ঢাকা ০১:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের গৌরব

  • আপডেট সময় : ০৯:৪৩:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ নভেম্বর ২০২১
  • ২২ বার পড়া হয়েছে

স্কোয়াড্রন লিডার অব. সাদরুল আহমেদ খান : গতকাল রোববার ২১ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দিবস। আমরা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্মান জানাই যারা যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে আমাদের দেশের সেবা করেছেন এবং করছেন। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সাহসী আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে আমরা স্বীকার করি যে ঋণ আমরা কখনই শোধ করতে পারব না। যারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন হারিয়েছেন এবং যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেসব বীর সেনানী এবং তাদের পরিবারের সদস্য এবং প্রিয়জনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
গতকাল ২১ নভেম্বর ছিল আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সোনালী দিন। আমাদের স্বাধীনতা, শান্তি এবং গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের নিঃস্বার্থ, উৎসর্গ এবং সাহসিকতার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, ধন্যবাদ এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ বলে আমাদের জাতি আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী, পাকিস্তান নৌবাহিনী ও পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়।
দেশ মাতৃভূমির স্বাধীনতার কাজে বাংলাদেশী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততা অনেক আগেই শুরু হয়েছিল এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে এটি প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার এই মামলাটি দায়ের করেছিল, বঙ্গবন্ধুর সাথে কিছু বাঙালি সামরিক সদস্যদের বিরুদ্ধে অভযোগ ছিল তারা ভারতের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে একটি নতুন দেশ গঠনের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুসহ সকল আসামিকে গ্রেফতার করা হয় এবং ঢাকা সেনানিবাসে কোর্ট মার্শালের বিচার শুরু হয়। এরই মধ্যে অন্যতম আসামি, বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হেফাজতে হত্যা করা হয়। এই মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রবল আন্দোলন শুরু করেন। অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। মামলা খারিজ হলেও ষড়যন্ত্র ছিল আসল। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে (অপারেশন সার্চ লাইট) বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ এবং ইপিআর, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং তাদের অনেকেই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তান সামরিক চাকরির নিরাপদ জীবন ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের সারিতে লড়াইয়ের পাশাপাশি, অফিসার এবং অন্যান্য পদমর্যাদাররা মুজিব নগর সরকারকে সহায়তা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর জন্ম ১৯৭১ সালের যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরু করে। এই যৌথ বাহিনীর অভিযানটি ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহে সংঘটিত সম্মিলিত বাহিনীর (মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী) অপারেশনেরও ভিত্তিপ্রস্তরও ছিল, যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ে পরিণত হয়।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে । মুক্তিযুদ্ধে তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাত সদস্যকে সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেয়া হয় , ৫৮ জনকে বীর উত্তম, ১৩৪ জনকে বীর বিক্রম এবং ১৭৮ জনকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হয় ।
স্বাধীনতার পর, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি সামরিক একাডেমি, সম্মিলিত ট্রেনিং সেন্টার , প্রতিটি সেনা কোরের জন্য আলাদা আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। জাতির পিতা বিএনএস ইসা খান উদ্বোধন করেন এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য দুটি যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে একটি বহুমুখী বাহিনীতে পরিণত করার জন্য তিনি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান মিগ-২১, আধুনিক পরিবহন বিমান, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং হেলিকপ্টার ক্রয় করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বৈরশাসক ক্ষমতায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে উপেক্ষা করা হয়, তাছাড়া তথাকথিত অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে বেশ কিছু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য