ঢাকা ০৫:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

যে জীবন ‘তৃপ্তিবোধে’র, যে জীবন ‘আত্মগরিমা’র

  • আপডেট সময় : ০৯:৩৩:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২
  • ১৪৩ বার পড়া হয়েছে

অপূর্ব শর্মা : “আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত। অনেকে হয়তো একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয় বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। প্রাপ্তির নিয়মকানুন ঠিক করা এবং সেগুলো প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়া, এটা জীবনের একটি বড় শিক্ষা।” চলতি বছরের মার্চের ১৬ তারিখে জীবনের সবশেষ অনুষ্ঠানে ঠিক এমনভাবেই নিজের জীবন সম্পর্কে অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন ভাষা সৈনিক, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার মতো করে নিকটকালে নিজের জীবন সম্পর্কে ঠিক এভাবে ‘তৃপ্তিবোধ’ করতে শুনিনি কাউকে। একজন আবুল মাল মুহিত যে জীবন যাপন করে গেছেন তাকে এক কথায় পরিপূর্ণ জীবনই বলা চলে। সে কারণেই জীবন নিয়ে তার এই উচ্চারণকে আত্মগরিমা বলার উপায় নেই। ভণিতাহীন তার এই অকপট স্বীকারোক্তি মুহিতের ব্যতিক্রম প্রজ্ঞারই পরিচায়ক। নিজেকে জানতে পেরেছিলেন বলেই, এমনটি বলতে পেরেছিলেন তিনি। ৩০ এপ্রিল প্রথম প্রহরেই সেই গর্বিত জীবনের ইতি টেনেছেন বাঙালির অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতি হারিয়েছে একজন নিখাদ দেশপ্রেমিককে। ৮৮ বছর বয়সে থেমে গেছে তার জীবন গাড়ির চাকা।

আমরা যারা আবুল মাল আবদুল মুহিতকে কাছ থেকে দেখেছি, তারা প্রত্যেকেই জানি- জীবন নিয়ে তার কোনও আক্ষেপ ছিল না। না পাওয়ার বেদনায় তিনি ব্যথিত হননি কখনো। সারল্যে ভরা জীবনে সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন সব সময়। মনে আছে-তখনও তিনি মন্ত্রী বা এমপি হননি, সিলেট-১ আসনে নির্বাচনের বছর খানেক আগে দৈনিক যুগভেরীতে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ে তাৎক্ষণিক তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের। আমি তার জীবন চলা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলেন, দিনযাপনে মাত্র দুইশ টাকা ব্যয় হয় তার। পেনশনের টাকা থেকেই সেই ব্যয় নির্বাহ করেন। অন্য কোনো বদ অভ্যাস না থাকায় এতেই চলে যায়। ভেবেই বিস্মিত হয়েছিলাম যে, এও সম্ভব? সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। তিনি হাসিমুখে দিয়েছিলেন উত্তর। সেই থেকেই তার সাথে হৃদ্যতা তৈরি হয়। সময়ের সাথে সাথে সেই সম্পর্ক হয় নিবিড় থেকে নিবিড়তর। ফোন করে কখনো পাইনি এমনটি হয়নি। কখনো রিসিভ করতে না পারলে পরে কলব্যাক করেছেন। সিলেটে বড় কোনও ঘটনা ঘটলেই ফোন দিয়ে জানতে চাইতেন বিস্তারিত। সংবাদপত্রের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণেই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে নিতেন। আমার লেখা প্রায় সবগুলো বই-ই পড়েছেন তিনি। দেখা হলেই খোঁজ নিতেন, নতুন কী লিখছি। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকেও সাহিত্যের প্রতি তার এই অনুরাগে মুগ্ধ হতাম, হতাম বিস্মিত।

আসলে বই ছিল তার পরম বন্ধু। সেই বন্ধুকেই জীবন চলার পথে সঙ্গী করে অগ্রসর হয়েছেন তিনি। বই পড়তে ভালোবাসতেন, বই কিনতে নিজেই ছুটে যেতেন বইয়ের দোকানে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরও তিনি বইমেলা প্রেম ছাড়তে পারেন নি। বইয়ের স্টলে স্টলে গিয়ে পছন্দমতো বই কিনে তিনি নিজ জ্ঞানপিপাসা মেটানোর চেষ্টা করতেন।

