নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নিভেনি বলে জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে এসব তথ্য জানান নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার এরশাদ হোসেন। তিনি বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনও নির্বাপণের কাজ চলমান রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা কাজ করছেন। যেসব জায়গায় আগুনের কুÐলী পাওয়া যাচ্ছে সেসব জায়গা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে তিনটার পর রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট। তারপর থেকেই কৃষি মার্কেটে আগুন লাগার প্রতিটি জায়গা সার্চ করা শুরু হয়। বিকাল সাড়ে পাঁচটা বাজলেও অনুসন্ধান কাজ চলমান ছিল। সম্পূর্ণ নির্বাপণ কারার পর বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিসের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে যে জায়গায় আগুন লেগেছে সেখানে দাহ্য পদার্থের সংখ্যা বেশি। টিন-কাঠ-পোশাক-আশাক ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন নির্বাপণে সময় লাগছে।
একের পর এক এসি বিস্ফোরণ, পানি সংকট
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুনের তীব্রতায় বিভিন্ন দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) একের পর এক বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কেটে বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ থাকায় এবং এসির বিস্ফোরণে আগুন আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া আশপাশের এলাকায় কোনও উৎস না থাকায় পানি সংকটে পড়তে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। তারপরও মার্কেটের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিস। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে যে জায়গায় আগুন লেগেছে সেখানে কাঁচা বাজার ছাড়াও পোশাক-আশাক, স্বর্ণ, জুতাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের হাজারেরও বেশি দোকান রয়েছে। সাপ্তাহিক বন্ধ হওয়ার কারণে গতকাল পুরো মার্কেট বন্ধ ছিল। আর ভোরবেলা আগুন লাগার কারণে লোকজন না থাকায় আগুন অনেকটাই দাউ দাউ করে বেড়ে যায়। আগুন লাগার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সঙ্গে যোগ দেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তিনটা ৪৩ মিনিটে আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে রাজধানী মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এলাকায় কাজ শুরু করে। আগুন নেভানোর দায়িত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিসের আরেক কর্মকর্তা বলেন, পানি সংকটের কারণে এখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়া দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও যথাসাধ্যভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এদিকে সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মার্কেটের সামনে বাড়ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ভিড়। তারা জানিয়েছেন, অনেকেরই দোকান পুরোপুরি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর যাদের দোকান এখনও অক্ষত রয়েছে, তারা চেষ্টা করছেন দোকানের মালামাল নিরাপদে বের করে আনতে।
পুড়েছে স্বপ্ন, হারিয়েছি সব
পদ্মা পাড়ের সব বিক্রি করে ঢাকা এসে একটি ভাড়া বাসায় উঠেছি। ছেলেকে একটি দোকান করে দিয়েছিলাম এই মার্কেটে। ভেবেছিলাম আবার নতুন করে পথচলার শুরু হবে। কিন্তু পাষÐ আগুন আমার স্বপ্নকে বাঁচতে দিল না। বাঁধতে দিল না ঘর। এভাবেই বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ী বাবু বৈদ্যর মা সন্ধা বৈদ্য। ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে পাঁচ শতাধিক দোকান। পুড়েছে শত শত মানুষের কষ্টে তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের দোকান। এমনই এক দোকানি বাবু বৈদ্য। পদ্মার ওপারে বাড়ি। সব কিছু বিক্রি করে পরিবারের সঙ্গে চলে এসেছেন রাজধানীর বুকে। এসেই রাজধানীর কৃষি মার্কেটে প্রায় আট থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করে দিয়েছেন দোকান। হঠাৎ ভোর রাত চারটার দিকে ফোনের শব্দে ভেঙ্গে যায় ঘুম। ফোনের ওপাশ থেকে বলতে শোনেন মার্কেটে আগুন লেগেছে। সব ফেলে দৌড়ে এসেও বাঁচাতে পারেননি কোনো কিছু। বাবু বৈদ্য বলেন, চারটার দিকে ফোন আসে। ফোন ধরতেই বলে মার্কেটে আগুন লেগেছে। শুনেই আমি দৌড়ে আসি। এসে দেখি মার্কেটে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। কিছুই বাঁচাতে পারিনি। সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন কি নিয়ে বাঁচব? তিনি বলেন, এখানে আমার দুইটি দোকান ছিল। দুইটি দোকানেই আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ গুড়া ও হলুদ গুড়া পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করতাম। আগুনের কোনো কিছুই সরাতে পারি নাই। সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। পোড়া দোকানে দাঁড়িয়ে বুক ভাঙ্গা আর্তনাদ করছিলেন বাবু বৈদ্যর মা সন্ধা বৈদ্য। তিনি বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে দোকান করে দিয়েছিলাম। সব পুড়ে শেষ হয়ে গেল। এখন কিভাবে বাঁচব? কিভাবে ধার দেনা শোধ করব? কোথায় থাকব? কি খাব? তিনি আরও বলেন, দেশ গাঁওয়ে সব বিক্রি করে ঢাকা চলে আসছি। ভাড়ার একটি বাসায় থাকি। দেশ থেকে যে টাকা আনছিলাম তা দিয়ে ছেলের দোকান করে দিয়েছিলাম। ধার দেনাও করেছি অনেক। আমার কিচ্ছু নাই সব শেষ। কান্না করতে করতে সন্ধা বৈদ্য বলেন, আমার সর্বশেষ সম্বল ছিল বাড়ির ভিটা। সেটা বিক্রি করে আমার ছেলেকে দোকানে মালামাল তুলতে টাকা হাতে তুলে দিয়েছি। আমার ছেলের দোকানটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। একটা মালও বের করতে পারি নি। আমার থাকার জায়গাটি বিক্রি করে দিয়েছিলাম স্বপ্ন দেখে। আমার সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার যা সম্বল ছিল সব শেষ। এরআগে, বৃহস্পতিবার ভোর ৩টা ৪৩ মিনিটে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুনের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। প্রথমে একটি ইউনিট এলেও মার্কেট বন্ধ থাকায় ভেতরে ঢুকতে পারেনি সদস্যরা। যে কারণে আগুন দ্রæত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার। তিনি জানান, ভোরে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ১৭ ইউনিট ও ১৩৭ জন কর্মী। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর অগ্নি নির্বাপণী সাহায্যকারী দল। এছাড়া আগুন নিয়ন্ত্রণ, উদ্ধার অভিযান ও সার্বিক শৃঙ্খলায় ঘটনাস্থলে কাজ করে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এনএসআই, স্কাউটের ভলান্টিয়ার সদস্যরা। বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে মার্কেটে ওপর থেকে পানি ছিটানো হয়।