ফারুক যোশী : আন্তর্জাতিক কূটনীতির অঙ্গনে যেন এক অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি শুরু হয়েছে-বিশ্ব ফিরে যাচ্ছে ১৯৩০-এর দশকে, যখন জাতীয়তাবাদের ব্যানারে শুল্কনীতি ও যুদ্ধ প্রস্তুতি একে অপরের হাত ধরে হাঁটছিল। সেই একইভাবে আজকের পুঁজিবাদও যেন সেই জায়গায়ই এসে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট আগ্রাসন আমাদের আরো পেছনে, ঊনিশ শতকের অন্ধকার শিল্পবিপ্লবের দিকে যেন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে- যেখানে শিশুশ্রম ছিল স্বাভাবিক, আর শ্রমিকের অধিকার মানেই ছিল নৈরাজ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে শিশুশ্রম আইন শিথিল করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ফ্লোরিডা রাজ্যে সম্প্রতি এমন একটি বিল উত্থাপিত হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে-স্কুলগামী শিশুদের রাত ১১টার পর ও সকাল ৬টা ৩০ মিনিটের আগে কাজ করতে দেওয়া যাবে, এমনকি পরদিন তাদের ক্লাস থাকলেও। আরো বলা হয়েছে, ১৪ ও ১৫ বছর বয়সী হাইস্কুল বা হোম-স্কুল শেষ করা শিশুদের সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টার বেশি কাজ করায় কোনো বাধা থাকবে না।
এই সিদ্ধান্ত শুধুই কি অমানবিক? বরং সাংবিধানিক চেতনারও পরিপন্থি। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বা আন্তর্জাতিক শিশু নিরাপত্তা সনদ অনুযায়ী, শিশুদের সুরক্ষা রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের বিষয়। অথচ এখন সেই রাষ্ট্রের ভেতরেই করপোরেট লবির চাপে আইন পরিবর্তনের ঝড় উঠেছে।
ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে শিশুশ্রম আইন লঙ্ঘনের হার আগের বছরের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। শুধু ফ্লোরিডা নয়, অন্তত ৩১টি মার্কিন রাজ্যে এমন আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ম্যাকডোনাল্ডস ২০২৩ সালে শুধু টেক্সাস ও লুইজিয়ানাতে ৮৩ বার শিশুশ্রম আইন লঙ্ঘন করেছে। আইওয়াতে তো সরাসরি ফ্যাক্টরি ও মাংস প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানে ১৪ বছর বয়সীদের নিয়োগ বৈধ করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এমন সিদ্ধান্ত সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল শ্রম আইন লঙ্ঘন করছে।
এসবের পেছনে কাজ করছে রাজনৈতিক এক অতি প্রতিক্রিয়াশীল পরিকল্পনা-‘প্রজেক্ট ২০২৫’। এটি যুক্তরাষ্ট্রের চরম ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর একটি নীতিমালা, যেখানে স্পষ্টভাবে শিশুদের বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ দেওয়ার পক্ষেই সুপারিশ করা হয়েছে। মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয়কে বলা হচ্ছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ পেশা’র সংজ্ঞা শিথিল করতে প্রশিক্ষণ সাপেক্ষে ও অভিভাবকের সম্মতিতে শিশুদের এসব খাতে নিয়োগ দেওয়া যায় উল্লেখ করে এ প্রজেক্টে সুপারিশ এসেছে।
এই ‘অভিভাবকের অধিকার’ তত্ত্বটি শুনতে যতটা মর্যাদাসূচক, বাস্তবে ততটাই নির্মম। কেননা এসব শিশুর অভিভাবকের অধিকাংশই দরিদ্র, যারা প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিমগ্ন। সন্তান আয় না করলে পরিবার চালানোই অসম্ভব- এই বাস্তবতা ব্যবহার করেই করপোরেট পুঁজিপতিরা আইনকে বাঁকিয়ে নিচ্ছে নিজের পক্ষে।
প্রতিদিন পুঁজিবাদ আরো পরিশীলিত, আরো নির্মম হয়ে উঠছে। এখন তাদের লক্ষ্য-শ্রমজীবী শ্রেণির সন্তানরা। যারা বিদ্যালয়ে বসে স্বপ্ন দেখতে শেখে, তাদের আবার নামিয়ে আনা হচ্ছে কারখানার মেঝেতে। মাথা নীচু করে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে লেদ মেশিনের সামনে।