বুঝতে শেখার পর থেকেই তিনি ছিলেন সাহিত্যের প্রতি নিবেদিত। এর পেছনেও একটা ইতিহাস আছে। সেটি অনুসন্ধানের, নিজেকে আবিষ্কারের। কৈশোরে আবুল মাল আবদুল মুহিত চরিত অভিধান খুঁজে দেখতেন ২৫ জানুয়ারিতে এ ভূখ-ে কোন কোন বড় ব্যক্তিত্ব জন্ম নিয়েছেন। আর তা খুঁজতে গিয়েই পেয়ে যান, তার জন্মের ১১০ বছর আগে একই দিন অর্থাৎ ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম নেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এর মাধ্যমে নিজের জন্মদিনের একটি বিশেষত্ব খুঁজে পান মুহিত। এই দুইয়ের একটি যোগসূত্র রয়েছে বলেও মনে মনে ধরে নেন তিনি। আর সেটাকে রক্ষা করারও একটি সংকল্প করেন। সিদ্ধান্ত নেন, মধুসূদনের যত লেখা আছে সবই তিনি পাঠ করবেন। যেই কথা সেই কাজ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পড়ে ফেলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সব লেখা। যা তার স্মৃতিতে ছিল অমলিন। অনর্গল বলতে পারতেন মধুসূদনের রচনা থেকে। তিনি পাঠ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের আরেক যুগস্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। সেই স্মৃতিও তার মানসপটে ছিল জাগরুক। সেসব কথা বলতে গেলে আনন্দের হাসি খেলা করতো তার মুখাবয়বে।

তখন তিনি স্কুলেরই ছাত্র। ‘বাবার কারণে’ তিনিও তখন পাকিস্তান আন্দোলনের এক কর্মী। মুকুল ফৌজের নেতা হিসেবে জিন্নাহকে মানপত্র দিচ্ছেন, আবার কংগ্রেসি বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছেন নেহেরুর জনসভায়। সেখানেও বসছেন সামনে। মুগ্ধ হচ্ছেন জওহরলাল নেহেরুর ভাষণে। স্কুলে বসেই নেহেরুর ডিসকভারি অব দ্য ওয়ার্ল্ড পড়ে শেষ করেছেন। তারপর সারাজীবনে তিনি তার বিশাল পড়াশোনার সঙ্গে পড়েছেন নেহেরুর প্রতিটি লাইন। তবে স্কুলজীবনে তাঁর ওই পড়াশোনা দেখে তার বাংলার শিক্ষক একদিন তাকে ডেকে বলেন, ‘দেখ বঙ্কিমচন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক বলো আর যাই বলো, আগে বঙ্কিম পড়ো’। এ স্মৃতি বলতে গিয়ে প্রায়ই হো হো করে হেসে উঠতেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বলতেন, “তখন স্কুলজীবনে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানে’র আন্দোলন করছি। তাই অনেকের মতো বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে ধারণা অমনই ছিল। আর বঙ্কিম পড়ার মধ্যে পড়েছি ওই কমলাকান্তর দপ্তরসহ দুই একটি বই। কিন্তু স্যার বলার পরদিন থেকেই শুরু করি বঙ্কিম পড়তে। কিছুদিনের ভেতর শেষ করি সমগ্র বঙ্কিম রচনাবলী। বুঝতে পারি বাংলা সাহিত্যের তিনি অন্যতম যুগস্রষ্টা।”

