ফারজানা কাশেমী : “বাবা আমি আটকা পড়েছি, আমাকে বাঁচাও”- মৃত্যুর আগে লামিসা নামের এক বুয়েট শিক্ষার্থী তার বাবার কাছে এভাবেই আকুতি কিংবা অনুরোধ করেছিলো। সন্তানদের প্রধান ও প্রথম আশ্রয়স্থল হচ্ছে তাদের বাবা।
যেকোনো পরিস্থিতি কিংবা দুর্যোগে সন্তানদের ঢাল স্বরুপ তাদের বাবা। সন্তানদের আশ্রয় ও বাবা। অনেক সন্তানই মনে করেন তার বাবা তাকে সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন। সন্তানের পৃথিবীতে বাবার মতো বড় উদ্ধারকর্মী হয়তো আর নেই।এক জীবনে যেকোনো পরিস্থিতিতে বাবা থাকলেই সন্তানের রক্ষা হয়। বাবা যেনো সন্তানদের রক্ষাকবচ। বেলী রোডে আগুনে লেলিহান শিখায় পুড়ে প্রাণ হারানো লামিসা ও হয়তো ভেবেছিল তার বাবা তাকে আগুনের দাবানল থেকে বাঁচাতে পারবেন।কারণ বাবা পৃথিবীর সব অসাধ্য সাধন করতে পারেন।
এ যাত্রায় লামিসার বাবা অসহায় আর নিরুপায় হয়েছিলো। মৃত্যুর নিকষ কালো অন্ধকার থেকে লামিসার বাবা লামিসাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছেন। শবযাত্রার পথে বাবা অসহায় হয় আর সন্তান নিরুত্তর হয়। পরিকল্পিত নগরায়ন আর অপরিকল্পিত নগরীতে প্রতিদিন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কিছু মানুষ বাঁচে আর কিছু মানুষ প্রাণ হারায়। যেই মানুষগুলো বেঁচে যায় সেই মানুষগুলো হয়তো পরবর্তী দুর্ঘটনার শিকার হবার জন্য অবশিষ্ট থাকে। অনিশ্চিত জীবনে নিশ্চিত অপমৃত্যুর ঝুঁকি তিলোত্তমা এই নগরে। দূষিত সীসার বাতাসে এই নগরে দম বন্ধ হয়ে আসে মুহুমুহু। জলবায়ু পরিবর্তন আর দূষিত বাতাসে এই নগরের প্রতি ফটকে মৃত্যুর জয়ধ্বনি। মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতায় এই নগরে নিছক ছুতো মাত্র। এই নগরে অজুহাতে, দোষারপে, অবহেলায়,গাফিলতিতে প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু হয়। অকাতরে এই মৃত্যুর মিছিলে দোষীব্যক্তির সাজা দেওয়ার বিধান অদৃশ্য এ-ই নগরে। প্রতি বছর এই নগরে আগুনে পুড়ে জীবন আর জীবিকা হারায় অসংখ্য মানুষ। পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য আপামর জনতার দুঃখ হয়। বেঁচে থাকা মানুষগুলো কখনো লজ্জিত হয় আবার কখনো বীরদর্পে জনসম্মুখে ঘুরে ফিরে। এই নগরে যাদুকর তার তুলির স্বতঃস্ফূর্ত ছোয়ায় অপরিকল্পিত নগরায়ন কে রুখতে পারেন না। এই নগরে সন্তানের আবদার মেটাতে মা তার সন্তানকে রেস্টুডেন্টে খাবার খাওয়ানোর জন্য যায় তথাপি মা আর সন্তান দুজনেই প্রাণ হারায়। এভাবেই তানজিনা আর তার সন্তানের মৃত্যু হয় বেলিরোডের আগুনের ভয়াল গ্রাসে।
তুষার আর অভিশ্রুতি নামের দুজন সাংবাদিক আগুনে পুড়ে জীবন হারিয়ে সংবাদে উপকরণ হয় নগর-পরিকল্পনার এই অপরিকল্পিত নগরীতে। এই নগরের আগুনের লেলিহান দাবালনে সদ্য গ্রাজুয়েশন করা শিক্ষার্থীর সমাবর্তনের পরিবর্তে কপালের লিখন হয় গায়েবী জানাজা। নকশাবিদ, পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী সঃস্থা কেন যেন নিরবে নিভৃতে বিরাজ করে অপরিকল্পিত এ-ই নগরীতে। এই নগরে একটা কবরের জায়গার দাম কোটি টাকা আর নগরবাসীর জীবনের দাম যেন শূন্য। স্কুল শিক্ষিকা মা আর তার কন্যা সন্তান একসাথে বাড়ির বাইরে যায় ছুটির দিন উৎযাপন করতে অথচ তাদের জন্য অপেক্ষা করে জীবনের ছুটির ঘন্টা।
প্রতিটি মায়ের মতো প্রাণ হারানো মা হয়তো চেয়েছিলেন তার কন্যা সন্তান একদিন বড় হবে, অনেক বড় হবে, মানুষের মতো মানুষ হবে। প্রান উচ্ছল প্রান হারানো কন্যা সন্তান ও চেয়েছিলেন মায়ের জীবনে বাধ ভাঙ্গা খুশির জোয়ার হবে আর সকল অপূর্নতার সমাধান হবে নিজের জীবনের প্রাপ্তিতে।
এই নগরে আগুনে কিংবা ভুল চিকিৎসায় অহরহ মানুষ প্রাণ হারায়। তাই স্ব পরিবারে দেশ ছেড়ে অন্যত্র বসবাসের বিধিব্যবস্থা হলেও এই নগরের আগুনের ভয়াল ছোবলে একই পরিবারের পাঁচজন ব্যক্তির কবর খুঁড়ে তাদের প্রিয়জন। এই নগরে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আহবান নিয়ে যমদূত ঘুরেফিরে নগরের আট্টালিকার ফাঁকে ফাঁকে। উবধফ ঢ়বড়ঢ়ষব ৎবপবরাব সড়ৎব ভষড়বিৎং ঃযধহ ঃযব ষরারহম ড়হব…..
এই শহর আজব শহর; প্রাণের শহর ঢাকারে….
লেখক: আইনজীবী