নিজস্ব প্রতিবেদক : বিলুপ্তির পথে আছে প্রায় ৪১ প্রজাতির দেশি মাছ। এর নেপথ্যে পাওয়া গেছে ১৫টি কারণ। যে মাছগুলোর দেশি জাত এখন আর দেখাই যায় না সেই তালিকায় রয়েছে—মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, টেংরা, পুঁটি, ডারকা, মলা, ঢেলা, পোয়া, বালিয়া, উপর চকুয়া, কাকিলা, চেলা, শাল চোপরা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভেদা, বুড়াল, বাইম, খলিসা, ফলি, চেং, টাকি, চিতল ও গতাসহ আরও কিছু জাত। গ্রামীণ কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে উজাড় হয়ে যাচ্ছে এগুলো।
যেসব গ্রামে এক সময় পৌষ-মাঘে পুকুর, খাল, ডোবায় দেশি মাছ ধরার ধুম পড়তো, সেসব গ্রামে আজ দেশি মাছের দেখা নেই বললেই চলে। ইদানীং বিভিন্ন নদী, পুকুর ও হাওরে মাছ মরে ভেসে ওঠার খবর আসছে। বিভিন্ন কারণে মারা যাচ্ছে দেশি জাত। দেশি জাত হারিয়ে যাওয়ার ১৫টি কারণ জানা গেছে মৎস্য বিভাগ সূত্রে- ১। জলবায়ুর প্রভাব ২। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ৩। কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার ৪। ফসলের জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার ৫। জলাশয় দূষণ ৬। নদীর নব্যতা হ্রাস ৭। উজানে বাঁধ নির্মাণ ৮। নদী সংশ্লিষ্ট খাল ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া ৯। ডোবা ও জলাশয় ভরাট হওয়া ১০। মা মাছের আবাসস্থলের অভাব ১১। মা মাছের ডিম ছাড়ার আগেই ধরে ফেলা ১২। ডোবা-নালা পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা ১৩। বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ ১৪। মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো, এবং ১৫। খালে, বিলে ও পুকুরে নদীতে বিষাক্ত বর্জ ফেলা।
বর্ষায় ধানি জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার ঐতিহ্যও হারিয়ে গেছে। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিলে মাছ ধরতো তাদের অনেকেই এখন বাজার ছাড়া মাছের দেখা পান না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় হাওরে মাছ মরে ভেসে উঠছে। নদী, পুকুর, খালেও মাছ মরছে। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক সময় ক্ষেতের ধান গাছ পচে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হয়েও মাছ মারা যায়। গ্যাসের কারণে হাওরের পানিতে অক্সিজেন কমে যায়। এ কারণেই মূলত হাওরের মাছ মরছে বেশি। অবশ্য হাওর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যামোনিয়া গ্যাসের কারণে মাছ মরে না। মরে অন্য কারণে। কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন আছে। প্রাথমিকভাবে চুন ছিটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যেতে পারে বলেও জানান গবেষকরা।
এ বিষয়ে দেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর সালাউদ্দিন মুফতি জানান, ২০ বছর আগেও গ্রামের বাড়ির দুটি পুকুর থেকে সারা বছর মাছ পেতাম। ঝাঁকি জাল ও বড়শি দিয়ে শোল, টাকি, চেলা, পুঁটি পাওয়া যেতো। শীত মৌসুমে পুকুরের পানি কমে গেলে অনেক লোক নেমে পানি ঘোলা করা হতো। তখন মাছ ভেসে উঠলে সহজে ধরা হতো। জাল, ডালা, খুচন নিয়ে মাছ ধরতে নামতো সবাই। ধরা পড়তো শোল, গজার, টাকি, চিংড়ি, টেংরা, পাবদা, ফলি, বায়লা, চান্দা, তারাবাইম, আইড়, বোয়াল, চেলা, পুঁটি সবই ধরা পড়তো। এখন পুকুরের গভীরতা কমেছে। কমেছে পানি। এত এত মাছও নেই। মাঝে মাঝে কিছু চেলা, পুঁটি, বেলের চেহারা দেখা যায়।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির সোহাগদল গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ‘মিয়ারহাট হলো এলাকার বড় মাছ বাজার। এই বাজারে সকাল থেকে রাত নানা প্রজাতির দেশি মাছে ভরা থাকতো। এখন মাছগুলো বাজারে ওঠে না। বাজারের এক কোনায় দেশি প্রজাতির মাছ দেখা যায়। চাষের মাছে সয়লাব। যেদিকে তাকাই, পাঙ্গাস আর তেলাপিয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘ধানের জমির সার ও কীটনাশক মিশে নদী ও খালের পানি নষ্ট হচ্ছে। সার ও কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় দেশি মাছ মরছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম জানিয়েছেন, ‘বিভিন্ন কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। যে মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বলে শুনছি, সেগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। পাবদা, টেংরা, বোয়াল, আইড় মাছের চাষ হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবছরই উপজেলা পর্যায়ে মৎস্য অধিদফতরের আয়োজনে মৎস্যমেলা হয়। এর উদ্দেশ্যই হচ্ছে দেশি জাতের মাছ ফিরিয়ে আনা।’