শুধু বই পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি তিনি। নিজেও লিখেছেন অনেকগুলো বই। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ঞযব উবঢ়ঁঃু ঈড়সসরংংরড়হবৎ রহ ঊধংঃ চধশরংঃধহ (১৯৬৮), ইধহমষধফবংয ঊসবৎমবহপব ড়ভ ধ ঘধঃরড়হ (১৯৭৮, জবারংবফ ২হফ ঊফরঃরড়হ ১৯৯২), ঞযড়ঁমযঃং ড়হ উবাবষড়ঢ়সবহঃ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ (১৯৮১), চৎড়নষবসং ড়ভ ইধহমষধফবংয-অহ অঃঃবসঢ়ঃ ধঃ ঝঁৎারাধষ (১৯৮৬), উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঝঃৎধঃবমরবং-ষবংংড়হং ভৎড়স ঊীঢ়বৎরবহপব (১৯৮৮), বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও জাতীয় ঐক্যমত্য (১৯৯১), অসবৎরপধহ জবংঢ়ড়হংব ঃড় ইধহমষধফবংয খরনবৎধঃরড়হ ডধৎ (১৯৯৬),
স্মৃতি অম্লান-১৯৭১ (১৯৯৬), রাজনৈতিক ঐক্যমতের সন্ধানে (১৯৯৯), ইধহমষধফবংয রহ ঃযব ঞবিহঃু-ভরৎংঃ ঈড়ঁহঃৎু (১৯৯৯), বাংলাদেশ:জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব (২০০০), ওংংঁবং ড়ভ এড়াবৎহধহপব রহ ইধহমষধফবংয (২০০০), মহাপুরুষদের কথা-কাছে থেকে দেখা (২০০১), নানা দেশে নানা জাতি (২০০১), ছোট সীমানা বৃহৎ বিকাশ (২০০১), জেলায় জেলায় সরকার আইনের একটি পর্যালোচনা (২০০২), অ জরমমবফ ঊষবপঃরড়হ: অহ ওষষবমরঃরসধঃব এড়াবৎহসবহঃ (২০০২), কারচুপির নির্বাচন অবৈধ সরকার (২০০২), ঝঃধঃব খধহমঁধমব গড়াবসবহঃ রহ ঊধংঃ ইধহমধষ ১৯৪৭-১৯৫৬ (২০০৮) এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাতাশ মাস (২০০৯)। বের হয়েছে রচনা সমগ্র। বাংলা ও বাঙালির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন, ‘হিস্টরি অব বেঙ্গল’। তার ১৯ বছরের শ্রম এবং সাধনার ফসল এটি। তার মতে, ‘এটা একটি টেক্সট বুক।’ লেখক হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। ২০০০ সালে তার লেখা ‘বাংলাদেশ:জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব’ জাতীয় আর্কাইভসের বিচারে একটি সেরা গ্রন্থ হিসেবে পুরস্কার লাভ করে।
সংসদে সর্বোচ্চ ১২ বার বাজেট দেওয়া সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে। বাবা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ছিলেন তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের নেতা। আর মা সৈয়দ সাহার বানু চৌধুরী ছিলেন সিলেট মহিলা মুসলিম লীগের সহ-সভানেত্রী। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মের কারণে শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত নানা কারণেই আলোচিত একজন মানুষ ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আপসহীন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। ১৯৪৯ সালে সিলেটের মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা চালায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। পাকিস্তানে কোনো হিন্দু জমিদারের নামে কলেজ হতে পারে না- এই যুুক্তিতে তারা নাম পরিবর্তনের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। সহপাঠিদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে সেই অপতৎপরতা রুখতে সক্ষম হন তিনি। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। কুখ্যাত ৯২ (ক) ধারা স্বৈরশাসন জারী হলে এই সালের জুন মাসে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে নিরাপত্তা আইনে ফেব্রুয়ারি মাসে পুনরায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নানা বাধা-বিপত্তি তার শিক্ষা জীবনে প্রতিবন্ধকতার কারণ হতে পারেনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৫ সালে ইংরেজিতে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন এমএ। ১৯৫৬ সালে তিনি সিএসপি হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। এসময় অর্থনীতি পড়ার প্রতি মনোনিবেশ করেন মুহিত। ১৯৫৭-৫৮তে অক্সফোর্ড এবং ১৯৬৪ তে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন অর্থনীতিতে ডিগ্রি। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে এবং মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের সচিব থাকার সময় বার্ষিক প্রতিবেদনে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরেন, যা পরবর্তীকালে জাতীয় পরিষদে বিতর্কের ভিত্তি হয়।
১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে বাঙালি কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মার্কিন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক লবি করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পরিকল্পনা সচিব নিযুক্ত হন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮১ সালে সচিব পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদের সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ২০ মাস দায়িত্ব পালনের পর এরশাদ সরকারের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে মন্ত্রী পদ থেকে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি নীতির খাতিরে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দেন এবং প্রবাসে চলে যান। এ সময় তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উড্রো উইলসন স্কুলে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।
দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা চালু হলে তিনি ফিরে আসেন এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পাশাপাশি তিনি পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে ব্রতী হন। নবম সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে অংশ নিয়ে জয়ী হন প্রয়াত মুহিত। মহাজোট সরকার গঠন করলে লাভ করেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। দশম নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুনরায় একই পদে আসীন হন। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে পালন করেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব।
লেখক সত্তার পাশাপাশি দেশের শিল্প, সংস্কৃতি অঙ্গনেও তিনি ছিলেন বিশেষভাবে সমাদৃত একজন মানুষ। রাজধানীর যেকোনও সাংস্কৃতিক বা বিদ্বজনের অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত দর্শকসারিতে, এর ব্যত্যয় ঘটেনি মন্ত্রী হওয়ার পরও। তিনি কখনো জনবিচ্ছিন্ন থাকতে চান নি। জনমানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন সব সময়। জন্মমাটির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। মন্ত্রী থাকাকালে কথা দিয়েছিলেন, প্রতি মাসে একবার সিলেটে আসবেন। সেই কথা তিনি রেখেছিলেন। জীবন সায়াহ্নেও তিনি ছুটে এসেছেন সিলেটে। সবশেষ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর সিলেটে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে গত ১৪ মার্চ তাকে নিজের শহরে নিয়ে আসা হয়। তার ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে ঘুরিয়ে দেখানো হয় প্রিয় স্থানগুলো। ১৬ মার্চ সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ‘আজীবন সুকীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ’ আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ‘গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননা’ দেওয়া হয়। নগরের সুরমা নদীর তীরের চাঁদনীঘাট এলাকায় হয় নিজের জীবন নিয়ে আত্মতুষ্ঠির কথা বলেন তিনি। উল্লেখ করেন, “আমি একান্তভাবে সিলেটের মানুষ। আমার জন্মভূমি আমার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে এটার চেয়ে বড় প্রাপ্তি তো আর কিছু হতে পারে না।” সত্যিই তাই। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারেনা। তাকে গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননা দিয়ে সিলেটবাসীও হয়েছে সম্মানিত। আর তিনি হয়েছেন তৃপ্ত। জন্মমাটির মানুষের ভালোবাসা নিয়েই মুহিত পারি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। কয়জনের হয়, এমন ভাগ্য?
তার অন্তিম ইচ্ছা ছিল সিলেটের মাটিতেই যেন সমাধি হয়। মুহিতের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটলো একটি অধ্যায়ের, একটি যুগের। কিন্তু তিনি যে আলোকপ্রভা জ্বেলে গেছেন আমাদের মনে এবং মননে তা প্রজ্জ্বলিত থাকবে অনেক অনেক কাল।
অপূর্ব শর্মা : লেখক, সাংবাদিক

