প্রত্যাশা ডেস্ক : ইউক্রেনের মারিউপোল শহরে নতুন করে আবারও যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। শহরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে নতুন করে আরেকটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল রোববার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা (বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা থেকে রাত ১টা) পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে। বেসামরিক বাসিন্দারা এই সময় শহর ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। শনিবারও এরকম একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছিল। যদিও তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গিয়েছিল।
মারিউপোলের শহর কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করেছে, যারা ব্যক্তিগত গাড়ীতে যাবেন, তারা যেন রেডক্রসের বাসের পেছনে পেছনে থাকেন। সব গাড়ির সব আসনে যাত্রীপূর্ণ করে নেওয়ারও অনুরোধ করা হয়।
এর আগেও মারিওপোল ও ভলনোভাখা শহরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা করা হয়। টানা ১১ দিন ধরে ইউক্রেনে সংঘাত চলছে। লড়াই থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেনের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তারা রাশিয়ার এই আগ্রাসনের আঘাত সহ্য করছেন। তিনি দেশের নাগরিকদের এই কঠিন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। গত শনিবার রাতে রাজধানী কিয়েভ থেকে দেওয়া এক আবেগপূর্ণ ভাষণে জেলেনস্কি বলেন, শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। তিনি নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে এবং আমাদের শহরগুলো থেকে শত্রুদের তাড়াতে হবে।
রাজধানী কিয়েভের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তীব্র লড়াই চলছে। সেখানে ঐতিহাসিক হস্তোমেল বিমানঘাঁটি দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রুশ বাহিনী। এছাড়া কিয়েভের উপকণ্ঠে অবস্থিত ছোট শহর ইরপিনে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে মস্কো।
খাবার-পানির তীব্র সংকটে মারিউপোলের বাসিন্দারা : শনিবার সকালে ইউক্রেনের বন্দর নগরী মারিউপোলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। সেখানকার বাসিন্দাদের শহর ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ওই শহরে প্রায় দুই লাখ মানুষ বসবাস করেন। রুশ বাহিনীর ক্রমাগত বোমা বর্ষণের কারণে এসব মানুষ শহরে আটকা পড়েছেন। লোকজনকে শহর ছাড়ার জন্য ৫০টি বাসের ব্যবস্থা করা হয়। বেশির ভাগ মানুষকে এই বাস পেতে শহরের কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। তবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার দুই ঘণ্টারও কম সময়ে রুশ সেনারা কামানের গোলা বর্ষণ শুরু করে। এতে যেসব বাসিন্দা শহর ছাড়তে চাচ্ছিলেন তাদের অনেকেই মাঝপথে আটকা পড়েন। কিন্তু রাশিয়া অভিযোগ করেছে তাদের সৈন্যরা নয় বরং, ইউক্রেনের সেনারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।
এদিকে ওই শহরে গত পাঁচদিন ধরে পানি, বিদ্যুৎ এবং খাবার নেই। সেখানে খাবার এবং পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, তারা শহর ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার মধ্যেই নতুন করে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। অনেকেই বোতলজাত পানি পান করছেন। কিন্তু সেটাও যথেষ্ঠ পরিমাণে নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রোববার পুলিশ বিভিন্ন দোকানপাট খুলে দিয়ে লোকজনকে সেখান থেকে খাবার নিতে বলেছে। কারণ খাবার এবং পানির তীব্র সংকটে দিন পারছে সেখানকার মানুষ। বাসিন্দাদের অভিযোগ এই যুদ্ধবিরতি আসলে মিথ্যা। গোলাবর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না। তারা বলেন, যদি আবারও যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয় তবে আমরা শহর ছাড়ার চেষ্টা করব। কিন্তু আমরা জানিনা সেটা সত্যি কিনা।
আজ তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসছে ইউক্রেন-রাশিয়া : চলমান যুদ্ধের মধ্যে আজ সোমবার তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। তবে এবারের বৈঠকটি কোথায় হচ্ছে সে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। দেশ দুটির মধ্যে প্রথম বৈঠকটি হয় ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্তে। তৃতীয় দফার বৈঠক নিয়ে বিস্তারিত কিছু না জানালেও স্থানীয় সময় শনিবার (৫ মার্চ) ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইউক্রেনের আলোচক ডেভিড আরাখামিয়া। রাশিয়ার তরফ থেকেও শুধু বলা হয়েছিল সোমবার বৈঠক হতে পারে।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। হামলা ঠেকাতে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে ইউক্রেনও। দুপক্ষের লড়াই গড়ালো ১১তম দিনে। এর আগে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বের হতে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার প্রতিনিধিদের দুই দফা আলোচনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি তারা।
