ঢাকা ১১:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

মৃত্যুর সঠিক সময় বলে দিতে পারে যে ঘড়ি!

  • আপডেট সময় : ০৯:০৯:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
  • ২৫ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

প্রত্যাশা ডেস্ক: পৃথিবীতে এমন এক প্রাকৃতিক ঘড়ি রয়েছে যা কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের মৃত্যুর সঠিক সময়টি বলে দিতে পারে। এটি হলো কার্বন-১৪, একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। এই পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন নিদর্শন থেকে শুরু করে অমীমাংসিত অপরাধের রহস্য পর্যন্ত সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন।

১৯৪০ এর দশকে মার্কিন রসায়নবিদ উইলার্ড লিবি প্রথম প্রকৃতিতে কার্বন-১৪ এর অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবন্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী পরিবেশ থেকে ক্রমাগত কার্বন-১৪ গ্রহণ করে, কিন্তু মৃত্যুর পর সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ওই কার্বন-১৪ একটি নির্দিষ্ট হারে ক্ষয় হতে শুরু করে।

মৃতদেহের অবশিষ্টাংশে কতটা কার্বন-১৪ বাকি আছে তা পরিমাপ করেই মৃত্যুর সময় বের করা সম্ভব। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য লিবি ১৯৬০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান।

মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন পরমাণুকে আঘাত করলে কার্বন-১৪ তৈরি হয়। এটি অক্সিজেনের সাথে মিশে তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) গঠন করে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের সময় এই CO2 গ্রহণ করে এবং সেই উদ্ভিদ খেয়ে প্রাণী ও মানুষ তা নিজেদের শরীরে সঞ্চয় করে।

জীবন্ত অবস্থায় এই কার্বন-১৪ ক্রমাগত প্রতিস্থাপিত হতে থাকে। কিন্তু মৃত্যুর পর এই চক্র ভেঙে যায় এবং শরীরের সঞ্চিত কার্বন-১৪ ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে। এই ক্ষয়ের হার পরিমাপ করেই বিজ্ঞানীরা বস্তুটির বয়স বের করেন। এই পদ্ধতিটি প্রায় ৫০,০০০ বছর পুরনো জৈব উপাদানের বয়স নির্ণয় করতে পারে।

এই ‘কার্বন ডেটিং’ প্রযুক্তির ব্যবহার বহুমুখী। প্রত্নতত্ত্বে এর গুরুত্ব অপরিসীম; প্রাচীন ধর্মীয় পুঁথি ‘ডেড সি স্ক্রোলস’ এবং প্রায় ৪,০০০ বছর পুরনো মিশরীয় রাজার জাহাজের বয়স এই পদ্ধতিতেই নির্ণয় করা হয়েছিল। এটি ইতিহাসের ভুল ভাঙতেও সাহায্য করেছে। যেমন, ১৮২৩ সালে ওয়েলসে পাওয়া একটি মানব কঙ্কালকে ২,০০০ বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হলেও, কার্বন ডেটিং প্রমাণ করে যে এটি আসলে ৩৩,০০০ থেকে ৩৪,০০০ বছরের পুরনো।

শুধু প্রাচীন ইতিহাস নয়, আধুনিক অপরাধ সমাধানেও এটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। ১৯৭৫ সালে নিউইয়র্কে নিখোঁজ এক কিশোরীর দেহাবশেষ ১৯৯০-এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়ায় পাওয়া যায়। কার্বন ডেটিং প্রমাণ করে যে দেহটি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে মারা যাওয়া কারও। পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষায় ওই কিশোরীর পরিচয় নিশ্চিত হয়।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। হাতির দাঁত পাচার রোধে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখে, কারণ এর মাধ্যমে জানা যায় ১৯৮৯ সালের নিষেধাজ্ঞার আগে না পরে হাতিটিকে হত্যা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অনেক পাচারকারীকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এমনকি শিল্প জালিয়াতি ধরতেও এটি ব্যবহৃত হয়; একটি চিত্রকর্মকে ১৮৬৬ সালের বলে দাবি করা হলেও, পরীক্ষায় জানা যায় সেটি আসলে ১৯৮০-এর দশকে আঁকা হয়েছিল।

জলবায়ু গবেষণাতেও কার্বন ডেটিং গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন হিমবাহ এবং বাস্তুতন্ত্রের বয়স নির্ণয় করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অতীতের জলবায়ু সম্পর্কে জানতে পারেন, যা ভবিষ্যতের জলবায়ু মডেল তৈরিতে সাহায্য করে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ‘অ্যাক্সিলারেটর ম্যাস স্পেকট্রোমিটার’ নামক যন্ত্রের মাধ্যমে খুব অল্প নমুণা থেকেও কার্বন-১৪ সরাসরি পরিমাপ করতে পারেন, যা লিবির পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত। তবে এই পদ্ধতিটি এখন একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে সাধারণ কার্বন ডাই অক্সাইড মিশছে, যাতে কোনো কার্বন-১৪ নেই। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-১৪ এর আনুপাতিক হার কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে এর ফলে নতুন কোনো বস্তুর বয়সও কৃত্রিমভাবে অনেক পুরনো দেখাতে পারে, যা এই পদ্ধতির নির্ভুলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।

সূত্র: বিবিসি

ওআ/আপ্র/২৯/১০/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

মৃত্যুর সঠিক সময় বলে দিতে পারে যে ঘড়ি!

