ঢাকা ০১:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫

মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাইয়ের চেতনায় সত্য, ন্যায় ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রাসঙ্গিকতা

  • আপডেট সময় : ০৮:০২:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ১২ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

ড. খালিদুর রহমান

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়জুড়ে একটি অটল সত্য অম্লানভাবে প্রতিষ্ঠিত—মুক্তিযুদ্ধ, তার বীর সন্তানেরা এবং তাদের রক্তস্নাত আত্মত্যাগই আমাদের অস্তিত্বের মূলে, আমাদের স্বাধীনতার দলিল। যতই এই সত্যকে অস্বীকারের চেষ্টা করা হোক না কেন, ইতিহাস বহুবার দেখিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আদর্শকে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ফ্যাসিবাদ কিংবা অপশাসনের তকমা লাগিয়ে কলুষিত করার কোনও সুযোগ নেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না; এটি ছিল আমাদের জাতির আত্মপরিচয়ের পুনর্জাগরণকে ঘোষণা করা এক সম্মিলিত আত্মপ্রকাশ।

স্বাধীনতাকে কলুষিত করার যেকোনও ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত সত্যের ভারে ভেঙে পড়ে, মানুষের স্মৃতির কঠিন শিলায় চূর্ণ হয়। একইভাবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান; যা জুলুম, দমন ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উত্তাল জনজাগরণের রূপ ধারণ করেছিল, তা অবমূল্যায়ন করা বা সেই আন্দোলনের আত্মত্যাগকে ছোট করে দেখা কেবল ইতিহাসের প্রতি অসম্মান নয়, মানবতার প্রতি চরম অবিচারও। যে আন্দোলন মানুষের অন্তর্গত স্বাধীনতার তৃষ্ণাকে পুনর্জীবিত করেছে, যে আন্দোলন রাষ্ট্র পরিচালনার স্বচ্ছতা ও সুশাসনের প্রশ্নকে আবার জাতির সামনে উত্থাপন করেছে, তাকে উপেক্ষা করার কোনও সুযোগ নেই। মানুষের আকাঙ্ক্ষা তো কখনই মরে না; সে হয়ে ওঠে শক্তি, হয়ে ওঠে প্রতিবাদ। আর প্রতিবাদ যখন ন্যায় ও সত্যের পাশে দাঁড়ায়, তখন তা একটি জাতির আত্মপরিচয়ের পথকে আরও সুস্পষ্ট করে।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে সত্যকে সত্য বলা, রাজাকারকে রাজাকার বলা আর দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থ মর্যাদায় সম্বোধন করা। কারণ যে জাতি তার বীরদের ভুলে যায়, তার অতীতকে অস্বীকার করে, সেই জাতির ভবিষ্যৎ কখনোই দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে না। তাই রাজাকারকে রাজাকার বলা, দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতিবাজ বলা, অপশাসনকে অপশাসন বলা এবং সুশাসনকে সুশাসন বলা- এটাই ইতিহাসের প্রতি সত্যনিষ্ঠা, এটাই জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা। ভাষা পরিবর্তিত হলে ইতিহাস অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে, সত্য মুছে যাবে এবং মুছে যাবে জাতির আত্মপরিচয়।

মুক্তিযুদ্ধের নির্ভীক বীরেরা অস্ত্র হাতে যখন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তখন তারা শুধু একটি দখলদার বাহিনীকে পরাভূত করেছিলেন, এমন নয়। তারা পরাজিত করেছিলেন অন্যায়কে, নিপীড়নকে, পরাজিত করেছিলেন অগণতান্ত্রিক বিষবাষ্পকে। তাদের রক্ত ঝরেছিল স্বাধীনতার সবুজ জমিনে, যেন এই দেশের সন্তানরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কখনই অপশাসনের মুখোশ পরে থাকতে পারে না।

স্বাধীনতার নামে যারা দুর্নীতি, লুটপাট বা অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহারকে বৈধতা দিতে চায়; তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবমাননা করছে এবং জাতির অস্তিত্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একইভাবে যারা জুলাইয়ের আন্দোলনে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রীয় অন্যায়, দমননীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল; তারাও সেই একই মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই ধারক- মানুষের মুক্তির, ন্যায়ের, সমতার। তাদের অবদানকে হেয় করার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাস প্রমাণ করেছে- যখন রাষ্ট্রের শাসক ও শাসনব্যবস্থা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করে, তখন মানুষ রাস্তায় নামে। তাদের কণ্ঠস্বরই রাষ্ট্রকে পথ দেখায় এবং ভুল সংশোধনের বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।

