নিজস্ব প্রতিবেদক : অন্যের হয়ে জেল খাটা মিনু আক্তারের কারামুক্তির ১৩ দিনের মাথায় ‘ট্রাকচাপায়’ মৃত্যু ঘিরে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ট্রাকচাপার ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা, না পরিকল্পিত হত্যা- তা খতিয়ে দেখতে মিনুর সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তলব করেছে হাই কোর্ট। সেই সাথে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কুলসুমা আক্তার কুলসুমী প্রতারণার মামলায় যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাও তলব করা হয়েছে। সন্তানদের ভরণ-পোষণের ‘মিথ্যা আশ্বাসে’ এই কুলসুমীর হয়েই জেলে গিয়েছিলেন মিনু আক্তার।
আগামী ১ সেপ্টেম্বর দুই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে মামলার নথি (কেস ডকেট -সিডি) নিয়ে হাই কোর্টে হাজির থাকতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার এই আদেশ দেয়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সরোয়ার হোসেন বাপ্পী। আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “বলা হচ্ছে মিনু আক্তার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এ ব্যপারে বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ করা হচ্ছে, সত্যিই কি এটি দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকা-। এ সংক্রান্ত একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজও আছে; যদিও তা আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।
“কিন্তু মিনু আক্তারের মৃত্যু স্থানীয়-জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে খবর-প্রতিবেদন হয়েছে। ওইসব খবর-প্রতিবেদনে ট্রাকচাপায় মিনু আক্তারের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এগুলো আদালতে উপস্থাপনের পর আদালত আদেশ দিয়েছেন। এখন সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিলে বোঝা যাবে ট্রাকচাপায় মিনু আক্তারের মৃত্যর ঘটনা আসলেই দুর্ঘটনা কিনা।”
ঘটনার পূর্বাপর : মোবাইল নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পোশাককর্মী কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবিকে হত্যা করা হয়।
ওই ঘটনায় কতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। পরে পুলিশ ২৬ অক্টোবর কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমীকে গ্রেপ্তার করে। ৩১ অক্টোবর রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এক বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকার পর ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুলসুমী জামিনে বের হয়ে আসেন। তার জামিন পাওয়ার প্রায় আট বছর পর ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এ মামলার রায় দেয়। তাতে কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়। রায়ের দিন অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সাজা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুমী ‘সেজে’ মিনু আক্তার ‘স্বেচ্ছায়’ সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল কুলসুমী রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেন। ৩০ এপ্রিল হাই কোর্ট আপিল গ্রহণ করে। পরে দ-িত এই নারী জামিন আবেদন করলে চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট তা বাতিল করে দেয়।
এদিকে গত ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর চতুর্থ দায়রা জজ আদালতকে চিঠি দিয়ে জানান, কারাগারে থাকা নারী দ-িত কুলসুমী নন। পরদিন কারাগারে থাকা মিনু আক্তারকে আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে তিনি জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে মিনু আক্তার বলেছিলেন, মর্জিনা নামের এক নারী তাকে ‘চাল, ডাল’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেলে ঢোকায়। প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তারকে তিনি চেনেন না।
আদালতও তখন কারাগারের নিবন্ধন দেখে আসামি কুলসুমী ও সাজাভোগকারীর মধ্যে অমিল খুঁজে পান। তখন আদালত কারাগারের নিবন্ধনসহ সংশ্লিষ্ট কিছু নথি হাই কোর্টে কুলসুমীর করা আপিলের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য পাঠায়। ওই ঘটনা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে আইনজীবী শিশির মনির তা হাই কোর্টের নজরে আনেন। এ বিষয়ে শুনানির পর গত ৭ জুন মিনু আক্তারকে মুক্তির নির্দেশ দেয় আদালত। সেই সাথে দ-িত কুলসুমীকে দ্রুত গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ১৬ জুন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান মিনু আক্তার। ১৩ দিনের মাথায় গত ২৮ জুন রাত সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোডে তিনি ‘ট্রাকচাপা’ পড়েন। তবে পুলিশ মিনু আক্তারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার কথা জানায় পাঁচ দিন পর। মিনুর মৃত্যুর এক মাস পর গত ২৮ জুলাই গভীর রাতে চট্টগ্রামের ইপিজেড থানাধীন ২ নম্বর মাইলের মাথা কমিশনার গলি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কুলসুমীকে। তাকে সহযোগিতা করায় মর্জিনা আক্তারকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের নামে পুলিশ প্রতারণার মামলা করে। ওই মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন কুলসুমা আক্তার কুলসুমী। এদিকে মিনু আক্তারের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হলে তা খতিয়ে দেখতে হাই কোর্টে আবেদন করেন আইনজীবী শিশির মনির। সে আবেদনে শুনানির পর তলবের আদেশ দিল হাই কোর্ট।
মিনু আক্তারের মৃত্যু ঘিরে সন্দেহ, হাই কোর্টে নথি তলব
ট্যাগস :
মিনু আক্তারের মৃত্যু ঘিরে সন্দেহ
জনপ্রিয় সংবাদ