এর আগে বেলারুশের গোমেল অঞ্চলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বেলারুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লাদিমির মাকেই। তবে দেশ দুটির মধ্যে প্রথম বৈঠকটি হয় ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্তে। সেসময় কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়। পরে গত বৃহস্পতিবার আবারও বৈঠক হয় দুপক্ষের। উভয়পক্ষ বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে ‘মানবিক করিডোর’ নির্মাণে সম্মত হয়। পাশাপাশি একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আগামীতে উভয়পক্ষ আবারও বৈঠকে বসার কথা জানায়। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) বেলারুশে বৈঠক শেষে টুইটারে এসব কথা জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক। এদিকে, ইউক্রেনের পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ১২ লাখের মতো মানুষ দেশ ছেড়েছেন। তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, চলমান যুদ্ধে ৪০ লাখ নাগরিক ইউক্রেন ছাড়তে পারে। তবে তাদের আশ্রয় দিতেও ইউরোপ প্রস্তুত বলে জানানো হয়েছে। কিয়েভ ছেড়ে এসব নাগরিক ইউরোপের প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও মলদোভায় প্রবেশ করছে।
ইউক্রেইনের একাধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলা হয়েছে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান : ইউক্রেইনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে একাধিক হামলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং আরও কয়েকটিতে হামলার খবর খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস। ওই হামলাগুলোতে একাধিক প্রাণহানি ও অনেকে আহত হয়েছেন, টুইটারে এক পোস্টে বলেছেন তিনি।
“স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনাগুলোতে বা স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলা চিকিৎসা নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লংঘন,” বলেছেন তিনি। রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করলেও তেদ্রোস তার সংক্ষিপ্ত পোস্টে রাশিয়ার নাম নেননি।
১১ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত, ৮৮ যুদ্ধবিমান-হেলিকপ্টার হারিয়েছে রাশিয়া: ইউক্রেন : রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি রুশ সেনাকে হত্যার দাবি করেছে ইউক্রেন। গতকাল রোববার ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ এই দাবি করেছে। একদিন আগেই ইউক্রেন রুশ বাহিনীর দশ হাজারের বেশি সদস্য হতাহতের দাবি করেছিল। তবে ইউক্রেনীয় সেনা হতাহতের সংখ্যা জানায়নি। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৮৮ বিমান ও হেলিকপ্টার হারিয়েছে রাশিয়া। এছাড়া বেশ কয়েকজন রাশিয়ান পাইলটকেও আটক করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মারিউপোলে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী রুশ সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রেখেছে। মাইকোলিয়াভ অঞ্চলে রাশিয়ার বেশ কিছু সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। ইউক্রেনের সৈন্যদের প্রতিরোধ দেখে রুশ বাহিনী মনোবল হারিয়ে ফেলছে বলেও দাবি করা হয়।
ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দারা রোববার বলেছেন, রাশিয়া বাহিনী ইউক্রেনের জনবহুল এলাকাগুলোকে নিশানা করে হামলা চালাচ্ছে। তবে ইউক্রেনের প্রতিরোধের ফলে তাদের অগ্রযাত্রা কিছুটা ধীর হয়ে গেছে। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সর্বশেষ জানিয়েছে, ইউক্রেনের প্রতিরোধের মাত্রা এবং শক্তি রাশিয়াকে বিস্মিত করছে। খারকিভ, চেরনিহিভ এবং মারিওপোলসহ একাধিক জনবহুল এলাকাকে নিশানা করে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়া ১৯৯৯ সালে চেচনিয়া এবং ২০১৬ সালে সিরিয়ায় একই কৌশল অবলম্বন করেছিল বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। তবে রাশিয়া বরাবরই বেসামরিক এলাকাগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর কথা অস্বীকার করে আসছে।
বিবিসি জানায়, যুক্তরাজ্যের উপ-প্রধানমন্ত্রী ডমিনিক রাব বলেছেন, ইউক্রেনের যুদ্ধ বছর না হলেও অন্তত কয়েক মাস ধরে চলবে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে এরই মধ্যে আশেপাশের দেশগুলোতে চলে গেছে ১৫ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার এই তথ্য জানিয়েছেন। এদের মধ্যে ছয় লাখ মানুষ প্রতিবেশী পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। এর বাইরে হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, মলদোভা, শ্লোভাকিয়াসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বাকিরা। ১১দিন আগে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছে রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এই প্রথম এত দ্রুত শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে পোল্যান্ডের সঙ্গে একটি চুক্তির বিষয়ে বিবেচনা করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। ওই চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত আমলের কিছু যুদ্ধবিমান ইউক্রেনকে দেবে পোল্যান্ড। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পোল্যান্ডকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের তিন শতাধিক সিনেটরের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈঠকে তিনি জানিয়েছেন, তার দেশের জরুরি ভিত্তিতে এখন অনেক যুদ্ধবিমান প্রয়োজন। হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা মার্কিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে পোল্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছি এবং ন্যাটোর অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও কথা বলছি। পোল্যান্ড যদি ইউক্রেনকে যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে সেটি পূরণে যুক্তরাষ্ট্র কি করবে তা নিয়েই বিশেষ করে আলোচনা চলছে।
মারিউপোলে ফের যুদ্ধবিরতি
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