ওই আত্মত্যাগী মানুষের দাবি বা আন্দোলনকে উপহাসের সরঞ্জামে পরিণত করলে জাতির আত্মাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়; যা ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না। এ কারণেই বলা হয়- মর্যাদাশীল অবস্থানকে মর্যাদাশীল করতে হবে, অমর্যাদাশীল অবস্থানকে অমর্যাদাই দেখাতে হবে। কোনো অবস্থানকে কৃত্রিমভাবে সম্মানিত করা যায় না। সম্মান আসে সত্য থেকে, আসে মানুষের আস্থা থেকে, আসে ন্যায়ের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান গড়ে উঠেছে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের আলোকে; আর রাজাকারদের অপমানের মূল উৎস হলো জাতির প্রতি তাদের বিশ্বাসঘাতকতা। তেমনি, সুশাসনের মর্যাদা গড়ে ওঠে মানুষের সেবা করার অঙ্গীকার ও তার বাস্তব বাস্তবায়ন থেকে; আর অপশাসনের অমর্যাদা জন্ম নেয় দমন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে। সমাজ ও রাষ্ট্র যত স্পষ্ট ভাষায় এসব পার্থক্য করতে পারবে, ততই তার ভবিষ্যৎ হবে সুসংহত, নির্মল, উন্নত।

সত্যকে সত্য বলা ইতিহাসের কাছে শুধু দায়িত্ব নয়, এটি একটি নৈতিক অবস্থান। কেননা সত্যকে আড়াল করার প্রচেষ্টা এক সময় ভেঙে পড়ে। পৃথিবীর যে কোনো জাতির ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়- যেখানে মতবিরোধ, অবিচার বা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ছিল; সেখানে মানুষ কখনোই চুপচাপ বসে থাকে না। আমরাও তা পারেনি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কিংবা জুলাইয়ের গণজাগরণ- সবই আমাদের চিরন্তন প্রতিবাদী সত্তার সাক্ষ্য। তাই জনগণের এই দীর্ঘ ঐতিহাসিক যাত্রাপথকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করে যদি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দুর্নীতি, লুটপাট বা অপশাসনের দুর্গ গড়ে তোলার চেষ্টা করে, তা ইতিহাসের চোখে ধিকৃত। মুক্তিযুদ্ধকে কোনও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ নেই, থাকা উচিতও নয়। মুক্তিযুদ্ধের মহিমা কোনো দলীয় পতাকা নয়; এটি জাতির নিজস্ব অমূল্য সম্পদ। অথচ মাঝে মাঝে দেখা যায়, এই মহিমাকে পুঁজি করে কেউ কেউ নিজেদের ক্ষমতার দুর্গ সুরক্ষিত করতে চায়। আবার কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের অবদান খাটো করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণে মরিয়া হয়ে ওঠে। উভয়পক্ষই প্রকৃত অর্থে ইতিহাস থেকে বিচ্যুত। কারণ মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করা কিংবা অতিরঞ্জিত করা—দুই-ই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবমাননা।

জুলাই আন্দোলনকে একইভাবে রাজনৈতিক হিসাব-নিকেশের খাতায় নামিয়ে আনলে সেই আন্দোলনের আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। মানুষ যখন রাস্তায় নামে, তখন তাদের হৃদয়ে থাকে ক্ষোভ, বেদনা, অপমান বোধ, আর এর মাঝেই থাকে অকুণ্ঠ সাহস। সেই সাহসকে সম্মান দিতে হবে, কারণ তা আসে দেশের ভবিষ্যতের প্রতি গভীর বিশ্বাস থেকে। জনগণ কোনোদিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়; জনগণ সবসময়ই রাষ্ট্রকে ভালো দেখতে চায়। যখন রাষ্ট্র ভুল পথে হাঁটে, তখন জনগণ তাকে সঠিক পথ দেখায়। এই পথনির্দেশ করাই ছিল জুলাইয়ের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। তাই এই আন্দোলনকে কোনও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতার হাতিয়ার বা দলীয় ও মতাদর্শগত স্বার্থের পুঁজি হিসেবে পরিগণনা করা মানে নতুন অন্যায়ের বীজ বপন করা।

