ক্রীড়া ডেস্ক : কোনো বল অল্পের জন্য ব্যাটের কানা স্পর্শ করল না, কোনোটি একটুর জন্য ছুঁয়ে গেল না স্টাম্প। উইকেট যদিও পড়ল না, তবে লোকেশ রাহুল ও শুবমান গিলের কঠিন পরীক্ষাই নিলেন তাসকিন আহমেদ আর সাকিব আল হাসান। দিনটা তাই স্বস্তিতেই শেষ করার কথা বাংলাদেশ দলের। কিন্তু এটুকু তো স্রেফ বিকেলে খ- চিত্র। দিনের বাকিটুকু হতাশার গল্প। ব্যাটিংয়ে দলের সর্বনাশ হয়ে গেছে তো আগেই! টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ ২২৭ রানেই। প্রথম ইনিংসে এত অল্পতে গুটিয়ে যাওয়া মানে, ম্যাচে ভালো কিছুর সম্ভাবনা চোটাক্রান্ত শুরুতেই। আগের টেস্টে ১৫০ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর এই ম্যাচের আবহ সঙ্গীতে ছিল প্রথম ইনিংসে ভালো করার তাগিদ। অন্তত ৩৫০-৩৮০ রান করার লক্ষ্য। কিন্তু মাঠে নেমে ব্যাটসম্যানদের একের পর এক আত্মঘাতী শটে বোঝা কঠিন, আদতে কতটা তাড়না তাদের ছিল। এই ২২৭ রানও এলো এমন একজনের সৌজন্যে, এই টেস্টে যার খেলাটাই বড় বিস্ময়। নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে থাকা মুমিনুল হক এই ম্যাচে আবার সুযোগ পাবেন, কজনই বা ভাবতে পেরেছিলেন! কোথাও রান পাচ্ছিলেন না তিনি। ব্যাটিংয়ে ছিল না আত্মবিশ্বাসের ছিটেফোঁটা। কিন্তু হুট করেই তাকে নামিয়ে দেওয়া হলো তাকে। এর চেয়েও বড় চমক দিলেন তিনি নিজে। দারুণ ব্যাটিংয়ে ৮৪ রানের ইনিংসে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান জানিয়ে দিলেন ফেরার বার্তা। তবে ব্যাটিং লাইন আপের সামগ্রিক ব্যর্থতা তাতে আড়াল হচ্ছে না। উইকেট খুব সহজ ছিল না অবশ্যই। হালকা সবুজের ছোঁয়া থাকা পিচে সিম করেছে বল, স্পিনে টার্ন ও বাউন্স ছিল। তবে পেসারদের জন্য সহায়তা খুব বেশি ছিল না। অথচ ভারতের পেসার উমেশ যাদব নিয়েছেন চার উইকেট, ১২ বছর পর টেস্টে ফেরা বাঁহাতি পেসার জয়দেব উনাদকাট দুটি।
অবশ্য ‘তারা নিয়েছেন’ বলার চেয়ে বলা ভালো ‘ব্যাটসম্যানরা দিয়েছেন।’ এক্ষেত্রে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন বলা চলে সাকিব আল হাসান। চার নম্বরে নেমে বেশ ছটফটে ব্যাটিংয়ে প্রথম সেশন পার করে দিতে পারলেও লাঞ্চের পর প্রথম বলেই উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হন বাংলাদেশ অধিনায়ক। বোলার উমেশ ও ভারতের অন্যরা হাসতে থাকেন এমন অপ্রত্যাশিত উপহারে। অথচ টস জিতে ব্যাটিং নিয়ে অধিনায়ক নিজে বলেছিলেন, প্রথম দুই ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারলে এই উইকেটে তাদের ভালো করা উচিত। ততটা না পারলেও প্রথম ঘণ্টা পার করে দেন দুই ওপেনার জাকির হাসান ও নাজমুল হোসেন শান্ত। খুব নিরাপদ কিংবা আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিং অবশ্য করতে পারেননি দুজনের কেউ। মোহাম্মদ সিরাজের বলে শান্তর প্রথম ওভারের বাউন্ডারিতে শুরু হয় ম্যাচ। কিন্তু দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই জীবন পান জাকির। লেগ স্টাম্পে থাকা বল উড়িয়ে মেরে ক্যাচ তুলে দেন আগের টেস্টে অভিষেকে সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান। কিন্তু ফাইন লেগে ডাইভ দিয়ে হাতে জমাতে ব্যর্থ হন সিরাজ। কয়েকবার একটুর জন্য রক্ষা পেয়ে আর দু-একটি ভালো শট মিলিয়ে ১৪ ওভার পার করে দেন দুজন। কঠিন কাজটুকু করার পর যখন ভিতটা কাজে লাগানোর পালা, তখন থেকে উল্টো পথে হাঁটার শুরু। আগের টেস্টে সেঞ্চুরি করা জাকির বিদায় নেন সবার আগে। জয়দেব উনাদকাটের একটু বাড়তি লাফানো বলে তিনি কী করতে চাইছিলেন, নিজেও হয়তো জানেন না ঠিকমতো।