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

যে জীবন ‘তৃপ্তিবোধে’র, যে জীবন ‘আত্মগরিমা’র

আপডেট সময় : ০৯:৩৩:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২

অপূর্ব শর্মা : “আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত। অনেকে হয়তো একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয় বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। প্রাপ্তির নিয়মকানুন ঠিক করা এবং সেগুলো প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়া, এটা জীবনের একটি বড় শিক্ষা।” চলতি বছরের মার্চের ১৬ তারিখে জীবনের সবশেষ অনুষ্ঠানে ঠিক এমনভাবেই নিজের জীবন সম্পর্কে অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন ভাষা সৈনিক, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার মতো করে নিকটকালে নিজের জীবন সম্পর্কে ঠিক এভাবে ‘তৃপ্তিবোধ’ করতে শুনিনি কাউকে। একজন আবুল মাল মুহিত যে জীবন যাপন করে গেছেন তাকে এক কথায় পরিপূর্ণ জীবনই বলা চলে। সে কারণেই জীবন নিয়ে তার এই উচ্চারণকে আত্মগরিমা বলার উপায় নেই। ভণিতাহীন তার এই অকপট স্বীকারোক্তি মুহিতের ব্যতিক্রম প্রজ্ঞারই পরিচায়ক। নিজেকে জানতে পেরেছিলেন বলেই, এমনটি বলতে পেরেছিলেন তিনি। ৩০ এপ্রিল প্রথম প্রহরেই সেই গর্বিত জীবনের ইতি টেনেছেন বাঙালির অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতি হারিয়েছে একজন নিখাদ দেশপ্রেমিককে। ৮৮ বছর বয়সে থেমে গেছে তার জীবন গাড়ির চাকা।