মুক্তিযুদ্ধের বীরেরা লড়েছিলেন স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য, সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। জুলাইয়ের আন্দোলনকারীরাও সেই একই অধিকারের জন্য, একই ন্যায়ের দাবি নিয়ে লড়াই করেছিলেন। উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা, ভুলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। তাই মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ব্যবহার করে দুর্নীতি বা অপশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেমন ইতিহাসের সঙ্গে প্রতারণা, তেমনি জুলাই আন্দোলনের বীরত্বকে ব্যবহার করে নৈতিক পতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে বৈধতা দেওয়া সম্ভব নয়। সত্যের শক্তি যে জায়গায় অবস্থান করে, সেখানে কৃত্রিমভাবে অনৈতিকতা বা অপশাসনকে প্রতিষ্ঠা করার কোনও সুযোগ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং জুলাই আন্দোলনের বীরত্ব থেকে আমরা শিখেছি সত্যকে সত্য বলা, অন্যায়কে অন্যায় বলা এবং ন্যায়ের পথে অটল থাকা। এই শিক্ষা স্পষ্ট করে যে দেশের অস্তিত্ব, জাতির মর্যাদা এবং জনগণের আস্থা কেবল সুশাসন ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমেই স্থির রাখা সম্ভব। যখন রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি বা দমননীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন জনগণই সঠিক পথ নির্দেশ করে। কারণ লড়াই ও প্রতিবাদ আমাদের ঐতিহাসিক অভ্যাস এবং জাতীয় স্বার্থের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ঐতিহাসিক শিক্ষা থেকে স্পষ্ট হয় যে বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য একটি সত্যিকার, স্বচ্ছ ও অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন অপরিহার্য। কারণ এটি শুধু গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে না, এটি হবে জনগণের বিশ্বাস ও স্বাধীনতার চেতনার প্রতি শ্রদ্ধার পরিচয়।

নির্বাচন নিশ্চিত করবে যে রাষ্ট্রের শাসন জনগণের ন্যায়, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে, আর কোন ব্যক্তিগত, দলীয় বা স্বার্থান্বেষী শাসন তা হরণ করতে পারবে না। তাই জাতি ও দেশের মর্যাদা রক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই আন্দোলনের চেতনা রক্ষায় এবং মানুষের অধিকার ও ন্যায় নিশ্চিত করার জন্য বিলম্ব না করে অবিলম্বে মুক্ত, স্বচ্ছ ও ন্যায্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা অপরিহার্য।

লেখক: অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাইয়ের চেতনায় সত্য, ন্যায় ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রাসঙ্গিকতা

আপডেট সময় : ০৮:০২:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫

ড. খালিদুর রহমান

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়জুড়ে একটি অটল সত্য অম্লানভাবে প্রতিষ্ঠিত—মুক্তিযুদ্ধ, তার বীর সন্তানেরা এবং তাদের রক্তস্নাত আত্মত্যাগই আমাদের অস্তিত্বের মূলে, আমাদের স্বাধীনতার দলিল। যতই এই সত্যকে অস্বীকারের চেষ্টা করা হোক না কেন, ইতিহাস বহুবার দেখিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আদর্শকে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ফ্যাসিবাদ কিংবা অপশাসনের তকমা লাগিয়ে কলুষিত করার কোনও সুযোগ নেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না; এটি ছিল আমাদের জাতির আত্মপরিচয়ের পুনর্জাগরণকে ঘোষণা করা এক সম্মিলিত আত্মপ্রকাশ।

স্বাধীনতাকে কলুষিত করার যেকোনও ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত সত্যের ভারে ভেঙে পড়ে, মানুষের স্মৃতির কঠিন শিলায় চূর্ণ হয়। একইভাবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান; যা জুলুম, দমন ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উত্তাল জনজাগরণের রূপ ধারণ করেছিল, তা অবমূল্যায়ন করা বা সেই আন্দোলনের আত্মত্যাগকে ছোট করে দেখা কেবল ইতিহাসের প্রতি অসম্মান নয়, মানবতার প্রতি চরম অবিচারও। যে আন্দোলন মানুষের অন্তর্গত স্বাধীনতার তৃষ্ণাকে পুনর্জীবিত করেছে, যে আন্দোলন রাষ্ট্র পরিচালনার স্বচ্ছতা ও সুশাসনের প্রশ্নকে আবার জাতির সামনে উত্থাপন করেছে, তাকে উপেক্ষা করার কোনও সুযোগ নেই। মানুষের আকাঙ্ক্ষা তো কখনই মরে না; সে হয়ে ওঠে শক্তি, হয়ে ওঠে প্রতিবাদ। আর প্রতিবাদ যখন ন্যায় ও সত্যের পাশে দাঁড়ায়, তখন তা একটি জাতির আত্মপরিচয়ের পথকে আরও সুস্পষ্ট করে।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে সত্যকে সত্য বলা, রাজাকারকে রাজাকার বলা আর দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থ মর্যাদায় সম্বোধন করা। কারণ যে জাতি তার বীরদের ভুলে যায়, তার অতীতকে অস্বীকার করে, সেই জাতির ভবিষ্যৎ কখনোই দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে না। তাই রাজাকারকে রাজাকার বলা, দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতিবাজ বলা, অপশাসনকে অপশাসন বলা এবং সুশাসনকে সুশাসন বলা- এটাই ইতিহাসের প্রতি সত্যনিষ্ঠা, এটাই জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা। ভাষা পরিবর্তিত হলে ইতিহাস অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে, সত্য মুছে যাবে এবং মুছে যাবে জাতির আত্মপরিচয়।