নিহত হন। কোর্ট মার্শালের নামে তথাকথিত বিদ্রোহের দায়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। অনেককে চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অভিজ্ঞ জনবল ও সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি, অঙ্গীকার ও গতিশীল নেতৃত্বে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী নতুন পথের সন্ধান পেয়েছিল। আমাদের সামরিক বাহিনী আধুনিক সরঞ্জাম, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দিয়ে পরিপূর্ণ হয়েছিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “ফোর্সেস গোল- ২০৩০” সম্পর্কে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তবে দুর্ভাগ্যবশত, আওয়ামী লীগ ২০০১-২০০৮ সাল পর্যন্ত সরকার গঠন করতে পারেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে এবং এ পর্যন্ত তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। যার ফলে ফোর্সেস গোল-২০৩০ ও ভিশন-২০৪১ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সব পরিকল্পনা, ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। নতুন নতুন সেনানিবাস, নৌ ও বিমান বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য শেখ হাসিনার সরকার গইঞ-২০০০, ঠঞ-৫ ট্যাঙ্ক কিনেছে। ইঞজ-৮০, ঙঃড়শধৎ পড়নৎধ, গধীীঢ়ৎড় গজঅচ, ইঙঠ গ১১ আমার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (অচঈ)। ডঝ-২২ রকেট, ঞজএ-৩০০ লঞ্চার, ঘঙজঅ ই-৫২, ঋগ-৯০ সারফেস টু এয়ার মিসাইল (ঝঅগ), ছড-২ গঅঘচঅউ, গবঃরং-গ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল, চঋ-৯৮ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক রকেট, ঝখঈ-২ রাডার গও-১৭ ঝঐ হেলিকপ্টার, ইউরোকপ্টার, বেল ৪০৭ হেলিকপ্টার, ঈঅঝঅ ঈ২৯৫ ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফ্ট, ডায়মন্ড উঅ৪০ ঃৎধরহবৎ বিমান, ইৎধসড়ৎ ঈ৪ঊণঊ মনুষ্যবিহীন এরিয়াল ভেহিকল (টঅঠ) ইত্যাদি ক্রয় করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সংযোজন ০৩৫জি সাবমেরিন, ডর্নিয়ার ২২এনজি বিমান, অগাস্টা এডব্লিউ-১০৯ হেলিকপ্টার এবং এর যুদ্ধ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ইত্যাদি। শেখ হাসিনার সরকার ঋ-৭ইএও ফাইটার, ণঅক-১৩০ জেট ট্রেনার, ঈ-১৩০ঔ পরিবহন, ক-৮ড জেট ট্রেনার, খ-৪১০ পরিবহন বিমান, গও-১৭১ঝঐ হেলিকপ্টার, অমঁংঃধ অড১৩৯ মেরিটাইম ঝঅজ হেলিকপ্টার, অড১১৯কঢ হেলিকপ্টার ইত্যাদি ক্রয় করা হয়েছে।
সরকার এয়ার-ডিফেন্স সিস্টেম ঋগ-৯০, ঝবষবী জঅঞ-৩১উখ অউ জধফবৎ কিনেছে। বাংলাদেশের ভূখ- এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ এবং ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আরও আধুনিক ও উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সরঞ্জাম, অস্ত্র, গোলাবারুদ, যুদ্ধ জাহাজ এবং বিমান ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ইউনিভারসিটি অব প্রফেশনালস , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কোর্সগুলি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার্থী তৈরি করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে । এখানকার শিক্ষার্থীরা সম্ভাবনাময় সমুদ্র অর্থনীতির জ্ঞান আহরণ করতে এবং অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যুদ্ধবিমান, পরিবহন বিমান এবং হেলিকপ্টার তৈরির জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে।
প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা উচু করে দড়িয়েছে, এই তিন বাহিনীতে কাজ করা মেধাবী মহিলা পুরুষদের ধন্যবাদ, উনাদের শ্রম, চেতনা, দেশপ্রম, এবং দক্ষতা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে করে তুলেছে জাতির গর্ব। দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সাহস ও দক্ষতা দেখিয়েছে । শান্তি রক্ষার জন্য সহানুভূতি ও ত্যাগ দেখিয়েছে। ১৯৮৮ সালের বন্যা, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারীর মতো সময় আমরা তাদেরকে চব্বিশ ঘন্টা দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনেও আমরা তাদের দেখেছি।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে দীর্ঘ ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করতে পেরে আমি গর্বিত এবং তিন বাহিনীতে যারা কাজ করে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর কর্মীরা- যারা শান্তিতে সমরে সর্বদা অবদান রেখে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত রাখে, আর এই দেশপ্রেমিক বাহিনী সদস্যদের পরিবারক, তাদের সকলের জন্যও আমি গর্বিত। ।
২১ নভেম্বর আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সোনালী দিন। আমাদের স্বাধীনতা, শান্তি এবং গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের নিঃস্বার্থ, উৎসর্গ এবং সাহসিকতার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, ধন্যবাদ এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের গৌরব