আপডেট সময় : ০৯:০৯:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: পৃথিবীতে এমন এক প্রাকৃতিক ঘড়ি রয়েছে যা কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের মৃত্যুর সঠিক সময়টি বলে দিতে পারে। এটি হলো কার্বন-১৪, একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। এই পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন নিদর্শন থেকে শুরু করে অমীমাংসিত অপরাধের রহস্য পর্যন্ত সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন।

১৯৪০ এর দশকে মার্কিন রসায়নবিদ উইলার্ড লিবি প্রথম প্রকৃতিতে কার্বন-১৪ এর অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবন্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী পরিবেশ থেকে ক্রমাগত কার্বন-১৪ গ্রহণ করে, কিন্তু মৃত্যুর পর সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ওই কার্বন-১৪ একটি নির্দিষ্ট হারে ক্ষয় হতে শুরু করে।

মৃতদেহের অবশিষ্টাংশে কতটা কার্বন-১৪ বাকি আছে তা পরিমাপ করেই মৃত্যুর সময় বের করা সম্ভব। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য লিবি ১৯৬০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান।

মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন পরমাণুকে আঘাত করলে কার্বন-১৪ তৈরি হয়। এটি অক্সিজেনের সাথে মিশে তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) গঠন করে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের সময় এই CO2 গ্রহণ করে এবং সেই উদ্ভিদ খেয়ে প্রাণী ও মানুষ তা নিজেদের শরীরে সঞ্চয় করে।

জীবন্ত অবস্থায় এই কার্বন-১৪ ক্রমাগত প্রতিস্থাপিত হতে থাকে। কিন্তু মৃত্যুর পর এই চক্র ভেঙে যায় এবং শরীরের সঞ্চিত কার্বন-১৪ ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে। এই ক্ষয়ের হার পরিমাপ করেই বিজ্ঞানীরা বস্তুটির বয়স বের করেন। এই পদ্ধতিটি প্রায় ৫০,০০০ বছর পুরনো জৈব উপাদানের বয়স নির্ণয় করতে পারে।

এই ‘কার্বন ডেটিং’ প্রযুক্তির ব্যবহার বহুমুখী। প্রত্নতত্ত্বে এর গুরুত্ব অপরিসীম; প্রাচীন ধর্মীয় পুঁথি ‘ডেড সি স্ক্রোলস’ এবং প্রায় ৪,০০০ বছর পুরনো মিশরীয় রাজার জাহাজের বয়স এই পদ্ধতিতেই নির্ণয় করা হয়েছিল। এটি ইতিহাসের ভুল ভাঙতেও সাহায্য করেছে। যেমন, ১৮২৩ সালে ওয়েলসে পাওয়া একটি মানব কঙ্কালকে ২,০০০ বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হলেও, কার্বন ডেটিং প্রমাণ করে যে এটি আসলে ৩৩,০০০ থেকে ৩৪,০০০ বছরের পুরনো।

শুধু প্রাচীন ইতিহাস নয়, আধুনিক অপরাধ সমাধানেও এটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। ১৯৭৫ সালে নিউইয়র্কে নিখোঁজ এক কিশোরীর দেহাবশেষ ১৯৯০-এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়ায় পাওয়া যায়। কার্বন ডেটিং প্রমাণ করে যে দেহটি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে মারা যাওয়া কারও। পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষায় ওই কিশোরীর পরিচয় নিশ্চিত হয়।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। হাতির দাঁত পাচার রোধে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখে, কারণ এর মাধ্যমে জানা যায় ১৯৮৯ সালের নিষেধাজ্ঞার আগে না পরে হাতিটিকে হত্যা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অনেক পাচারকারীকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এমনকি শিল্প জালিয়াতি ধরতেও এটি ব্যবহৃত হয়; একটি চিত্রকর্মকে ১৮৬৬ সালের বলে দাবি করা হলেও, পরীক্ষায় জানা যায় সেটি আসলে ১৯৮০-এর দশকে আঁকা হয়েছিল।

জলবায়ু গবেষণাতেও কার্বন ডেটিং গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন হিমবাহ এবং বাস্তুতন্ত্রের বয়স নির্ণয় করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অতীতের জলবায়ু সম্পর্কে জানতে পারেন, যা ভবিষ্যতের জলবায়ু মডেল তৈরিতে সাহায্য করে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ‘অ্যাক্সিলারেটর ম্যাস স্পেকট্রোমিটার’ নামক যন্ত্রের মাধ্যমে খুব অল্প নমুণা থেকেও কার্বন-১৪ সরাসরি পরিমাপ করতে পারেন, যা লিবির পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত। তবে এই পদ্ধতিটি এখন একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে সাধারণ কার্বন ডাই অক্সাইড মিশছে, যাতে কোনো কার্বন-১৪ নেই। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-১৪ এর আনুপাতিক হার কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে এর ফলে নতুন কোনো বস্তুর বয়সও কৃত্রিমভাবে অনেক পুরনো দেখাতে পারে, যা এই পদ্ধতির নির্ভুলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।

সূত্র: বিবিসি

ওআ/আপ্র/২৯/১০/২০২৫