আমরা যারা আবুল মাল আবদুল মুহিতকে কাছ থেকে দেখেছি, তারা প্রত্যেকেই জানি- জীবন নিয়ে তার কোনও আক্ষেপ ছিল না। না পাওয়ার বেদনায় তিনি ব্যথিত হননি কখনো। সারল্যে ভরা জীবনে সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন সব সময়। মনে আছে-তখনও তিনি মন্ত্রী বা এমপি হননি, সিলেট-১ আসনে নির্বাচনের বছর খানেক আগে দৈনিক যুগভেরীতে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ে তাৎক্ষণিক তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের। আমি তার জীবন চলা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলেন, দিনযাপনে মাত্র দুইশ টাকা ব্যয় হয় তার। পেনশনের টাকা থেকেই সেই ব্যয় নির্বাহ করেন। অন্য কোনো বদ অভ্যাস না থাকায় এতেই চলে যায়। ভেবেই বিস্মিত হয়েছিলাম যে, এও সম্ভব? সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। তিনি হাসিমুখে দিয়েছিলেন উত্তর। সেই থেকেই তার সাথে হৃদ্যতা তৈরি হয়। সময়ের সাথে সাথে সেই সম্পর্ক হয় নিবিড় থেকে নিবিড়তর। ফোন করে কখনো পাইনি এমনটি হয়নি। কখনো রিসিভ করতে না পারলে পরে কলব্যাক করেছেন। সিলেটে বড় কোনও ঘটনা ঘটলেই ফোন দিয়ে জানতে চাইতেন বিস্তারিত। সংবাদপত্রের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণেই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে নিতেন। আমার লেখা প্রায় সবগুলো বই-ই পড়েছেন তিনি। দেখা হলেই খোঁজ নিতেন, নতুন কী লিখছি। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকেও সাহিত্যের প্রতি তার এই অনুরাগে মুগ্ধ হতাম, হতাম বিস্মিত।

আসলে বই ছিল তার পরম বন্ধু। সেই বন্ধুকেই জীবন চলার পথে সঙ্গী করে অগ্রসর হয়েছেন তিনি। বই পড়তে ভালোবাসতেন, বই কিনতে নিজেই ছুটে যেতেন বইয়ের দোকানে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরও তিনি বইমেলা প্রেম ছাড়তে পারেন নি। বইয়ের স্টলে স্টলে গিয়ে পছন্দমতো বই কিনে তিনি নিজ জ্ঞানপিপাসা মেটানোর চেষ্টা করতেন।

বুঝতে শেখার পর থেকেই তিনি ছিলেন সাহিত্যের প্রতি নিবেদিত। এর পেছনেও একটা ইতিহাস আছে। সেটি অনুসন্ধানের, নিজেকে আবিষ্কারের। কৈশোরে আবুল মাল আবদুল মুহিত চরিত অভিধান খুঁজে দেখতেন ২৫ জানুয়ারিতে এ ভূখ-ে কোন কোন বড় ব্যক্তিত্ব জন্ম নিয়েছেন। আর তা খুঁজতে গিয়েই পেয়ে যান, তার জন্মের ১১০ বছর আগে একই দিন অর্থাৎ ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম নেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এর মাধ্যমে নিজের জন্মদিনের একটি বিশেষত্ব খুঁজে পান মুহিত। এই দুইয়ের একটি যোগসূত্র রয়েছে বলেও মনে মনে ধরে নেন তিনি। আর সেটাকে রক্ষা করারও একটি সংকল্প করেন। সিদ্ধান্ত নেন, মধুসূদনের যত লেখা আছে সবই তিনি পাঠ করবেন। যেই কথা সেই কাজ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পড়ে ফেলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সব লেখা। যা তার স্মৃতিতে ছিল অমলিন। অনর্গল বলতে পারতেন মধুসূদনের রচনা থেকে। তিনি পাঠ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের আরেক যুগস্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। সেই স্মৃতিও তার মানসপটে ছিল জাগরুক। সেসব কথা বলতে গেলে আনন্দের হাসি খেলা করতো তার মুখাবয়বে।