মুক্তিযুদ্ধের নির্ভীক বীরেরা অস্ত্র হাতে যখন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তখন তারা শুধু একটি দখলদার বাহিনীকে পরাভূত করেছিলেন, এমন নয়। তারা পরাজিত করেছিলেন অন্যায়কে, নিপীড়নকে, পরাজিত করেছিলেন অগণতান্ত্রিক বিষবাষ্পকে। তাদের রক্ত ঝরেছিল স্বাধীনতার সবুজ জমিনে, যেন এই দেশের সন্তানরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কখনই অপশাসনের মুখোশ পরে থাকতে পারে না।

স্বাধীনতার নামে যারা দুর্নীতি, লুটপাট বা অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহারকে বৈধতা দিতে চায়; তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবমাননা করছে এবং জাতির অস্তিত্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একইভাবে যারা জুলাইয়ের আন্দোলনে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রীয় অন্যায়, দমননীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল; তারাও সেই একই মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই ধারক- মানুষের মুক্তির, ন্যায়ের, সমতার। তাদের অবদানকে হেয় করার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাস প্রমাণ করেছে- যখন রাষ্ট্রের শাসক ও শাসনব্যবস্থা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করে, তখন মানুষ রাস্তায় নামে। তাদের কণ্ঠস্বরই রাষ্ট্রকে পথ দেখায় এবং ভুল সংশোধনের বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।

ওই আত্মত্যাগী মানুষের দাবি বা আন্দোলনকে উপহাসের সরঞ্জামে পরিণত করলে জাতির আত্মাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়; যা ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না। এ কারণেই বলা হয়- মর্যাদাশীল অবস্থানকে মর্যাদাশীল করতে হবে, অমর্যাদাশীল অবস্থানকে অমর্যাদাই দেখাতে হবে। কোনো অবস্থানকে কৃত্রিমভাবে সম্মানিত করা যায় না। সম্মান আসে সত্য থেকে, আসে মানুষের আস্থা থেকে, আসে ন্যায়ের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান গড়ে উঠেছে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের আলোকে; আর রাজাকারদের অপমানের মূল উৎস হলো জাতির প্রতি তাদের বিশ্বাসঘাতকতা। তেমনি, সুশাসনের মর্যাদা গড়ে ওঠে মানুষের সেবা করার অঙ্গীকার ও তার বাস্তব বাস্তবায়ন থেকে; আর অপশাসনের অমর্যাদা জন্ম নেয় দমন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে। সমাজ ও রাষ্ট্র যত স্পষ্ট ভাষায় এসব পার্থক্য করতে পারবে, ততই তার ভবিষ্যৎ হবে সুসংহত, নির্মল, উন্নত।

সত্যকে সত্য বলা ইতিহাসের কাছে শুধু দায়িত্ব নয়, এটি একটি নৈতিক অবস্থান। কেননা সত্যকে আড়াল করার প্রচেষ্টা এক সময় ভেঙে পড়ে। পৃথিবীর যে কোনো জাতির ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়- যেখানে মতবিরোধ, অবিচার বা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ছিল; সেখানে মানুষ কখনোই চুপচাপ বসে থাকে না। আমরাও তা পারেনি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কিংবা জুলাইয়ের গণজাগরণ- সবই আমাদের চিরন্তন প্রতিবাদী সত্তার সাক্ষ্য। তাই জনগণের এই দীর্ঘ ঐতিহাসিক যাত্রাপথকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করে যদি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দুর্নীতি, লুটপাট বা অপশাসনের দুর্গ গড়ে তোলার চেষ্টা করে, তা ইতিহাসের চোখে ধিকৃত। মুক্তিযুদ্ধকে কোনও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ নেই, থাকা উচিতও নয়। মুক্তিযুদ্ধের মহিমা কোনো দলীয় পতাকা নয়; এটি জাতির নিজস্ব অমূল্য সম্পদ। অথচ মাঝে মাঝে দেখা যায়, এই মহিমাকে পুঁজি করে কেউ কেউ নিজেদের ক্ষমতার দুর্গ সুরক্ষিত করতে চায়। আবার কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের অবদান খাটো করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণে মরিয়া হয়ে ওঠে। উভয়পক্ষই প্রকৃত অর্থে ইতিহাস থেকে বিচ্যুত। কারণ মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করা কিংবা অতিরঞ্জিত করা—দুই-ই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবমাননা।