আপডেট সময় : ০৯:৪৩:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ নভেম্বর ২০২১

স্কোয়াড্রন লিডার অব. সাদরুল আহমেদ খান : গতকাল রোববার ২১ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দিবস। আমরা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্মান জানাই যারা যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে আমাদের দেশের সেবা করেছেন এবং করছেন। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সাহসী আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে আমরা স্বীকার করি যে ঋণ আমরা কখনই শোধ করতে পারব না। যারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন হারিয়েছেন এবং যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেসব বীর সেনানী এবং তাদের পরিবারের সদস্য এবং প্রিয়জনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
গতকাল ২১ নভেম্বর ছিল আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সোনালী দিন। আমাদের স্বাধীনতা, শান্তি এবং গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের নিঃস্বার্থ, উৎসর্গ এবং সাহসিকতার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, ধন্যবাদ এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ বলে আমাদের জাতি আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী, পাকিস্তান নৌবাহিনী ও পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়।
দেশ মাতৃভূমির স্বাধীনতার কাজে বাংলাদেশী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততা অনেক আগেই শুরু হয়েছিল এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে এটি প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার এই মামলাটি দায়ের করেছিল, বঙ্গবন্ধুর সাথে কিছু বাঙালি সামরিক সদস্যদের বিরুদ্ধে অভযোগ ছিল তারা ভারতের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে একটি নতুন দেশ গঠনের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুসহ সকল আসামিকে গ্রেফতার করা হয় এবং ঢাকা সেনানিবাসে কোর্ট মার্শালের বিচার শুরু হয়। এরই মধ্যে অন্যতম আসামি, বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হেফাজতে হত্যা করা হয়। এই মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রবল আন্দোলন শুরু করেন। অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। মামলা খারিজ হলেও ষড়যন্ত্র ছিল আসল। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে (অপারেশন সার্চ লাইট) বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ এবং ইপিআর, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং তাদের অনেকেই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তান সামরিক চাকরির নিরাপদ জীবন ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের সারিতে লড়াইয়ের পাশাপাশি, অফিসার এবং অন্যান্য পদমর্যাদাররা মুজিব নগর সরকারকে সহায়তা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর জন্ম ১৯৭১ সালের যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরু করে। এই যৌথ বাহিনীর অভিযানটি ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহে সংঘটিত সম্মিলিত বাহিনীর (মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী) অপারেশনেরও ভিত্তিপ্রস্তরও ছিল, যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ে পরিণত হয়।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে । মুক্তিযুদ্ধে তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাত সদস্যকে সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেয়া হয় , ৫৮ জনকে বীর উত্তম, ১৩৪ জনকে বীর বিক্রম এবং ১৭৮ জনকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হয় ।
স্বাধীনতার পর, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি সামরিক একাডেমি, সম্মিলিত ট্রেনিং সেন্টার , প্রতিটি সেনা কোরের জন্য আলাদা আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। জাতির পিতা বিএনএস ইসা খান উদ্বোধন করেন এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য দুটি যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে একটি বহুমুখী বাহিনীতে পরিণত করার জন্য তিনি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান মিগ-২১, আধুনিক পরিবহন বিমান, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং হেলিকপ্টার ক্রয় করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বৈরশাসক ক্ষমতায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে উপেক্ষা করা হয়, তাছাড়া তথাকথিত অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে বেশ কিছু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য নিহত হন। কোর্ট মার্শালের নামে