বাজারে দেশি মাছের আকাল, দামও চড়া : নদী-হাওর, খাল-বিলে মাছ ধরার ভরা মৌসুমেও বাজারে ‘দেশি’ হিসেবে পরিচিত এসব উৎস থেকে পাওয়া মাছের দাম চড়া। নিষেধাজ্ঞার পর বাজারে ইলিশ উঠেছে খুবই কম, দামও একটু বেশি। হাওরাঞ্চলে এবার কম ধরা পড়ছে বলে এ সময়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় দাম বেশি ‘দেশি’ মাছের বলে জানিয়েছেন মাছ ব্যবসায়ীরা। তবে খামার বা ঘেরে চাষ হওয়া মাছের দাম কিছুটা কম।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি মাছ বাজারে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকার পর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলেও এখনও রাজধানীর বাজারগুলোতে ইলিশ মাছ তেমন চোখে পড়েনি। বাজারে যেসব ইলিশ আছে এর দামও বেশি বলে ক্রেতারা জানিয়েছেন।
রাজধানীর মাতুয়াইলের মাছ ব্যবসায়ী জালাল মিয়া জানিয়েছেন, ‘দেশি মাছের চাহিদা অনেক। কিন্তু পাওয়া যায় না। চাষের মাছ বাজার দখল করে আছে। মানুষ তো দেশি মাছের স্বাদ-চেহারাই ভুলে গেছে। অনেকে সেগুলোর নামও জানে না।’
ঢাকার বাজারগুলোতে দেশি জাতের চিংড়ি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। টেংরা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, বোয়াল ৭৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা, কাচকি মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, আইড়, চিতল, বেলে মাছ আকারভেদে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মালিবাগ বাজারের মাছ বিক্রেতা মো. ইব্রাহিম বলেন, “আমরা দেখেছি, বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে দেশি মাছ বেশি ধরা পড়ে, বাজার ভরপুর থাকে। এবছর তার ভিন্নতা দেখছি, যে কারণে দাম কিছুটা বেশিই।”
এবার হাওরাঞ্চল থেকে আগের বছরগুলোর চেয়ে বাজারগুলোতে দেশি মাছের যোগান কম বলে জানান তিনি।
তবে দেশি মাছের চেয়ে বাজারে চাষের মাছের দাম কিছুটা কম বলে জানান মাছ ব্যবসায়ীরা। চাষের চিংড়ি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, রুই ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা, টেংরা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, পাবদা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, শিং ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রামপুরা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, “অক্টোবর-নভেম্বরের সময়টিতে আমরা আগে দেশি মাছ বেশি বিক্রি করেছি, মাছ আসতো বেশি। এবার সেই অবস্থা নাই। খাল-বিলে এখন মাছ কমে গেছে। চাষের মাছই এখন ভরসা। দেশি মাছ অল্পস্বল্প আসলেও দাম অনেক বেশি।”
মগবাজারের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম মালিবাগ বাজারে কেনাকাটা কিনতে এসেছেন। মাছ দাম-দর করার সময় বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীদের অনেকেই আছেন যারা ‘চাষের’ কোনো কোনো মাছকে ‘দেশি’ বলে বিক্রি করেন। হয়তো বহু ক্রেতা তা বুঝতেও পারেন না। রান্নার পর সেই মাছের স্বাদে বোঝা যায় যে এটা চাষের মাছ।
“দেশি মাছ তো এখন বাজারে পাওয়া দুষ্কর। সারাবছরই তো চাষের মাছে বাজার ভরপুর থাকে। কিছু দেশি মাছ পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হয়।”
এদিকে বাজারে ইলিশ মাছ কম থাকায় দামও একটু বেশি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। মাঝারি আকারের ইলিশ এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। ছোট আকারেরগুলো বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়।
রামপুরা বাজরের মাছ ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম বলেন, “আগামী সপ্তাহ থেকে হয়তো ইলিশ বাজারে বেশি পরিমাণে আসা শুরু করবে। তখন হয়তো দাম কিছুটা কমবে।”
যেসব কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি মাছ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