নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী হত্যা মামলার আসামি নিয়াজুল ইসলাম খান মহানগর আওয়ামী লীগের ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি হয়েছেন।
গত শুক্রবার বিকালে নগরীর খানপুর এলাকায় বার একাডেমি স্কুলে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আর কোনো প্রার্থী না থাকায় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হন নিয়াজুল। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় ফুটপাতে হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী মিছিল বের করলে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। সেদিন প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে আলোচনায় আসেন নিয়াজুল ইসলাম খান। নিয়াজুল নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের সমর্থক বলে শহরে পরিচিতি রয়েছে। টানা তিনবারের মেয়র আইভীর ওপর হামলার মামলার আসামিকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি করায় নগরীতে সমালোচনা হচ্ছে; ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারাও। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “নিয়াজুল ইসলাম অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। সে যে মেয়র আইভীকে গুলি করার জন্য পিস্তল উঁচিয়ে তেড়ে এসেছে সেইটা সারা বিশ্ব দেখছে। তাকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি করার বিষয়টি শুধু পার্টির লোকজন না, সাধারণ পাবলিকও ভালো চোখে দেখছে না।”
“এমন একজন ব্যক্তিকে ওয়ার্ডের সভাপতি বানাইছে। এইটা পার্টির জন্য ন্যাক্কারজনক ও নিন্দনীয় ঘটনা।” নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিয়াজুলের উত্থান মধ্য আশির দশকে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। ১৯৮৮ সালে আলোচিত জোড়া খুনের (কামাল ও কালাম) মামলার আসামি হন তিনি। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শামীম ওসমান প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন। ওই সময়ই আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পান নিয়াজুল। এই সময়ে এলজিইডির ঠিকাদারী, নগরীর চাঁদমারীর বস্তি, গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ততার অভিযোগও উঠে নিয়াজুলের বিরুদ্ধে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিয়াজুলের বড় ভাই নজরুল ইসলাম সুইট র্যাবের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। ওই সরকারের আমলে একইভাবে তাদের আত্মীয় যুবদলের ক্যাডার মমিনউল্লাহ ডেভিডও নিহত হন। এ সময় নিয়াজুল দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে ফেরেন তিনি। এরপর দীর্ঘদিন ‘আলোচনার বাইরে’ থাকলেও ২০১৮ সালে নগরীর ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ফের আলোচনায় আসেন নিয়াজুল। সেদিন মেয়র আইভী ফুটপাত দখলমুক্ত করতে শান্তি মিছিল বরে করেছিলেন। ওইদিন প্রতিপক্ষের হামলায় মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংবাদিকসহ অনেকে আহত হন। ঘটনার দিন পিস্তল উঁচিয়ে তেড়ে এলে গণপিটুনির শিকার হন নিয়াজুল। পরে এ ঘটনায় হত্যাচেষ্টা ও প্রকাশ্যে গুলি চালানোর অভিযোগে নিয়াজুলকে প্রধান আসামি করে আইভী একটি মামলা করেন। আইভীর পক্ষে মামলার বাদী হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা জি এম সাত্তার। দীর্ঘ ৫ বছর পর মামলাটি তদন্ত শেষে গত বছরের ২৩ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয় পিবিআই। অভিযোগপত্রে ১২ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, জখম, ভাঙচুর ও নাশকতার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে অস্ত্র আইনের ধারা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
পিবিআইয়ের চার্জশিটে ১২ অভিযুক্তের মধ্যে প্রথম নাম নিয়াজুল ইসলামের। তাকেও অস্ত্র আইনের ধারা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই নারায়ণগঞ্জের পরিদর্শক আতাউর রহমান বলেন, “ঘটনার তদন্তে যতটুকু পাওয়া গেছে সেটাই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আসামি নিয়াজুল ইসলাম খানের কাছে থাকা অস্ত্রটির তার নামে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ছিল। ঘটনার দিন ওই অস্ত্র দিয়ে কাউকে আঘাত করা হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।”
অভিযোগপত্র থেকে অস্ত্র আইনের ধারা বাদ দিলেও সংঘর্ষের সময় নিয়াজুল প্রকাশ্যে পিস্তল প্রদর্শন করে উঁচিয়ে ধরেছেন তার প্রমাণ সেদিন ধারণ করা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে পাওয়া গেছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। যদিও পিবিআইএর জেলা কার্যালয়ের পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম জানান, ওই ঘটনার পর নিয়াজুলের ওই পিস্তলটির লাইসেন্স জেলা প্রশাসন বাতিল করে দেয়। নিয়াজুলকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করার প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী ও নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, “নিয়াজুলকে সরকারি দলের ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি বানানোর মধ্য দিয়ে একটি পক্ষ যে সন্ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করতে চায় তারই প্রমাণ হয়েছে। যে লোক প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করলো সেই লোককে সরকারি দলের সভাপতি বানানোর মধ্য দিয়ে অশনিসংকেত দেওয়া হলো।”
তবে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সভাপতি পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিল না। ‘বিতর্কিত’ হলেও নিয়াজুল ইসলামের বিপরীতে কেউ না থাকায় সে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিটিতে সেক্রেটারি পদে মোট পাঁচ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন; তবে তারা জাহাঙ্গীর আলমকে সমর্থন জানিয়ে সরে যান।
মেয়র আইভী হত্যাচেষ্টার আসামি সেই নিয়াজুল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