তখন তিনি স্কুলেরই ছাত্র। ‘বাবার কারণে’ তিনিও তখন পাকিস্তান আন্দোলনের এক কর্মী। মুকুল ফৌজের নেতা হিসেবে জিন্নাহকে মানপত্র দিচ্ছেন, আবার কংগ্রেসি বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছেন নেহেরুর জনসভায়। সেখানেও বসছেন সামনে। মুগ্ধ হচ্ছেন জওহরলাল নেহেরুর ভাষণে। স্কুলে বসেই নেহেরুর ডিসকভারি অব দ্য ওয়ার্ল্ড পড়ে শেষ করেছেন। তারপর সারাজীবনে তিনি তার বিশাল পড়াশোনার সঙ্গে পড়েছেন নেহেরুর প্রতিটি লাইন। তবে স্কুলজীবনে তাঁর ওই পড়াশোনা দেখে তার বাংলার শিক্ষক একদিন তাকে ডেকে বলেন, ‘দেখ বঙ্কিমচন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক বলো আর যাই বলো, আগে বঙ্কিম পড়ো’। এ স্মৃতি বলতে গিয়ে প্রায়ই হো হো করে হেসে উঠতেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বলতেন, “তখন স্কুলজীবনে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানে’র আন্দোলন করছি। তাই অনেকের মতো বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে ধারণা অমনই ছিল। আর বঙ্কিম পড়ার মধ্যে পড়েছি ওই কমলাকান্তর দপ্তরসহ দুই একটি বই। কিন্তু স্যার বলার পরদিন থেকেই শুরু করি বঙ্কিম পড়তে। কিছুদিনের ভেতর শেষ করি সমগ্র বঙ্কিম রচনাবলী। বুঝতে পারি বাংলা সাহিত্যের তিনি অন্যতম যুগস্রষ্টা।”

