ঢাকা ১০:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’

  • আপডেট সময় : ০৯:৫৭:১০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ জুন ২০২২
  • ১২৭ বার পড়া হয়েছে

মাসুদ আনোয়ার : ২৫ জুন উদ্বোধন হয়ে গেল পদ্মা সেতুর। ১৯৭১ সালে যেমন ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের, তেমনি ২৫ জুনেও হলো আরেকটি সংগ্রামে সাফল্যের উদ্বোধন। ৭ মার্চের মতো অবশ্য এর পেছনে ২৫ বছরের লাঞ্ছনা আর বঞ্চনার ইতিহাস নেই। তবে ২৫ জুনের পেছনেও ছিল স্বাধীনতার মৌলনীতির বিরোধিতাকারী পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতাদখলকারী ব্যর্থজনদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র আর অপতৎপরতা। ৭১ সালে অগণিত স্বাধীনতাকামীর আড়ালে কিছু স্বাধীনতাবিরোধী যেমন ছিল, তেমনি ২০২২ সালে শেষ হওয়া পদ্মা সেতুর জন্ম ইতিহাসটাও ছিল কণ্টকাকীর্ণ। বিশ্ব ব্যাংকের নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও একজন শেখ হাসিনা দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, পদ্মা সেতু আমরা করবই। নিজের টাকায়।
এ যেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ‘এই দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’র মতো আত্মপ্রত্যয়ী সগর্ব উচ্চারণ। নিজের টাকায় শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু হলোই।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক এবং কিছু বাংলাদেশী ‘রাজনীতিবিদ’ ও ‘বুদ্ধিজীবী’দের হীনন্মন্যতা, চতুরতা আর গা জ্বলুনির শেষ ছিল না। এসব ‘পরশ্রীকাতরতা’ দাস্যমনোভাব-সিনড্রোমের আলোচনা করব না। কে কী করেছেন, সেটা দুনিয়াসুদ্ধ জানে। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান পুরস্কার পাওয়া দেশের সবেধন নীলমণিটি নিজের ওজন ভুলে পদ্মা সেতু বানচালের খেলায় মালকোচা মেরে নেমে পড়েছিলেন। আর প্রধান বিরোধী নেত্রী তো তার ‘বিরোধিতার জন্যে বিরোধিতা’ খেলায় ঘোষণা দিয়ে নেমে পড়েছিলেন।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু তার আগে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন উক্তি-কটূক্তি, আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনায় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে।’ এরপর ওই বছর ১২ জানুয়ারি পল্টন কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘একটা ভ্রান্ত ও ভুল ডিজাইনের উপরে পদ্মা সেতু নির্মিত হলে সেটা যে টিকবে না, সেটা তো উনি (খালেদা জিয়া) ভুল বলেননি। বরং তিনি সাচ্চা দেশপ্রেমিকের কাজ করেছেন। তোমরা এখনও অ্যালার্ট হও, চেঞ্জ দ্য ডিজাইন এবং সেটা সঠিকভাবে নির্মাণ হতে হবে।’
একটা বিশাল জাতীয় স্বার্থসম্পর্কিত কাজ নিয়ে এ ধরনের সমালোচনা বা হাস্য পরিহাস যে কতটা বালখিল্যপনা, সেটা বোঝার মতো জ্ঞানগম্যি নেই আমাদের প্রধান বিরোধীদলটির দুই সর্বোচ্চ ব্যক্তির। কেমন অবলীলায় বলে ফেললেন এসব কথা। বিশেষ করে যে দলটি বেশ কয়েকবার সরকার পরিচালনা করেছে, তাদের মুখে এ ধরনের কথাবার্তা কতটা উদ্ভট এবং অনভিপ্রেত, সেটা বোঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। এখন অবাক হয়ে ভাবি, এই লোকগুলোও একসময় আমাদের দ-মু-ের কর্তা ছিল।
পদ্মা সেতু এক সময় স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখন বাস্তব। শকুনের দোয়ায় গরু মরেনি বরং তরতাজা হয়ে কামধেনু হয়েছে। অর্থনীতিবোদ্ধারা নানা যুক্তি এবং পরিসংখ্যান দিয়ে জানাচ্ছেন এই সেতুর সম্ভাবনার পরিধি। শেখ হাসিনা সরকারের অন্ধ সমর্থক না হয়েও নিছক কা-জ্ঞানসম্পন্ন যে কেউই এর সারবত্তা বুঝতে পারছেন।