এই পথ কেবল নিষ্ঠুর নয়, ভয়াবহ বিপজ্জনকও। ২০২৩ সালে মিসিসিপিতে ডুভান টোমাস পেরেজ নামে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর একটি পোলট্রি কারখানায় শিল্পযন্ত্রে পিষ্ট হয়ে মারা যায়। উইসকনসিনে কনভেয়র বেল্টে আটকে মারা যায় আরেক কিশোর, মাইকেল শুলস। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১৫ বছর বা তার কম বয়সী ৫৭টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে- এটা নিছক পরিসংখ্যান নয়, বরং উন্নত বিশ্বের কর্পোরেট নীতির এক নীতির নির্মম প্রতিচ্ছবি।
কার্ল মার্কস বহু আগেই বলেছিলেন-পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতায় মুনাফার হার রক্ষায় শ্রমের খরচ কমাতে শিশুদেরও কাজে লাগানো হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আজ তা আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ যেন একটা শিশুর কাছ থেকে তাঁর শৈশব কেড়ে নিয়ে মুনাফা’র লড়াইয়ে তাকে ফেলে দেয়া । আর এখানেই হেরে যাচ্ছে মানবিকতা, হারছে মানুষ, জিতে যাচ্ছে করপোরেট স্বার্থ।
এই প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ব্রিটেনে এর প্রভাব ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াতে বিদেশি সাহায্য তহবিলে বড় আকারে কাটছাঁট করা হয়েছে, যার ফলে বহু উন্নয়নশীল দেশের শিশুরা শিক্ষার বদলে কাজে যেতে বাধ্য হবে। যুদ্ধ এমনিতেই ধ্বংস করে দিচ্ছে গাজার মানুষের আবাস। পরাশক্তিগুলোর সমর্থন-সহযোগিতায়ই সে জায়গা থেকে ক্রমশ নিঃশেষ হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন কিংবা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু। ইসরাইলের বীভৎস আগ্রাসনে গাজায় প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি নিহত হচ্ছে শিশুরাই। এমনকি ইউক্রেন, সেওতো একই। দেশটির শিশু আর নারীরা ক্রমশ অনাবাসী হচ্ছে, হচ্ছে দেশান্তরী।
বাংলাদেশে এই ঝুঁকিতো আছেই। শিশুশ্রম আইনের চোখে অপরাধ। কিন্তু চোখ মেললেইতো আমরা বাংলাদেশে এর ব্যত্যয় দেখি না। পশ্চিমের দেশগুলোতে যদি শিশুশ্রম এভাবেই বৈধতা পায়, তাহলে পশ্চিমা নীতির প্রভাব আমাদের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে আরো বেগবান হবে।
উন্নত দেশগুলোতে শিশুশ্রমের প্রতি সহনশীলতা তৈরি হলে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার চাপে বাংলাদেশেও আবার সেই পথে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বেই। বিশেষ করে বৈধ অভিবাসন ও বৈদেশিক শ্রমবাজার সংকুচিত হলে দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে দরিদ্র শিশুদের ওপর চাপ আরো বাড়বে। তাদের জন্য স্কুল নয়, কাজ হবে জীবনের অবধারিত পরিণতি।
যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা দেশের এই পরিস্থিতি শিশুদের শুধু শিক্ষা ও স্বপ্নের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে না-বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের মানবিক ভিতকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়গুলো আমাদের সামনে আবার ফিরে যেন আসছে করপোরেট ‘উন্নয়নের’ মোড়কে। স্বাভাবিকভাবেই তাই এ প্রশ্নটি আসবেই, এ বিশ্বকে শিশুদের জন্য একটা নিরাপদ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করতে পৃথিবীর দেশে-দেশে রাষ্ট্রনায়কেরা শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করবে, এদের ভবিষ্যৎ বাঁচাবে, নাকি করপোরেট লোভকেই বাঁচিয়ে রাখবে?
লেখক: বৃটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।