তথাকথিত বিদ্রোহের দায়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। অনেককে চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অভিজ্ঞ জনবল ও সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি, অঙ্গীকার ও গতিশীল নেতৃত্বে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী নতুন পথের সন্ধান পেয়েছিল। আমাদের সামরিক বাহিনী আধুনিক সরঞ্জাম, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দিয়ে পরিপূর্ণ হয়েছিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “ফোর্সেস গোল- ২০৩০” সম্পর্কে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তবে দুর্ভাগ্যবশত, আওয়ামী লীগ ২০০১-২০০৮ সাল পর্যন্ত সরকার গঠন করতে পারেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে এবং এ পর্যন্ত তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। যার ফলে ফোর্সেস গোল-২০৩০ ও ভিশন-২০৪১ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সব পরিকল্পনা, ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। নতুন নতুন সেনানিবাস, নৌ ও বিমান বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য শেখ হাসিনার সরকার গইঞ-২০০০, ঠঞ-৫ ট্যাঙ্ক কিনেছে। ইঞজ-৮০, ঙঃড়শধৎ পড়নৎধ, গধীীঢ়ৎড় গজঅচ, ইঙঠ গ১১ আমার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (অচঈ)। ডঝ-২২ রকেট, ঞজএ-৩০০ লঞ্চার, ঘঙজঅ ই-৫২, ঋগ-৯০ সারফেস টু এয়ার মিসাইল (ঝঅগ), ছড-২ গঅঘচঅউ, গবঃরং-গ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল, চঋ-৯৮ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক রকেট, ঝখঈ-২ রাডার গও-১৭ ঝঐ হেলিকপ্টার, ইউরোকপ্টার, বেল ৪০৭ হেলিকপ্টার, ঈঅঝঅ ঈ২৯৫ ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফ্ট, ডায়মন্ড উঅ৪০ ঃৎধরহবৎ বিমান, ইৎধসড়ৎ ঈ৪ঊণঊ মনুষ্যবিহীন এরিয়াল ভেহিকল (টঅঠ) ইত্যাদি ক্রয় করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সংযোজন ০৩৫জি সাবমেরিন, ডর্নিয়ার ২২এনজি বিমান, অগাস্টা এডব্লিউ-১০৯ হেলিকপ্টার এবং এর যুদ্ধ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ইত্যাদি। শেখ হাসিনার সরকার ঋ-৭ইএও ফাইটার, ণঅক-১৩০ জেট ট্রেনার, ঈ-১৩০ঔ পরিবহন, ক-৮ড জেট ট্রেনার, খ-৪১০ পরিবহন বিমান, গও-১৭১ঝঐ হেলিকপ্টার, অমঁংঃধ অড১৩৯ মেরিটাইম ঝঅজ হেলিকপ্টার, অড১১৯কঢ হেলিকপ্টার ইত্যাদি ক্রয় করা হয়েছে।
সরকার এয়ার-ডিফেন্স সিস্টেম ঋগ-৯০, ঝবষবী জঅঞ-৩১উখ অউ জধফবৎ কিনেছে। বাংলাদেশের ভূখ- এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ এবং ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আরও আধুনিক ও উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সরঞ্জাম, অস্ত্র, গোলাবারুদ, যুদ্ধ জাহাজ এবং বিমান ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ইউনিভারসিটি অব প্রফেশনালস , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কোর্সগুলি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার্থী তৈরি করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে । এখানকার শিক্ষার্থীরা সম্ভাবনাময় সমুদ্র অর্থনীতির জ্ঞান আহরণ করতে এবং অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যুদ্ধবিমান, পরিবহন বিমান এবং হেলিকপ্টার তৈরির জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে।
প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা উচু করে দড়িয়েছে, এই তিন বাহিনীতে কাজ করা মেধাবী মহিলা পুরুষদের ধন্যবাদ, উনাদের শ্রম, চেতনা, দেশপ্রম, এবং দক্ষতা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে করে তুলেছে জাতির গর্ব। দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সাহস ও দক্ষতা দেখিয়েছে । শান্তি রক্ষার জন্য সহানুভূতি ও ত্যাগ দেখিয়েছে। ১৯৮৮ সালের বন্যা, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারীর মতো সময় আমরা তাদেরকে চব্বিশ ঘন্টা দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনেও আমরা তাদের দেখেছি।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে দীর্ঘ ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করতে পেরে আমি গর্বিত এবং তিন বাহিনীতে যারা কাজ করে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর কর্মীরা- যারা শান্তিতে সমরে সর্বদা অবদান রেখে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত রাখে, আর এই দেশপ্রেমিক বাহিনী সদস্যদের পরিবারক, তাদের সকলের জন্যও আমি গর্বিত। ।
২১ নভেম্বর আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সোনালী দিন। আমাদের স্বাধীনতা, শান্তি এবং গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের নিঃস্বার্থ, উৎসর্গ এবং সাহসিকতার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, ধন্যবাদ এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।