যাহোক, পদ্মা সেতুর বাস্তব অস্তিত্বকে সামনে রেখে কিছু কথা বলা যাক। তথ্যভিত্তিক কোনো কথা নয়, নেহাত তাত্ত্বিক। ভারতীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ও দেশটির একাদশ রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের একটা উক্তি খুবই জনপ্রিয়। সেটা হলো, ‘স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন হলো সেটাই, যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না’।
স্বপ্ন নিয়ে এর চেয়ে সুন্দর কথা সম্ভবত এ পর্যন্ত আর কেউ বলতে পারেনি। এপিজে আবদুল কালাম তার নিজের থেকে পেয়েছেন স্বপ্নবিষয়ক এমন এক অমিয় বাণী। মজা করে বলেছেন, তিনি হতে চেয়েছিলেন বিমানের পাইলট, কিন্তু স্বপ্ন তাকে বানিয়ে দিয়েছে রকেটবিজ্ঞানী। এপিজের কথা থাক। আমাদের একটা প্রবাদ বাক্য রয়েছে এরকম যে, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা। কথাটা ব্যঙ্গার্থে বলা হলেও একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। বঙ্গবন্ধু নিজেও বঙ্গবন্ধু হওয়ার আগে ‘ছেঁড়া কাথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন’ দেখেছিলেন। তার সে স্বপ্নে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রকাশের আগে সেটা তার মনের ভেতরই ছিল, প্রকাশ পায়নি। স্বপ্নপূরণের প্রক্রিয়ায় ৬৯-এর গণআন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। লাখ টাকার স্বপ্ন আর ছেঁড়া কাঁথায় জড়িয়ে ছিল না। রক্তঝরা যুদ্ধের তা-বে তা সারা বিশ্বকে জানান নিয়ে স্বাধীনতায় পরিণত হয়েছিল। আর ৭ মার্চ ছিল সে স্বপ্ন পূরণের সে কঠিন, যতটা না অনিশ্চিত, তার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা যাত্রায় বেরিয়ে পড়ার সবচেয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
পদ্মা সেতু নির্মাণের পেছনে স্বপ্ন ছিল। ২০০১ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দীর্ঘ ২১ বছর পর তা পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত হয়েছে। পদ্মাসেতু নির্মাণের স্বপ্নযাত্রাও কিন্তু আক্ষরিক অর্থে রক্তঝরা না হলেও ষড়যন্ত্র, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এবং নানাভাবে বাধার মুখে পড়ে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ‘ঘুমাতে না দেয়া’ ওই স্বপ্নটা একবারের জন্যেও মুখ থুবড়ে পড়েনি। তার কঠিন সঙ্কল্পের লৌহমুদ্গরের আঘাতে শেষ পর্যন্ত পাততাড়ি গুটিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক, লেজ নামিয়েছেন নোবেলবিজয়ী এবং নিজের থুতু নিজে গিলেছেন একদা ‘আপসহীন’ তকমাধারিণী তিনবারের সরকার পরিচালনা করা বিরোধীনেত্রী।
স্বাধীনতাকে যদি ধরি বঙ্গবন্ধুর ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’ এর মতো। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখাটাও শেখ হাসিনা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে দেখতে শুরু করেছিলেন। সেতুর অবয়ব দাঁড়ালেও পাড়ি দিতে হয়েছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়। ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়ে যাওয়ার পরও ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হঠাৎ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্ব ব্যাংক। নানা চেষ্টায়ও শেষ পর্যন্ত আর ফেরানো যায়নি বিশ্ব ব্যাংককে পদ্মা প্রকল্পে। বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর আগের বছর ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনুসকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এটি দিয়েই বিশ্ব ব্যাংককে পদ্মা-বিমুখ করার পেছনে প্রভাবিত করা হয়েছে। যা আকারে-ইঙ্গিতে বরাবরই এমন অভিযোগ করেছেন খোদ সরকারপ্রধান। পিছিয়ে ছিল না সুশীল সমাজও। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দাবি করেছিলেন, লাগামহীন দুর্নীতির বড় উদাহরণ পদ্মা সেতু। আর সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্রশ্ন তোলে টিআইবিও। বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, দুর্নীতি কীভাবে আমাদের পেছনে নিয়ে যাচ্ছে তার আরেকটি উদাহরণ এটি (পদ্মা সেতু)। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বিশ্ব ব্যাংকের সরে দাঁড়ানো আর নানা সমালোচনার মধ্যেও নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৩ সালে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় সরকার। সব সমালোচনা আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রমত্তা নদীর ওপর দৃশ্যমান ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের সেতু। শেখ হাসিনার ছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে দেখা লাখ টাকার স্বপ্ন এখন বিলিয়িন-ট্রিলিয়ন ডলারের জাতীয় সম্পদ পদ্মা সেতু।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইড্রো উইলসন বলেছিলেন, ‘ডব মৎড়ি মৎবধঃ নু ফৎবধসং. অষষ নরম সবহ ধৎব ফৎবধসবৎং. ঞযবু ংবব ঃযরহমং রহ ঃযব ংড়ভঃ যধুব ড়ভ ধ ংঢ়ৎরহম ফধু ড়ৎ রহ ঃযব ৎবফ ভরৎব ড়ভ ধ ষড়হম রিহঃবৎ’ং বাবহরহম. ঝড়সব ড়ভ ঁং ষবঃ ঃযবংব মৎবধঃ ফৎবধসং ফরব, নঁঃ ড়ঃযবৎং হড়ঁৎরংয ধহফ ঢ়ৎড়ঃবপঃ ঃযবস; হঁৎংব ঃযবস ঃযৎড়ঁময নধফ ফধুং ঃরষষ ঃযবু নৎরহম ঃযবস ঃড় ঃযব ংঁহংযরহব ধহফ ষরমযঃ যিরপয পড়সবং ধষধিুং ঃড় ঃযড়ংব যিড় ংরহপবৎবষু যড়ঢ়ব ঃযধঃ ঃযবরৎ ফৎবধসং রিষষ পড়সব ঃৎঁব.’
মানুষ আসলেই তার স্বপ্নের সমান বড় হতে পারে। বাস্তব স্বপ্ন ও চেষ্টা কখনোই ব্যর্থ হয় না। যদি স্বপ্নকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে পারা যায়, তাহলে তা অর্জনও করা যায়। বিশাল এই পৃথিবীতে দূর মহাকাশের নক্ষত্র থেকে আলো এসে পড়ে।
লেখক : সাংবাদিক, অনুবাদক এবং কলামনিস্ট।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’

আপডেট সময় : ০৯:৫৭:১০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ জুন ২০২২

মাসুদ আনোয়ার : ২৫ জুন উদ্বোধন হয়ে গেল পদ্মা সেতুর। ১৯৭১ সালে যেমন ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের, তেমনি ২৫ জুনেও হলো আরেকটি সংগ্রামে সাফল্যের উদ্বোধন। ৭ মার্চের মতো অবশ্য এর পেছনে ২৫ বছরের লাঞ্ছনা আর বঞ্চনার ইতিহাস নেই। তবে ২৫ জুনের পেছনেও ছিল স্বাধীনতার মৌলনীতির বিরোধিতাকারী পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতাদখলকারী ব্যর্থজনদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র আর অপতৎপরতা। ৭১ সালে অগণিত স্বাধীনতাকামীর আড়ালে কিছু স্বাধীনতাবিরোধী যেমন ছিল, তেমনি ২০২২ সালে শেষ হওয়া পদ্মা সেতুর জন্ম ইতিহাসটাও ছিল কণ্টকাকীর্ণ। বিশ্ব ব্যাংকের নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও একজন শেখ হাসিনা দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, পদ্মা সেতু আমরা করবই। নিজের টাকায়।
