নিজস্ব প্রতিবেদক : নির্মাণকাজ শেষে আগামী শুক্রবার (৮ অক্টোবর) খুলে দেওয়া হবে কর্ণফুলী নদীর নিচে সুড়ঙ্গপথ বঙ্গবন্ধু টানেলের দ্বিতীয় চ্যানেল। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে এ তথ্য জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, আগামী শুক্রবার রাতে বঙ্গবন্ধু টানেলের দ্বিতীয় চ্যানেলের মুখ খুলে দেওয়া হবে। আগেই টানেলের প্রথম চ্যানেলের মুখ খুলে দেওয়া হয়েছিল। শুক্রবার মধ্যরাতের মধ্যে দুই চ্যানেলেরই নির্মাণকাজই শেষ হবে। তিনি আরও জানান, আগামী বছরের ২২ ডিসেম্বর টানেল চালুর কথা ছিল। এখন মনে হচ্ছে এরও আগে এটা চালু করতে পারবো।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে ৩ হাজার ৫ মিটার দীর্ঘ টানেল। দেশের প্রথম টানেল প্রকল্প এটি। টানেলটি নেভাল একাডেমি পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে কাফকো ও সিইউএফএল পয়েন্টের মাঝখান দিয়ে অপর প্রান্তে যাবে। নদীর তলদেশে সর্বনি¤œ ৩৬ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ ফুট গভীরে স্থাপন করা হবে দু’টি টিউব। এছাড়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত চার লেনের ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সম্পন্ন হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এরই মধ্যে কাজের গতি বাড়ানোর জন্য বাড়তি জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কাজ এগিয়ে নিতে অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে কাজের গতি অনেকটাই বেড়েছে।
নগরীর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম টানেলটি নির্মাণ করছে সরকার। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর টানেলের বাম সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে ২০২১ সালের নভেম্বরে উভয় সড়ক এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। টানেলটি নির্মিত হলে কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, নৌ বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। জানা গেছে, চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে এই প্রকল্পের কাজ করছে। ৯ হাজার ২৯৩ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট রাস্তাসহ প্রকল্পটি দ্বিমুখী চারলেন মডেল অনুসরণ করে নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যে মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৩১৫ মিটার। ফ্লাইওভার ও সংযোগ সড়ক যথাক্রমে ৭২৭ মিটার এবং ৫ হাজার ৩৪১ মিটার। দুই টিউবের এই টানেল নির্মাণকাজ শেষ হলে ৪ লেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে।
কল্পনার পাতাল পথ : সুড়ঙ্গ পথ বা টানেলের কথা মনে হলেই কল্পনায় ভেসে ওঠে টেলিভিশনে দেখা কোনো সিনেমার দৃশ্য। যেখানে কুয়াসদৃশ দীর্ঘ গোলকের ভেতর দিয়ে খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে ট্রেন বা বাস। এই দৃশ্য দেখতাম আর অপেক্ষায় থাকতাম কতক্ষণ পর সূর্যের আলো বা সাধারণ সড়কের দেখা মিলবে। কল্পনায় এমন চিন্তাও আসত যদি পানি এসে ঢুকে পড়ে তখন কী হবে! আবার ভাবতাম কোরআন শরিফের বর্ণনায় হজরত মুসা (আ.) এর নীল নদের পানি দুভাগ করে রাস্তা হয়ে যাওয়ার কাহিনি। মুসা নবী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে উট, ঘোড়া ছুটিয়ে নদের ওপারে পৌঁছে গেছেন কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই। সিনেমার দৃশ্য বা ইতিহাসের বর্ণনায় যা-ই থাকুক বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে পানির বুক ভেদ করে নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ বা টানেল নির্মাণ হয়েছে অনেক আগেই। আমাদের দেশে এই প্রথম সেই কল্পনার পাতাল পথ বা টানেল নির্মাণ শুরু হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী টানেল। বাংলাদেশের মানুষের কাছে পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেলের মতোই কর্ণফুলী টানেল একটি স্বপ্নের মেগা প্রকল্প। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণেই সম্ভব হচ্ছে এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এই সুড়ঙ্গটি নির্মাণের ফলে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে সংযুক্ত করবে। এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। কর্ণফুলী সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য মোট ৩.৪৩ কিলোমিটার। এই টানেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। টানেলে যে দুটি টিউব বসানো হয়েছে তার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। এছাড়া টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজসম্পন্ন টানেলটি চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড় থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল, গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মূলত এসব কর্মযজ্ঞ চলছে টানেলকে ঘিরে। টানেলের বহুমুখী সুবিধা নেওয়ার অপেক্ষায় এখন সবাই। এই টানেল নির্মাণ হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটবে। টানেলে যান চলাচল শুরু হলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলোকে আর নগরে ঢুকতে হবে না। চট্টগ্রামের সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। অবশ্যই দেশের প্রথম টানেল হিসেবে কর্ণফুলী টানেলের নানামুখী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। এটি শুধু দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে না, এর মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানাসহ অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন হবে। দেশের প্রধান পর্যটন এলাকাসমূহের মধ্যে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, বান্দরবানসহ পাহাড়, সমুদ্র ও নদীর এ ত্রিমাত্রিক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সহজতর যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে টানেল মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। টানেলের নির্মাণকাজ শেষ হলে ৪ লেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। পশ্চিম পাশে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপিত হবে। এতে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে। পূর্ব দিকের শিল্প-কারখানার কাঁচামাল, প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হবে। মূলত মিয়ানমার হয়ে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তিসহ ৭টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই এই টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এগিয়ে যাক দেশ উন্নয়নের হাত ধরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে যান চলাচলের অপেক্ষা নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে নির্মাণকাজ শেষ হোক- এটাই প্রত্যাশা।
যুগান্তকারী প্রকল্পের বঙ্গবন্ধু টানেল খুলে দেওয়া হবে শুক্রবার মধ্যরাতে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