প্রত্যাশা ডেস্ক : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ এবং ভারত ইস্যুতে দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পারিবারিক সফরে অস্ট্রেলিয়া গেছেন তিনি। কবে নাগাদ দেশে ফিরবেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই তার ঘনিষ্ঠদের কাছে। এই সময়ে তার অস্ট্রেলিয়া সফর নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে রহস্যের জন্ম দিয়েছে। নানা জল্পনা শোনা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহলে। সংবাদসংস্থা জাগো নিউজ এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরেছে। গত ১১ অক্টোবর বড় মেয়ে ডা. শামারুহ মির্জা ও তার পরিবারের সঙ্গে অবকাশ কাটাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অস্ট্রেলিয়ায় মির্জা ফখরুলকে স্বাগত জানান বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রাশেদুল হক।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ব্যক্তিগত সহকারী মো. ইউনুস আলী জানান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পারিবারিক সফরে অস্ট্রেলিয়া গেছেন। তার স্ত্রী সেখানে রয়েছেন, তাকে আনতে গেছেন। ফেরার তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। তবে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান দাবি করেন, ১৬ অক্টোবর সেখানে একটি সেমিনারে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশে ফিরবেন।
বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘মহাসচিবের অস্ট্রেলিয়ার সফর পারিবারিক না রাজনৈতিক বা তিনি কবে দেশে ফিরবেন সে বিষয়ে আমার জানা নেই। এতটুকু জানি অস্ট্রেলিয়ায় ওনার মেয়ে থাকেন।’
বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, ‘আওয়ামী লীগ ভোটে এলে আপত্তি নেই’ এবং ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে বরফ গলতে শুরু করেছে’- গণমাধ্যমে এমন বক্তব্য দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রশংসা কুড়ালেও তিনি বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনোভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বলে মনে করে দলের একটি অংশ।
বিএনপির নেতাকর্মীদের একাংশের ধারণা, দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া আওয়ামী লীগ এবং ভারতের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন। পরিস্থিতি প্রশমনে কিছুদিনের জন্য নিজেকে আড়াল করতে অস্ট্রেলিয়া সফরে গেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ ইস্যুতে মির্জা ফখরুলের ভাষ্য: বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগ ইস্যুতে গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নেবে। কিন্তু যে ব্যক্তি গণহত্যা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তারা যেন নির্বাচনে অংশ না নেন, সেটাই আমাদের বক্তব্য। কোনো দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে তো আপত্তি করার কিছু নেই।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা চাই না, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই। কারণ, আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। তবে আওয়ামী লীগের যারা নানা অপরাধ করেছেন, যারা গণহত্যা করেছেন, সেই ব্যক্তিরা রাজনীতি করতে পারবেন না, জনগণ সেটা চায়। তাদের অপরাধের বিচার করতে হবে। কিন্তু গণতন্ত্রে কোনো দলের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া যায় না।’
আওয়ামী লীগ ইস্যুতে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ভাষ্য: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়ে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘কে নির্বাচনে আসবে বা আসবে না সেটা নির্বাচন কমিশনের বিষয়। গত ১৫ বছর যারা জবরদখল করেছে, জনগণের অধিকার হরণ করেছে, খুনখারাবি-লুটপাট করেছে, তাদের অপরাধের বিচার হতে হবে।’
সোহেল আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, যারা বছরের পর বছর জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে, যারা বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছিল, লুটেরা সেই গোষ্ঠী যদি বিচার ছাড়াই ভোটের মাঠে ঘোরাফেরা করে, তবে তা ভোটের পরিবেশকে বিনষ্ট করতে পারে।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মনে করে আওয়ামী লীগের নির্বাচন করার নৈতিক শক্তি নেই। ছাত্রসমাজ তাদের ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।’ বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ড. খোন্দকার আকবর হোসেন বাবলু বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করুক তা কোনোমতেই তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তো বটেই এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মেনে নেবে না। স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট মাফিয়া শেখ হাসিনার বাকশালী আওয়ামী সরকার গত ১৫ বছর ধরে শুধু তার বিরোধী পক্ষকেই দমন-নিপীড়ন, নির্যাতন করে নাই, এ দেশের রাষ্ট্রের মূল অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করে দেশকে দেউলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।’
‘দেশের মানুষকে পরিকল্পিতভাবে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়ে মানুষের ভেতরে হিংসা-বিদ্বেষ উসকে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতার অহিংস আন্দোলনকে শেখ হাসিনার পোষা দলীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং তার আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনী দিয়ে যে জেনোসাইড করেছে তার ক্ষত কখনই পূরণ হওয়ার নয়। তাই এই সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া তো অনেক দূরের কথা, এই অভিশপ্ত দলকে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।’ বলেন বাবলু।
ভারত ইস্যুতে মির্জা ফখরুলের ভাষ্য: সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সব সময় খুব ভালো ছিল। কিন্তু বিএনপি ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল। আমি মনে করি, বরফ গলতে শুরু করেছে। আমি আশা করি, এবার এটা (সম্পর্ক) আরও ভালো হবে। তারা (ভারত) আমাদের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবে। আমরা এটা বিশেষ করে আবারও বলেছি যে ভারতের এ দেশের মানুষের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তাদের সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা উচিত নয়। তাদের উচিত জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক উন্নয়ন করা।’
ভারত ইস্যুতে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভাষ্য: ভারত ইস্যুতে গত রোববার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘দিল্লির নীতি-নির্ধারকরা বাংলাদেশের মানুষকে পছন্দ করেন না। তারা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের কিছু লোককে পছন্দ করেন। তা না হলে গরিব কিশোরী ফেলানি, স্বর্ণা দাসকে তারা গুলি করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে আর কুখ্যাত মনিরুল ইসলামরা ভারতবর্ষে ঘোরাফেরা করেন। তাদের ভিসা পাসপোর্ট কোথায়? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একচোখা নীতি ভারতের। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অবজ্ঞা করে।’
ভারত ইস্যুতে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘প্রতিবেশী বড় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে দায়িত্ব সেই দায়িত্ব তারা কখনোই পালন করেনি। তারা নিজেদের স্বার্থে সবসময়ই বাংলাদেশে নতজানু সরকার চেয়েছে, জনগণের সরকার থাকুক এটা চায়নি। এ কারণে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যতক্ষণ না তাদের নীতি পরিবর্তন করছে ততক্ষণ বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব কমছে না।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে সবার সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক চাই। কিন্তু তারা খুনি ফ্যাসিস্ট সরকারকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রেখেছিল। যে কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে ধিক্কার জানায়। আমরাও ধিক্কার জানাই।’
মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ড. খোন্দকার আকবর হোসেন বাবলু বলেন, ‘ভারত ইস্যুতে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের যে মত সেটাই আমার মত। অর্থাৎ আমাদের সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে। আমরা শুধু দিয়েই যাবো, বিনিময়ে পাবো তুচ্ছতা আর দাদাগিরি, সেটা আর হবে না। বিএনপির শাসনামলে এবং ভবিষ্যতে বিএনপি যদি সরকার গঠন করে তাহলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে যেটা ছিল এবং হবে, তার ভিত্তিতেই হবে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক।’