এ যেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ‘এই দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’র মতো আত্মপ্রত্যয়ী সগর্ব উচ্চারণ। নিজের টাকায় শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু হলোই।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক এবং কিছু বাংলাদেশী ‘রাজনীতিবিদ’ ও ‘বুদ্ধিজীবী’দের হীনন্মন্যতা, চতুরতা আর গা জ্বলুনির শেষ ছিল না। এসব ‘পরশ্রীকাতরতা’ দাস্যমনোভাব-সিনড্রোমের আলোচনা করব না। কে কী করেছেন, সেটা দুনিয়াসুদ্ধ জানে। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান পুরস্কার পাওয়া দেশের সবেধন নীলমণিটি নিজের ওজন ভুলে পদ্মা সেতু বানচালের খেলায় মালকোচা মেরে নেমে পড়েছিলেন। আর প্রধান বিরোধী নেত্রী তো তার ‘বিরোধিতার জন্যে বিরোধিতা’ খেলায় ঘোষণা দিয়ে নেমে পড়েছিলেন।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু তার আগে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন উক্তি-কটূক্তি, আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনায় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে।’ এরপর ওই বছর ১২ জানুয়ারি পল্টন কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘একটা ভ্রান্ত ও ভুল ডিজাইনের উপরে পদ্মা সেতু নির্মিত হলে সেটা যে টিকবে না, সেটা তো উনি (খালেদা জিয়া) ভুল বলেননি। বরং তিনি সাচ্চা দেশপ্রেমিকের কাজ করেছেন। তোমরা এখনও অ্যালার্ট হও, চেঞ্জ দ্য ডিজাইন এবং সেটা সঠিকভাবে নির্মাণ হতে হবে।’
একটা বিশাল জাতীয় স্বার্থসম্পর্কিত কাজ নিয়ে এ ধরনের সমালোচনা বা হাস্য পরিহাস যে কতটা বালখিল্যপনা, সেটা বোঝার মতো জ্ঞানগম্যি নেই আমাদের প্রধান বিরোধীদলটির দুই সর্বোচ্চ ব্যক্তির। কেমন অবলীলায় বলে ফেললেন এসব কথা। বিশেষ করে যে দলটি বেশ কয়েকবার সরকার পরিচালনা করেছে, তাদের মুখে এ ধরনের কথাবার্তা কতটা উদ্ভট এবং অনভিপ্রেত, সেটা বোঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। এখন অবাক হয়ে ভাবি, এই লোকগুলোও একসময় আমাদের দ-মু-ের কর্তা ছিল।
পদ্মা সেতু এক সময় স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখন বাস্তব। শকুনের দোয়ায় গরু মরেনি বরং তরতাজা হয়ে কামধেনু হয়েছে। অর্থনীতিবোদ্ধারা নানা যুক্তি এবং পরিসংখ্যান দিয়ে জানাচ্ছেন এই সেতুর সম্ভাবনার পরিধি। শেখ হাসিনা সরকারের অন্ধ সমর্থক না হয়েও নিছক কা-জ্ঞানসম্পন্ন যে কেউই এর সারবত্তা বুঝতে পারছেন।
যাহোক, পদ্মা সেতুর বাস্তব অস্তিত্বকে সামনে রেখে কিছু কথা বলা যাক। তথ্যভিত্তিক কোনো কথা নয়, নেহাত তাত্ত্বিক। ভারতীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ও দেশটির একাদশ রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের একটা উক্তি খুবই জনপ্রিয়। সেটা হলো, ‘স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন হলো সেটাই, যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না’।
স্বপ্ন নিয়ে এর চেয়ে সুন্দর কথা সম্ভবত এ পর্যন্ত আর কেউ বলতে পারেনি। এপিজে আবদুল কালাম তার নিজের থেকে পেয়েছেন স্বপ্নবিষয়ক এমন এক অমিয় বাণী। মজা করে বলেছেন, তিনি হতে চেয়েছিলেন বিমানের পাইলট, কিন্তু স্বপ্ন তাকে বানিয়ে দিয়েছে রকেটবিজ্ঞানী। এপিজের কথা থাক। আমাদের একটা প্রবাদ বাক্য রয়েছে এরকম যে, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা। কথাটা ব্যঙ্গার্থে বলা হলেও একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। বঙ্গবন্ধু নিজেও বঙ্গবন্ধু হওয়ার আগে ‘ছেঁড়া কাথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন’ দেখেছিলেন। তার সে স্বপ্নে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রকাশের আগে সেটা তার মনের ভেতরই ছিল, প্রকাশ পায়নি। স্বপ্নপূরণের প্রক্রিয়ায় ৬৯-এর গণআন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। লাখ টাকার স্বপ্ন আর ছেঁড়া কাঁথায় জড়িয়ে ছিল না। রক্তঝরা যুদ্ধের তা-বে তা সারা বিশ্বকে জানান নিয়ে স্বাধীনতায় পরিণত হয়েছিল। আর ৭ মার্চ ছিল সে স্বপ্ন পূরণের সে কঠিন, যতটা না অনিশ্চিত, তার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা যাত্রায় বেরিয়ে পড়ার সবচেয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