শুধু বই পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি তিনি। নিজেও লিখেছেন অনেকগুলো বই। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ঞযব উবঢ়ঁঃু ঈড়সসরংংরড়হবৎ রহ ঊধংঃ চধশরংঃধহ (১৯৬৮), ইধহমষধফবংয ঊসবৎমবহপব ড়ভ ধ ঘধঃরড়হ (১৯৭৮, জবারংবফ ২হফ ঊফরঃরড়হ ১৯৯২), ঞযড়ঁমযঃং ড়হ উবাবষড়ঢ়সবহঃ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ (১৯৮১), চৎড়নষবসং ড়ভ ইধহমষধফবংয-অহ অঃঃবসঢ়ঃ ধঃ ঝঁৎারাধষ (১৯৮৬), উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঝঃৎধঃবমরবং-ষবংংড়হং ভৎড়স ঊীঢ়বৎরবহপব (১৯৮৮), বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও জাতীয় ঐক্যমত্য (১৯৯১), অসবৎরপধহ জবংঢ়ড়হংব ঃড় ইধহমষধফবংয খরনবৎধঃরড়হ ডধৎ (১৯৯৬),
স্মৃতি অম্লান-১৯৭১ (১৯৯৬), রাজনৈতিক ঐক্যমতের সন্ধানে (১৯৯৯), ইধহমষধফবংয রহ ঃযব ঞবিহঃু-ভরৎংঃ ঈড়ঁহঃৎু (১৯৯৯), বাংলাদেশ:জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব (২০০০), ওংংঁবং ড়ভ এড়াবৎহধহপব রহ ইধহমষধফবংয (২০০০), মহাপুরুষদের কথা-কাছে থেকে দেখা (২০০১), নানা দেশে নানা জাতি (২০০১), ছোট সীমানা বৃহৎ বিকাশ (২০০১), জেলায় জেলায় সরকার আইনের একটি পর্যালোচনা (২০০২), অ জরমমবফ ঊষবপঃরড়হ: অহ ওষষবমরঃরসধঃব এড়াবৎহসবহঃ (২০০২), কারচুপির নির্বাচন অবৈধ সরকার (২০০২), ঝঃধঃব খধহমঁধমব গড়াবসবহঃ রহ ঊধংঃ ইধহমধষ ১৯৪৭-১৯৫৬ (২০০৮) এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাতাশ মাস (২০০৯)। বের হয়েছে রচনা সমগ্র। বাংলা ও বাঙালির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন, ‘হিস্টরি অব বেঙ্গল’। তার ১৯ বছরের শ্রম এবং সাধনার ফসল এটি। তার মতে, ‘এটা একটি টেক্সট বুক।’ লেখক হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। ২০০০ সালে তার লেখা ‘বাংলাদেশ:জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব’ জাতীয় আর্কাইভসের বিচারে একটি সেরা গ্রন্থ হিসেবে পুরস্কার লাভ করে।
সংসদে সর্বোচ্চ ১২ বার বাজেট দেওয়া সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে। বাবা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ছিলেন তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের নেতা। আর মা সৈয়দ সাহার বানু চৌধুরী ছিলেন সিলেট মহিলা মুসলিম লীগের সহ-সভানেত্রী। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মের কারণে শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত নানা কারণেই আলোচিত একজন মানুষ ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আপসহীন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। ১৯৪৯ সালে সিলেটের মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা চালায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। পাকিস্তানে কোনো হিন্দু জমিদারের নামে কলেজ হতে পারে না- এই যুুক্তিতে তারা নাম পরিবর্তনের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। সহপাঠিদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে সেই অপতৎপরতা রুখতে সক্ষম হন তিনি। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। কুখ্যাত ৯২ (ক) ধারা স্বৈরশাসন জারী হলে এই সালের জুন মাসে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে নিরাপত্তা আইনে ফেব্রুয়ারি মাসে পুনরায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নানা বাধা-বিপত্তি তার শিক্ষা জীবনে প্রতিবন্ধকতার কারণ হতে পারেনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৫ সালে ইংরেজিতে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন এমএ। ১৯৫৬ সালে তিনি সিএসপি হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। এসময় অর্থনীতি পড়ার প্রতি মনোনিবেশ করেন মুহিত। ১৯৫৭-৫৮তে অক্সফোর্ড এবং ১৯৬৪ তে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন অর্থনীতিতে ডিগ্রি। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে এবং মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের সচিব থাকার সময় বার্ষিক প্রতিবেদনে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরেন, যা পরবর্তীকালে জাতীয় পরিষদে বিতর্কের ভিত্তি হয়।
১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে বাঙালি কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মার্কিন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক লবি করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পরিকল্পনা সচিব নিযুক্ত হন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮১ সালে সচিব পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদের সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ২০ মাস দায়িত্ব পালনের পর এরশাদ সরকারের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে মন্ত্রী পদ থেকে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি নীতির খাতিরে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দেন এবং প্রবাসে চলে যান। এ সময় তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উড্রো উইলসন স্কুলে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।
দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা চালু হলে তিনি ফিরে আসেন এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পাশাপাশি তিনি পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে ব্রতী হন। নবম সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে অংশ নিয়ে জয়ী হন প্রয়াত মুহিত। মহাজোট সরকার গঠন করলে লাভ করেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। দশম নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুনরায় একই পদে আসীন হন। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে পালন করেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব।
লেখক সত্তার পাশাপাশি দেশের শিল্প, সংস্কৃতি অঙ্গনেও তিনি ছিলেন বিশেষভাবে সমাদৃত একজন মানুষ। রাজধানীর যেকোনও সাংস্কৃতিক বা বিদ্বজনের অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত দর্শকসারিতে, এর ব্যত্যয় ঘটেনি মন্ত্রী হওয়ার পরও। তিনি কখনো জনবিচ্ছিন্ন থাকতে চান নি। জনমানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন সব সময়। জন্মমাটির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। মন্ত্রী থাকাকালে কথা দিয়েছিলেন, প্রতি মাসে একবার সিলেটে আসবেন। সেই কথা তিনি রেখেছিলেন। জীবন সায়াহ্নেও তিনি ছুটে এসেছেন সিলেটে। সবশেষ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর সিলেটে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে গত ১৪ মার্চ তাকে নিজের শহরে নিয়ে আসা হয়। তার ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে ঘুরিয়ে দেখানো হয় প্রিয় স্থানগুলো। ১৬ মার্চ সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ‘আজীবন সুকীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ’ আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ‘গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননা’ দেওয়া হয়। নগরের সুরমা নদীর তীরের চাঁদনীঘাট এলাকায় হয় নিজের জীবন নিয়ে আত্মতুষ্ঠির কথা বলেন তিনি। উল্লেখ করেন, “আমি একান্তভাবে সিলেটের মানুষ। আমার জন্মভূমি আমার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে এটার চেয়ে বড় প্রাপ্তি তো আর কিছু হতে পারে না।” সত্যিই তাই। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারেনা। তাকে গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননা দিয়ে সিলেটবাসীও হয়েছে সম্মানিত। আর তিনি হয়েছেন তৃপ্ত। জন্মমাটির মানুষের ভালোবাসা নিয়েই মুহিত পারি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। কয়জনের হয়, এমন ভাগ্য?
তার অন্তিম ইচ্ছা ছিল সিলেটের মাটিতেই যেন সমাধি হয়। মুহিতের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটলো একটি অধ্যায়ের, একটি যুগের। কিন্তু তিনি যে আলোকপ্রভা জ্বেলে গেছেন আমাদের মনে এবং মননে তা প্রজ্জ্বলিত থাকবে অনেক অনেক কাল।
অপূর্ব শর্মা : লেখক, সাংবাদিক