নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর বিএসসি ইন নার্সিং পোস্ট বেসিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় একটি নার্সিং কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত রোববার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব বলছে, চক্রটি গত পাঁচ বছর নার্সিং পরীক্ষার একাধিক প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। এভাবে বিপুল অর্থ কামিয়েছে। চক্রের মূলহোতা ফরিদা খাতুন রাজধানীর মহাখালীর একটি নার্সিং কলেজের প্রশিক্ষক। নার্সিং কলেজের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজনকে নিয়ে প্রশ্নফাঁস চক্র গড়ে তোলেন।
গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তার অভিযুক্তরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি, মডারেটর ও ডিন থেকে নির্বাচিত প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ে নিযুক্ত গোপন টিমের সদস্য ছিলেন। এ কারণে সহজেই প্রশ্নফাঁস করত তাঁরা। কমান্ডার মঈন বলেন, ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের প্রথম বর্ষ ফাইনাল বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষা শুরুর আগেই ফাঁস হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি দল পরীক্ষা শুরুর আগে একটি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের মোবাইলে প্রশ্নপত্রের ছবি ও সাদা কাগজে হাতে লেখা প্রশ্নপত্রের ছবি উদ্ধার করে।
র্যাব প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে। রবিবার রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর অভিযানে রাজধানীর মহাখালী, ধানমন্ডি ও আজিমপুর এলাকা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূলহোতাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন- মূলহোতা ফরিদা খাতুন, মোছা. মনোয়ারা খাতুন, মোসা. নার্গিস পারভীন, মোছা. কোহিনুর বেগম, মো. ইসমাইল হোসেন ও মো. আরিফুল ইসলাম। অভিযানে উদ্ধার করা হয় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের কপি ও নয়টি মোবাইল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সর্বমোট ৯৮টি নার্সিং কলেজের মধ্যে বর্তমানে ৩৮টি কলেজে পরীক্ষা চলমান। প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন প্রশ্ন প্রণয়নকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা দুই সেট আলাদা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেন। পরবর্তীতে এই প্রশ্নপত্রগুলোকে যাচাই-বাচাই করার জন্য একটি মডারেটর টিম নিয়োগ করা হয়। যাদের কাজ হচ্ছে প্রশ্নপত্রগুলো থেকে পরীক্ষার জন্য একসেট পরিপূর্ণ প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেগুলো সিলগালার মাধ্যমে চিকিৎসা অনুষদের ডিনের কাছে জমা দেওয়া। পরবর্তীতে চিকিৎসা অনুষদের ডিন বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য ৪ সদস্যদের একটি গোপনীয় টিম নিয়োগ করেন। যারা নির্বাচিত প্রশ্নপত্রটি প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ে নিযুক্ত থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রশ্নপত্রগুলো প্রিন্ট করে আলাদা আলাদা প্যাকিং করে তার উপরে কেন্দ্রের নাম লিখে সিলগালা করে দেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই প্রশ্নপত্রগুলো বিভিন্ন কেন্দ্রে বিতরণ করেন।
গ্রেপ্তার আসামিরা কে কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত: চক্রের মূলহোতা ফরিদা খাতুন। তিনি রাজধানী মহাখালীর একটি নার্সিং কলেজের প্রশিক্ষক। প্রায় ১০ বছর তিনি ধরে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ের দায়িত্বে থাকেন। চক্রের গ্রেপ্তার অন্য সদস্য নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম তার অন্যতম সহযোগী। তারা পরস্পর যোগসাজসে বেশ কিছুদিন ধরে শিক্ষকতার আড়ালে ওই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন। গ্রেপ্তার ফরিদা খাতুন ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় চিকিৎসা অনুষদের ডিন থেকে নির্বাচিত চার সদস্যদের গোপনীয় টিমের একজন সদস্য ছিলেন। ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম ফরিদা খাতুনের কাছে ঈড়সঢ়ৎবযবহংরাব ঘঁৎংরহম ধহফ চধঃযড়ঢ়যুংরড়ষড়মু পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চাইলে ফরিদা খাতুন প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ের সময় সংগ্রহ করে রাখা প্রশ্নপত্র নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম প্রদান করে।
পরবর্তীতে তাদের এই চক্রের আরেক সদস্য প্রশ্নপত্রটি ইসমাইলের মাধ্যমে কোহিনূর বেগমের কাছে প্রদান করে। এসময় ইসমাঈল কিছু কপি নিজের কাছে রেখে অর্থের বিনিময়ে তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে সরবরাহ করে। পরবর্তীতে কোহিনূর বেগম ও আরিফ প্রশ্নপত্রটি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেন। র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ফরিদা, মনোয়ারা, নার্গিস গত প্রায় ১০ বছর ধরে একটি নার্সিং কলেজের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তারা ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজসমূহের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি, মডারেটর ও ডিন থেকে নির্বাচিত প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ে নিযুক্ত গোপন টিমের সদস্য ছিলেন। কোহিনুর বেগম ২০০৮ সাল থেকে ঢাকার একটি সরকারি নার্সিং কলেজে নার্সিং প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদেন। ইসমাঈল হোসেন রাজধানীর একটি নার্সিং কলেজের সিনিয়র ষ্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত ও আরিফ ঢাকার একটি নার্সিং কলেজের চড়ংঃ ইধংরপ ই.ঝপ রহ ঘঁৎংরহম এর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত ঈড়সঢ়ৎবযবহংরাব ঘঁৎংরহম ধহফ চধঃযড়ঢ়যুংরড়ষড়মু বিষয়ে প্রশ্নপত্রটি ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য কোহিনূর বেগমের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করে। আরিফ ২০১৭ সালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অপরাধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। যারা ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষার্থী ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, আমরা ফাঁস করা প্রশ্নে ১০ থেকে ১২ জন পরীক্ষার্থীর নাম পেয়েছি। তাদের মধ্যে ৩ থেকে ৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চলমান।
যেভাবে নার্সিং কলেজের প্রশ্ন ফাঁস করত তারা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