ড. মো. আকতারুজ্জামান : ১৯৭১ সালের পহেলা আগস্ট জর্জ হ্যারিসন এবং ওস্তাদ রবিশঙ্কর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি দাতব্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অসহায় শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। কনসার্টে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, জর্জ হ্যারিসন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ব্যাড ফিঙ্গার এবং রিঙ্গো রকস্টার ছিলেন এবং ৪০ হাজারেরও বেশি লোকের সমাগম হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অ্যালবামটি অ্যাপল ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ করে এবং ব্রিটেনে তালিকার শীর্ষে এবং আমেরিকায় ২ নম্বরে ওঠে এবং বছরের সেরা অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি পুরস্কার জিতে নেয়।
প্রায় ৫০ বছর পর বাংলাদেশ সরকার দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৬ মে ২০২২ তারিখে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের একই ভেন্যুতে ‘গোল্ডেন জুবলি বাংলাদেশ কনসার্ট’ নামে একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশ সম্প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে। এই বিশেষ অনুষ্ঠানটি শুধু বৈশ্বিক প্রচারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বর্তমান সরকারের অধীনে একটি উদীয়মান অর্থনীতি, ডিজিটালাইজেশন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল শিক্ষা এবং অন্যান্য বিভিন্ন আঙ্গিকে কীভাবে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে তা জানানোর সম্মেলন, যা একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিল।
জাতির পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘সোনার বাংলা’- একটি ক্ষুধামুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত, প্রযুক্তিনির্ভর, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ)-এর সদস্য হয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ বপন করেছিলেন এবং টেলিযোগাযোগ জগতে বাংলাদেশের সোনার দরজা খুলে দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু বিশ্বের আধুনিক টেলিযোগাযোগ ও ডাক পরিষেবা নিশ্চিত করতে বেতবুনিয়ায় একটি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন, একটি টিঅ্যান্ডটি বোর্ড প্রতিষ্ঠা এবং ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ)-এর সদস্য পদ লাভের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ অঙ্কুরিত করেন। তার সরকারের সময় অনেক দূরদর্শী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়- স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগীদের জাতীয়ভাবে ক্ষমতায়ন করা হয়, অগ্রগতি ও উন্নয়ন থমকে যায় এবং দৃশ্যত আমাদের দীর্ঘকালের লালিত স্বাধীনতা এবং এর সুফলসমূহ প্রাপ্তির একটি করুণ পরিণতি ঘটে। ১৯৯৬ সালে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয় এবং দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার বপন করা বীজ চারায় রূপান্তরিত করেছিলেন। কিন্তু তার সেই সরকারও তখন অনেক দূরদর্শী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়নি এবং পরবর্তী ৭-৮ বছরের জন্য আবারও অগ্রগতি ও উন্নয়ন থমকে যায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও ক্ষমতায় আসে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর একই দর্শন ধারণ করে বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে তাঁর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সুযোগ্য আইসিটি উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়ের দূরদর্শী নেতৃত্বে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ রূপ নিয়েছে এবং তা এখন ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশ’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন করেছে এবং একটি নিরাপদ, উন্নত ও উদ্ভাবনী দেশের মর্যাদায় পৌঁছাতে ভিশন ২০৩০, ভিশন ২০৪১, ভিশন ২০৭১ এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।
এবার চলুন গত এক দশকে বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
প্রথমত, ডিজিটাল বাংলাদেশের শক্ত ভিত্তি। গত ১৩ বছরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের ফলে সারা দেশে প্রায় প্রতিটি সেক্টরের পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিশাল আইসিটি অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) এখন ফাইবার অপটিক্যাল তারের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হচ্ছে, স্কুলগুলো এখন শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব দিয়ে সজ্জিত, হাজার হাজার ইন্টারেক্টিভ কনটেন্ট এবং ই-বুক ডিজাইন ও ডেভেলপ করা হয়েছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে, ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০৪১-এর স্মার্ট এবং উন্নত বাংলাদেশের জন্য একটি উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।