সেই ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট অভিষেক উনাদকাটের। সেই টেস্টে উইকেট পাননি। ১২ বছর পর দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমে তিনি পেলেন প্রথম টেস্ট উইকেটের স্বাদ। শান্ত বিদায় নেন পরের ওভারেই। যদিও অশ্বিনের বলে সেই আউটটি না দিলেও পারতেন আম্পায়ার। আগের টেস্টে তিন নস্বরে খেলা ইয়াসির আলির জায়গায় সুযোগ পেয়ে মুমিনুল নামেন তিনেই। তবে চমক উপহার দিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ারে মাত্র পঞ্চমবারের মতো সাকিবে খেলেন চারে। উইকেটে যাওয়ার পরপরই অশ্বিনকে কাভার ড্রাইভে চার মেরে মুমিনুল এগোতে থাকেন সাবলিলভাবেই। তবে সাকিব শুরু থেকেই ছিলেন অস্থির। অশ্বিনের ওভারে চারের পর ছক্কা মারেন একটু ঝুঁকিপূর্ণ শটে। বেশ কয়েকবার বিপাকে পড়েও বেঁচে যান। লাঞ্চের ঠিক আগের ওভারে জীবন পান অশ্বিনের বলে রিশাভ পান্ত স্টাম্পিং করতে না পারায়। তার পরও সাবধান হননি। লাঞ্চের পর ওই বিস্ময়কর শটে সমাপ্তি তার ইনিংসের। মিডল অর্ডারে মুশফিকুর রহিম ও লিটন কুমার দাসের গল্পটা প্রায় একই। দুজনই আউট থিতু হয়ে। মুশফিক খেলছিলেন বেশ আস্থায়। বিশেষ করে অশ্বিনকে টানা তিন বলে স্কয়ার ড্রাইভ, স্ট্রেট ড্রাইভ ও কাট শটে মারা চার তিনটি ছিল দারুণ। কিন্তু লম্বা করতে পারেননি ইনিংস।
তাকে আউট করা উনাদকাটের ডেলিভারিটি বেশ ভালো ছিল। তবে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান সেটি ছাড়তেও পারতেন। সিরাজকে দারুণ এক পুল শটে ছক্কা মারার একটু পর লিটন আলতো শটে মিড উইকেটে ক্যাচ দেন অশ্বিনের বলে। এরপর মেহেদী হাসান মিরাজ বিদায় নেন উমেশ যাদবের বাইরের বলে বাজে শটে। নুরুল হাসান সোহান সামলাতে পারেননি উমেশের রিভার্স সুইং। প্রথম ছয় জুটির পাঁচটিই স্পর্শ করে ৪০, কিন্তু ফিফটি পর্যন্ত যেতে পারেনি একটিও! স্রোতের বিপরীতে মুমিনুল চালিয়ে যান তার লড়াই। ৯ চারে ফিফটি স্পর্শ করেন ৭৮ বলে। আগের ৯ ইনিংসে দুই অঙ্ক ছুঁতে না পারা ব্যাটসম্যান ফিফটি পেলেন ১২ ইনিংস পর। ফিফটির পরও তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন একই গতিতে। তবে পাননি যোগ্য একজন সঙ্গী। ৭৫ থেকে অশ্বিনকে দারুণ শটে ছক্কায় যখন ৮০ পেরিয়ে যান, তখনও ৫ উইকেট বাকি বাংলাদেশের। কিন্তু এরপরই একের পর এক উইকেট পড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত মুমিনুল নিজেও অশ্বিনের ক্যারম বলে আউট হয়ে যান নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে। এক বল পরই আরেকটি উইকেট নিয়ে ইনিংসের ইতি টেনে দেন অশ্বিন। আগের টেস্টে ৮ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হওয়া কুলদিপ যাদব এবার দলেই জায়গা পাননি। তার অভাব অনুভবও করেনি ভারত। উমেশ ও অশ্বিন নেন চারটি করে উইকেট। শেষ বিকেলে ব্যাটিংয়ে নেমে ৮ ওভারের কঠিন পরীক্ষায়ও উতরে যান রাহুল ও গিল। দিনটা তাতে পুরোপুরিই হয়ে ওঠে ভারতের।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৭৩.৫ ওভারে ২২৭ (শান্ত ২৪, জাকির ১৫, মুমিনুল ৮৪, সাকিব ১৬, মুশফিক ২৬, লিটন ২৫, মিরাজ ১৫, সোহান ৬, তাসকিন ১, তাইজুল ৪, খালেদ ০; সিরাজ ৯-১-৩৯-০, উমেশ ১৫-৪-২৫-৪, উনাদকাট ১৬-২-৫০-২, অশ্বিন ২১.৫-৩-৭১-৪, আকসার ১২-৩-৩২-০)। ভারত ১ম ইনিংস: ৮ ওভারে ১৯/০ (রাহুল ৩, গিল ১৪*; তাসকিন ৪-২-৮-০, সাকিব ৪-২-১১-০)
মুমিনুলের রানে ফেরার দিনেও সেই বিবর্ণ বাংলাদেশ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