বিশেষ সংবাদদাতা : সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে ব্রয়লারের দাম। সোনালি, লেয়ার, দেশি মুরগির দামও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। সাধারণ মানুষের পাত থেকে হারাতে বসছে প্রয়োজনীয় এ আমিষ। ভোক্তা অধিকার বলছে, ব্রয়লারের দাম ২৯০ টাকা কেজি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। খামারি ও করপোরেট পর্যায়ের খরচ বিবেচনায় সর্বোচ্চ ২০০ টাকা কেজি হতে পারে। পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও করপোরেট কারসাজিতেই মুরগির দামে এ আগুন। জানা যায়, সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি আমলে নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, দেড় থেকে দুই মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম হয়েছে দ্বিগুণ। এ দাম অযৌক্তিক। কারণ, খাবারসহ অন্য ব্যয় বাড়ার পরও এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ করপোরেট প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে খরচ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তাদের প্রশ্ন, মুরগির অযৌক্তিক দাম কার্যকর করছে কারা। কারা সমন্বয় করে সারা দেশের মুরগির ব্যবসায়ীদের। কার ইশারায় চলছে বাজার। আর কোথায় যাচ্ছে মানুষের পকেট কেটে লুটে নেওয়া বাড়তি হাজার হাজার কোটি টাকা! কথা হয় বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, মুরগির বাজারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করেছে। ব্রয়লার মুরগির এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয় এক অদৃশ্য এসএমএসের মাধ্যমে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন মেসেজের মাধ্যমে মুরগি, ডিম, বাচ্চা ও খাবারের দাম নির্ধারণ করে। রাতে সারা দেশ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারে মুরগি আসে। কাপ্তানবাজার, কারওয়ান বাজারের মতো এসব বাজারে করপোরেট কোম্পানির লোক থাকে। যারা বাজারের সরবরাহ ও চাহিদা সম্পর্কে কোম্পানিকে জানায়। এরপর সকালে কোম্পানিগুলো মুরগি ও ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে দেশের বিভিন্ন বাজারে এসএমএস পাঠায়। সে সময় তারা তাদের মুরগি (করপোরেট কোম্পানি ও তাদের চুক্তিবদ্ধ খামারের উৎপাদিত মুরগি) লাভজনক করতে বাজারের দর ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করে।’ সুমন হাওলাদার বলেন, এ বাজারে প্রান্তিক খামারি ও করপোরেট কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। তাই যখন প্রান্তিক খামারিদের হাতে মুরগি থাকে, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দাম কমিয়ে দেয়। এরপর লোকসানে প্রান্তিক খামারিরা মুরগি উৎপাদন কমিয়ে দিলে সরবরাহ তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন প্রান্তিক খামারির হাতে পণ্য থাকে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এমন দোষারোপ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ সবশেষ গত অক্টোবরে যখন মুরগির বাজার অস্থিতিশীল হয়েছিল, তখন এমন প্রমাণ পেয়েছে ভোক্তা অধিকারও। সে সময় মুরগির বাজারে অস্থিরতার জন্য কাজী ফার্মস গ্রুপ, সাগুনা ফুড অ্যান্ড ফিডস, আলাল পোল্ট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, নারিশ পোল্ট্রি, প্যারাগন পোল্ট্রি এবং সিপি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এছাড়া ওই সময় কাজী ফার্মের সাভারের ডিপোতে মেসেজের মাধ্যমে বাজারে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টির প্রমাণ মেলে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে বারবার বলছি, বাজার সিন্ডিকেটকারীদের দ্রুত কার্যকর শাস্তির আওতায় আনুন। কিন্তু সেটা কখনো কোথাও দৃশ্যমান হচ্ছে না। যদি অপরাধ করে অপরাধী শাস্তি না পায়, তাহলে তাদের সাহস বেড়ে যায়। এটাই সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাজারেও সেটা হচ্ছে। তিনি বলেন, ভোক্তাদের স্বার্থে প্রতিযোগিতা কমিশন দীর্ঘসময় কিছুই করেনি। প্রথমে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কিন্তু সময়মতো মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনো।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, যে মামলাগুলো হয়েছিল, সেটার কার্যক্রম এখনো চলমান। মামলার কতগুলো গ্যাপ আছে। যেমন মামলা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট চেয়েছি। তারা সাবমিট করেছে। এরপর কমিশন থেকে বলা হয়েছে, এটা সরেজমিনে তদন্ত করা হবে। এ তদন্ত চলমান। প্রায় শেষের পথে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, এখন প্রান্তিক খামারিদের কাছে মুরগি নেই। মুরগির বাজারের দুই-তৃতীয়াংশ সরবরাহ হচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তিবদ্ধ খামারিদের মাধ্যমে। সংগঠনটি বলছে, দেশের প্রান্তিক খামারিরা মুরগি ও ডিমের দাম না পেয়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছে। এক লাখ ৬০ হাজার খামারের মধ্যে চালু আছে ৬০ হাজার। তারপরও সব খামারে মুরগি নেই। সরাসরি মুরগি উৎপাদনে করপোরেট কোম্পানিগুলোর শেয়ার রয়েছে ২০-২৫ শতাংশ। তবে বাচ্চা, ফিড ও অন্য উপকরণ তাদের শতভাগ দখলে। এসব উপকরণ ব্যবহার করে যখন তারা মাংস ও ডিম উৎপাদনে যাচ্ছে, তখন সাধারণ খামারিরা টিকতে পারছে না। এর মধ্যে আবার করপোরেট কোম্পানিগুলো বন্ধ হওয়া খামারে কম মূল্যে ফিড ও বাচ্চা দিয়ে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করছে। সেজন্য নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে তাদের হাতে বলে দাবি করছেন খামারিরা। স্বতন্ত্র খামারিদের অভিযোগ, কন্ট্রাক্টে না গেলে তাদের কাছে খাবার, বাচ্চা বা ওষুধ বাড়তি দামে বিক্রি করা হয়। কয়েকজন খামারি জানান, কন্ট্রাক্টে প্রতিটি বাচ্চা এখন ৩৫ টাকা দর ধরা হচ্ছে, যেখানে স্বতন্ত্র খামারিদের জন্য প্রতিটি বাচ্চার দাম রাখা হয় ৬৫ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে খাবারের দাম কন্ট্রাক্টে দুই হাজার ৬শ টাকা ধরা হলেও সাধারণ খামারিরা কিনছেন তিন হাজার ৪শ থেকে তিন হাজার ৭৫০ টাকায়।
মুরগির দামে কর্পোরেটদের থাবা
জনপ্রিয় সংবাদ