প্রত্যাশা ডেস্ক : ওমর আলী। প্রাক্তন বেসরকারি চাকরিজীবী। কর্মজীবনের সঞ্চিত সমুদয় অর্থে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাতারকূল মেরুল খোলায় নির্মাণ করেন একটি বাড়ি। ২০০৮ সালে। রিকশা কিংবা ছোট গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যেতে পারতেন ঘরের দুয়ারে। রাজধানীর সাতারকূলে বাড়ি করার পর থেকে পরিবার নিয়ে নিজের বাড়িতে বেশ ভালোই কাটছিল দিন। কিন্তু বিপত্তি বাধে ২০১৫ সালের শেষ দিকে, যখন ওই এলাকায় প্রবেশ করে ইউনাইটেড গ্রুপের আবাসন প্রতিষ্ঠান নেপচুন ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। এরপর কৌশলে একে একে বসতি উচ্ছেদ করে গড়ে তোলে বহুতল ভবন। ওমর আলীকেও সেখান থেকে সরিয়ে দিতে পাঁয়তারা করে তারা। কিন্তু সফল না হয়ে অমানবিক কৌশলের আশ্রয় নেয় ইউনাইটেড। সরকারি রাস্তা কেটে আর ওমর আলীর বাড়ির পাশের খোলা জায়গার মাটি কেটে সেখানে বানায় স্যুয়ারেজের জলাধার। ইউনাইটেডের বহুতল ভবনের সব ময়লা পানি এসে জমা হয় সেখানে। যে বাড়ির উঠানে একসময় মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন ওমর আলী, সেখানে এখন ময়লা পানিতে টইটুম্বুর। সরকারি রাস্তা কেটে ফেলায় ওমর আলীদের চলাচলের একমাত্র অবলম্বন দীর্ঘ সাঁকো। বাড়ি থেকে বের হতে ২০০ মিটারেরও বেশি আঁকাবাঁকা বাঁশের সাঁকো পাড়ি দিতে হয় ওমর আলীর।
অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে জায়গা কৌশলে দখলে নিতে ইউনাইটেডের অমানবিকতার গল্পই উঠে এসেছে ওমর আলীর বয়ানে। ওমর আলী বলেন, ‘২০১৫ সালে ইউনাইটেড গ্রুপ এখানে এসে প্রথমে বালি ভরাট করে, তবে আমার বাড়ির সামনের জায়গা ছাড়া বাকি পুরো জায়গা উঁচু করে ভরাট করে তারা। এই জায়গা ভরাট না করায় বৃষ্টি হলে সব পানি এসে জমা হয় এখানে।’ ওমর আলীকে উচ্ছেদের এটা ছিল ইউনাইটেডের প্রথম কৌশল। সেটি ব্যর্থ হওয়ায় তারা আরও অমানবিক পন্থার আশ্রয় নেয়। ‘এরপর তারা আমার বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছয়টা বহুতল ভবন করে, সেসব ভবনের স্যুয়ারেজের পানি তারা এখানে ফেলতে শুরু করে। এর ফলে আমার বাড়ির চারদিকে ময়লা পানিতে ভরে যায়। রাস্তাঘাট সব ডুবে যায়। সরকারি যে রাস্তা আছে সেটিও ডুবে যায় ইউনাইটেডের ভবনের স্যুয়ারেজের পানিতে। এখন আমি এই ময়লা পানিতে বন্দি। ঘর থেকে পা ফেললেই ময়লা পানি। তাই দুয়ার থেকে গেইট পর্যন্ত একটু পর পর বড় পাথর আর সিমেন্টের বস্তা ফেলেছেন ওমর আলী। তাতে পা রেখে রেখে গেইটে গিয়ে সাঁকোতে ওঠেন তারা। ওমর আলী বলেন, ‘বাঁশের সাঁকো দিয়ে কোনো রকম চলাচল করছি। এখানে সরকারি রাস্তাটি যেন না হয়, সিটি করপোরেশনের লোকজনকে হাত করে সেই ব্যবস্থাও তারা (ইউনাইটেড) করে রেখেছে বলে অনেকে বলে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ বলেন, ‘বাড়ির চারদিকে ময়লা পানি আর কচুরিপানার কারণে এখানে ব্যাঙ-সাপ, পোকা-মাকড়, মশা-মাছির উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। ঘরের দেয়ালের সঙ্গে ময়লা পানি। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে ঘরের লোকজনের।’ এই দুঃসহ অবস্থা থেকে তাদের মুক্তির জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন ওমর আলী। তিনি বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, ইউনাইটেড গ্রুপ যেন তাদের ভবনের পানি অন্যত্র ফেলে এবং বন্ধ করে রাখা সরকারি রাস্তাটি যেন নির্মাণের ব্যবস্থা করে। খুব কষ্টে আছেন জানিয়ে ওমর আলীর স্ত্রী সেলিনা বেগম (৫৫) বলেন, ‘বাসা থেকে বের হতে ২০০ মিটারের বেশি সাঁকো পাড়ি দিতে হয়। রাতের বেলা এই রাস্তা পাড়ি দিতে পারি না। বর্ষাকালে আমাদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। আমরা সরকারের কাছে এ সমস্যার পরিত্রাণ চাই।’
স্থানীয় বাসিন্দা সাংবাদিক মো. সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আসতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। ওমর আলী ভাই এই বয়সে এসে পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে ও দুর্ভোগ জীবনযাপন করছেন। আমরা চাই দ্রুতই তাদের এই দুর্ভোগের নিরসন হোক।’ ওমর আলীর এই মানবেতর অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও সিটি করপোরেশনের এগিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন সাজ্জাদুল।
শুধুই কী ওমর আলী? সাতারকুলের মেরুল অঞ্চল সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু ওমর আলী নন, ইউনাইটেড গ্রুপের কারণে বিপাকে আছেন সাতারকুল, মেরুলের আরও বেশ কিছু ভুক্তভোগী। ইউনাইটেডের বিভিন্ন প্রজেক্টের মাঝখানে ও আশপাশের জায়গা ও ঘরবাড়ি ছাড়তে নিয়মিত নানা ধরনের হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। তবে ইউনাইটেডের ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি তারা। এসব অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি মঈনউদ্দিন হাসান রশিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে সংবাদমাধ্যমটি। তবে তাকে মুঠোফোনে কল ও খুদে বার্তা দিয়েও সাড়া মেলেনি।