প্রত্যাশা ডেস্ক : পশ্চিমারা ‘মানুষ ও পশুর মধ্যে বিয়ে বৈধ’ করছে। ইউক্রেনের নেতারা ‘হিটলারের’ মতোই খারাপ এবং দেশটির জাতীয়তাবাদীরা ‘অমানবিক’। এমনটাই মনে করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একান্ত বলয়ে থাকা দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। পুতিনের পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাদের। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর মতো বিষয় সামনে এলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার টেবিলে থাকতে পারেন এই কর্মকর্তারা।
গত বছর রাশিয়ান সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রভাবশালী এই ব্যক্তিদের জন্ম মূলত ১৯৫০-এর দশকের কাছাকাছি সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। আর ১৯৫২ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে জন্মগ্রহণ করেন ভ্লাদিমির পুতিন। এই কট্টরপন্থী উপদেষ্টারা খোদ পুতিনের চেয়েও আরও বেশি প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান তৈরি করেছেন।
পুতিনের একটি আদর্শ গড়ে তুলতে পশ্চিমাদের শত্রু হিসেবে, ইউক্রেনকে হুমকি হিসেবে এবং রাশিয়াকে ‘প্রথাগত মূল্যবোধের’ ধারক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। মস্কোর একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক কনস্ট্যান্টিন রেমচুকভ। তার ভাষায়, ‘এটি সম্মিলিতভাবে একটি পাল্টা-মতাদর্শ গঠনের প্রচেষ্টা। যেহেতু পুতিনের সেভাবে কোনও আদর্শ নেই।’ তিনি এটিকে রাশিয়ার শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ‘রক্ষণশীল-প্রতিক্রিয়াশীল’ বিশ্বদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, এর মূল ধারণাটি হলো, ‘সবাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে।’
ইউক্রেন চলমান উত্তেজনায় পুতিন এখন পর্যন্ত সরাসরি মুখ খোলেননি। প্রায় প্রতিদিনই ক্যামেরার সামনে হাজির হলেও গত ডিসেম্বর থেকে বেশিরভাগ সময়ই ইউক্রেন ইস্যুতে প্রকাশ্য মন্তব্য এড়িয়ে গেছেন তিনি। এটি পুতিনের বিশ্বস্ত উপদেষ্টাদের প্রতি সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ পুতিনের চিন্তাভাবনার বিষয়ে সূত্র পেতে তারাই এখন মূল ভরসা। পুতিনের সঙ্গে এই উপদেষ্টাদের কারও কারও প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল তিনি যখন কেজিবি-তে কর্মরত ছিলেন সেই সময়ে। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে খুন, সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি, নৃশংস যুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। ক্রেমলিনকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে এসব অভিযোগেরও ভূমিকা রয়েছে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ‘সিলোভিকি’ নামে পরিচিত ক্ষমতাবানদের হাতে। এই তালিকায় রুশ প্রেসিডেন্টের প্রধান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন নিকোলাই পাত্রুশেভ, বৈদেশিক গোয়েন্দা প্রধান সের্গেই নারিশকিন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই কে শোইগু এবং কেজিবিতে পুতিনের সঙ্গে কাজ করা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা প্রধান আলেকজান্ডার বোর্টনিকভের মতো ব্যক্তিরা রয়েছেন। এই ব্যক্তিদের আধিপত্য নিরাপত্তার বিষয়ের বাইরেও প্রসারিত। পাত্রুশেভ রাশিয়ার ভলিবল ফেডারেশনের প্রধান। তার ছেলে কৃষিমন্ত্রী। নারিশকিন রাশিয়ান হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির দেখভাল করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের অতীতকে গৌরবান্বিত করার দায়িত্ব তার। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগু রাশিয়ান জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি হিসেবে পুতিনের ব্যক্তিগত আগ্রহকে গুরুত্ব দেন। তিনি পুতিনকে নিয়মিত ছুটিগুলোতে সাইবেরিয়ার বনে নিয়ে যান। গত মাসে রাশিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়াল ইন্টারন্যাশনালকে সোভিয়েত গোপন পুলিশের অপরাধ উন্মোচন করতে গিয়ে দেশটির নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। এ ঘটনা সিলোভিকির মতামতের প্রতি পুতিনের আরও ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত দেয়।
২০১৮ সালে মস্কোর মেয়র পদে পুনঃনির্বাচনের প্রচারণায় পুতিনের সাবেক চিফ অব স্টাফের পক্ষে প্রচারণা চালানো ব্যক্তিদের একজন সাংবাদিক রেমচুকভ। তার ভাষায়, ‘এই লোকগুলো রক্ষণশীল মৌলবাদী।’ তিনি বলেন, ‘এটি হয়তো একটি রক্ষণশীল কেন্দ্র। তবে এর কেন্দ্রে রয়েছেন পুতিন।’
পশ্চিমের ‘বিদেশি’ মূল্যবোধের বর্ণনা দিয়ে সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে পাত্রুশেভ বলেছিলেন, ‘বাবা ও মাকে অভিভাবক নম্বর এক ও দুই দিয়ে নামকরণ করা হচ্ছে। তারা শিশুদের নিজেদের লিঙ্গ নির্ধারণের অধিকার দিতে চায়। কিছু জায়গায় তারা পশুদের সঙ্গে বিয়ে বৈধ করার পর্যায়ে পৌঁছেছে।’
মাসখানেক পর এক অনুষ্ঠানে এই ‘অভিভাবক নম্বর এক ও দুই’-এর বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করেন পুতিন। তবে ‘প্রাণীর প্রতি মানুষের যৌন আকর্ষণের’ বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।
ইউক্রেনের কাছে রুশ সেনাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের আদর্শের আরেকটি উপাদান বড় আকার ধারণ করে। সেটি হচ্ছে সোভিয়েত অতীতের গৌরব। পাত্রুশেভের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ‘পশ্চিমা নিওলিবারেল এলিটদের হাত সম্পূর্ণভাবে খুলে দিয়েছে।’ তিনি ও তার সহকর্মীরা রাশিয়াকে পশ্চিমের বিরুদ্ধে লড়াই করে সেই মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য নির্ধারণ করেছেন।
কার্নেগি মস্কো সেন্টার থিঙ্ক ট্যাংকের একজন সিনিয়র ফেলো আন্দ্রেই কোলেসনিকভ। তিনি বলেন, ‘এটি রাশিয়ান জাতীয়তাবাদের অন্ধকারতম স্রোতগুলোর মধ্যে একটি, সাম্রাজ্যবাদ যা বহুগুণ বাড়িয়েছে।’ তার মতে, রাশিয়ার নিরাপত্তা এলিটদের লক্ষ্য হচ্ছে ‘সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার’।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কর্মকর্তাদের জন্য পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা বৃদ্ধি একটি ভালো জিনিস। কেননা এতে করে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে তাদের প্রভাব বাড়বে। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সংস্থা আর. পলিটিক-এর প্রতিষ্ঠাতা তাতিয়ানা স্ট্যানোভায়ার মতে, সিলোভিকি সংঘাত ও নিষেধাজ্ঞাকে একেবারে পাত্তা দেয় না। এগুলো বরং তাদের জন্য আরও সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে।
যাদের পরামর্শে ‘কান ভারী’ হয় পুতিনের
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