জুলাই আন্দোলনকে একইভাবে রাজনৈতিক হিসাব-নিকেশের খাতায় নামিয়ে আনলে সেই আন্দোলনের আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। মানুষ যখন রাস্তায় নামে, তখন তাদের হৃদয়ে থাকে ক্ষোভ, বেদনা, অপমান বোধ, আর এর মাঝেই থাকে অকুণ্ঠ সাহস। সেই সাহসকে সম্মান দিতে হবে, কারণ তা আসে দেশের ভবিষ্যতের প্রতি গভীর বিশ্বাস থেকে। জনগণ কোনোদিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়; জনগণ সবসময়ই রাষ্ট্রকে ভালো দেখতে চায়। যখন রাষ্ট্র ভুল পথে হাঁটে, তখন জনগণ তাকে সঠিক পথ দেখায়। এই পথনির্দেশ করাই ছিল জুলাইয়ের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। তাই এই আন্দোলনকে কোনও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতার হাতিয়ার বা দলীয় ও মতাদর্শগত স্বার্থের পুঁজি হিসেবে পরিগণনা করা মানে নতুন অন্যায়ের বীজ বপন করা।

মুক্তিযুদ্ধের বীরেরা লড়েছিলেন স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য, সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। জুলাইয়ের আন্দোলনকারীরাও সেই একই অধিকারের জন্য, একই ন্যায়ের দাবি নিয়ে লড়াই করেছিলেন। উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা, ভুলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। তাই মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ব্যবহার করে দুর্নীতি বা অপশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেমন ইতিহাসের সঙ্গে প্রতারণা, তেমনি জুলাই আন্দোলনের বীরত্বকে ব্যবহার করে নৈতিক পতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে বৈধতা দেওয়া সম্ভব নয়। সত্যের শক্তি যে জায়গায় অবস্থান করে, সেখানে কৃত্রিমভাবে অনৈতিকতা বা অপশাসনকে প্রতিষ্ঠা করার কোনও সুযোগ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং জুলাই আন্দোলনের বীরত্ব থেকে আমরা শিখেছি সত্যকে সত্য বলা, অন্যায়কে অন্যায় বলা এবং ন্যায়ের পথে অটল থাকা। এই শিক্ষা স্পষ্ট করে যে দেশের অস্তিত্ব, জাতির মর্যাদা এবং জনগণের আস্থা কেবল সুশাসন ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমেই স্থির রাখা সম্ভব। যখন রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি বা দমননীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন জনগণই সঠিক পথ নির্দেশ করে। কারণ লড়াই ও প্রতিবাদ আমাদের ঐতিহাসিক অভ্যাস এবং জাতীয় স্বার্থের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ঐতিহাসিক শিক্ষা থেকে স্পষ্ট হয় যে বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য একটি সত্যিকার, স্বচ্ছ ও অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন অপরিহার্য। কারণ এটি শুধু গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে না, এটি হবে জনগণের বিশ্বাস ও স্বাধীনতার চেতনার প্রতি শ্রদ্ধার পরিচয়।

নির্বাচন নিশ্চিত করবে যে রাষ্ট্রের শাসন জনগণের ন্যায়, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে, আর কোন ব্যক্তিগত, দলীয় বা স্বার্থান্বেষী শাসন তা হরণ করতে পারবে না। তাই জাতি ও দেশের মর্যাদা রক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই আন্দোলনের চেতনা রক্ষায় এবং মানুষের অধিকার ও ন্যায় নিশ্চিত করার জন্য বিলম্ব না করে অবিলম্বে মুক্ত, স্বচ্ছ ও ন্যায্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা অপরিহার্য।

লেখক: অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