দ্বিতীয়ত, দারুণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, এমনকি কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও । ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৩২৭ ডলার বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার হয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশকে উন্নীত করার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ১৫ হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি জনগণকে সমানভাবে ক্ষমতায়ন করে একটি ধনী দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সরকারের বার্ষিক আর্থিক বাজেট আজকের ৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৪১ সালে দাঁড়াবে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। দেশের জিডিপি আজকের ২২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৪১ সালে ২.৬ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
তৃতীয়ত, কর্মক্ষম বয়সের বিশাল জনসংখ্যা ও তাদের জনশক্তিতে রূপান্তরকরণ। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম, যদিও জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম দেশ। আমাদের এখন কর্মক্ষম বয়সের লোক (১৫-৬৪ বছর) আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় অনেক বেশি রয়েছে। এটি এখন ৬৬ শতাংশ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ তা ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আবির্ভাবের ফলে অনেক চাকরি চলে যাবে সত্যি কিন্তু আরও বেশি নতুন চাকরির সৃষ্টি হবে। এ লক্ষ্যে বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য একটি উপযুক্ত ও দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের বহুমুখী প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে, যা আমাদের চলমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে আরও শক্তিশালী করবে।
চতুর্থ, ব্লেন্ডেড, অনলাইন ও ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তার। ব্লেন্ডেড লার্নিং হতে পারে সারা দেশের উচ্চ-প্রযুক্তি, নি¤œ-প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিহীন জনগণকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একটি ভালো সমাধান। ইউজিসি সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্লেন্ডড লার্নিং পলিসি ২০২১ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন এটিকে প্রাক-প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত করার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। দেশ এখন অনলাইন ডিজিটাল শিক্ষার পরবর্তী পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যে শিক্ষার ধরন হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, সবার জন্যে এবং কর্মমুখী।
পঞ্চম, ভালো অর্থনীতি, উন্নত বিনিয়োগ এবং সেরা রিটার্ন (যেমন, পদ্মা সেতু, পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল)। স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ আমাদের জন্যে মোটেই সহজ ছিল না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা এবং মিথ্যা প্রচারণা সত্ত্বেও এটি সম্ভব করেছে, যা ২০২২ সালের জুন নাগাদ চালু হবে এবং জিডিপিতে ১.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সারা দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে অথচ গত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় বিদ্যুৎ চাওয়ার অপরাধে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্পে ট্রেনগুলো শিগগিরই যাত্রী বহন শুরু করবে। ফলে আশা করা যায় ঢাকা শহরের যানজট কমবে এবং মানবসম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
ষষ্ঠ, পাবলিক সার্ভিস ডিজিটালাইজেশন। সরকার আইসিটি বিভাগ, এটুআই, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে তার পাবলিক সার্ভিসগুলোকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য উন্নত ডিজিটাল পরিষেবায় পরিণত করেছে। উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে অনলাইন ই-পাসপোর্ট, অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, মাই.গভ, ই-নথি, মুক্তপাঠ, কিশোর বাতায়ন, শিক্ষক বাতায়ন, ৩৩৩ সেবা, একপে, ডিজিটাল সেন্টার, নাইস-৩, সুরক্ষা অ্যাপ, বাংলাদেশ.গভ.বিডি, ইত্যাদি।
এছাড়া আরও অন্যান্য সাফল্যগাথার মধ্যে রয়েছে গৃহহীনদের জন্য আবাসন প্রকল্প এবং নারীর ক্ষমতায়ন। সরকার দেশের সব গৃহহীন জনসংখ্যার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মাধ্যমে ৮ লক্ষ গৃহহীন এবং নিঃস্ব পরিবার উপকৃত হবে। এটিকে দরিদ্রদের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম আবাসন প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মুজিববর্ষে এবং আমাদের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন হবে না এটাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র বার্তা। এছাড়া গত এক দশকে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ করা গেছে।
আসুন, গভীর শ্রদ্ধা আর সম্মান জানাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যার জন্য আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সম্মানিত আইসিটি উপদেষ্টাসহ সবাইকে, যারা বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পরিশেষে জর্জ হ্যারিসন, ওস্তাদ রবিশঙ্কর এবং তাদের বন্ধুদের জানাই বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা, যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ারে কনসার্ট আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন এবং অর্থ সহায়তা করেছিলেন। আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই!
লেখক: পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি।