ফিরে পেতে আমি উন্মুখ হয়ে আছি। “একজন নারী যখন প্রসব বেদনার যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যান, সন্তানের কান্না শুনে তিনি সেই ব্যথা ভুলে হেসে ওঠেন। তাদের চেহারার সেই ভারমুক্তি আমার জন্য ছিল ভীষণ আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। জীবনের এতগুলো বছর আমার জন্য এক আত্মিক ভ্রমণ ছিল।”