পদ্মা সেতু নির্মাণের পেছনে স্বপ্ন ছিল। ২০০১ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দীর্ঘ ২১ বছর পর তা পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত হয়েছে। পদ্মাসেতু নির্মাণের স্বপ্নযাত্রাও কিন্তু আক্ষরিক অর্থে রক্তঝরা না হলেও ষড়যন্ত্র, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এবং নানাভাবে বাধার মুখে পড়ে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ‘ঘুমাতে না দেয়া’ ওই স্বপ্নটা একবারের জন্যেও মুখ থুবড়ে পড়েনি। তার কঠিন সঙ্কল্পের লৌহমুদ্গরের আঘাতে শেষ পর্যন্ত পাততাড়ি গুটিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক, লেজ নামিয়েছেন নোবেলবিজয়ী এবং নিজের থুতু নিজে গিলেছেন একদা ‘আপসহীন’ তকমাধারিণী তিনবারের সরকার পরিচালনা করা বিরোধীনেত্রী।
স্বাধীনতাকে যদি ধরি বঙ্গবন্ধুর ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’ এর মতো। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখাটাও শেখ হাসিনা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে দেখতে শুরু করেছিলেন। সেতুর অবয়ব দাঁড়ালেও পাড়ি দিতে হয়েছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়। ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়ে যাওয়ার পরও ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হঠাৎ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্ব ব্যাংক। নানা চেষ্টায়ও শেষ পর্যন্ত আর ফেরানো যায়নি বিশ্ব ব্যাংককে পদ্মা প্রকল্পে। বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর আগের বছর ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনুসকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এটি দিয়েই বিশ্ব ব্যাংককে পদ্মা-বিমুখ করার পেছনে প্রভাবিত করা হয়েছে। যা আকারে-ইঙ্গিতে বরাবরই এমন অভিযোগ করেছেন খোদ সরকারপ্রধান। পিছিয়ে ছিল না সুশীল সমাজও। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দাবি করেছিলেন, লাগামহীন দুর্নীতির বড় উদাহরণ পদ্মা সেতু। আর সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্রশ্ন তোলে টিআইবিও। বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, দুর্নীতি কীভাবে আমাদের পেছনে নিয়ে যাচ্ছে তার আরেকটি উদাহরণ এটি (পদ্মা সেতু)। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বিশ্ব ব্যাংকের সরে দাঁড়ানো আর নানা সমালোচনার মধ্যেও নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৩ সালে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় সরকার। সব সমালোচনা আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রমত্তা নদীর ওপর দৃশ্যমান ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের সেতু। শেখ হাসিনার ছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে দেখা লাখ টাকার স্বপ্ন এখন বিলিয়িন-ট্রিলিয়ন ডলারের জাতীয় সম্পদ পদ্মা সেতু।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইড্রো উইলসন বলেছিলেন, ‘ডব মৎড়ি মৎবধঃ নু ফৎবধসং. অষষ নরম সবহ ধৎব ফৎবধসবৎং. ঞযবু ংবব ঃযরহমং রহ ঃযব ংড়ভঃ যধুব ড়ভ ধ ংঢ়ৎরহম ফধু ড়ৎ রহ ঃযব ৎবফ ভরৎব ড়ভ ধ ষড়হম রিহঃবৎ’ং বাবহরহম. ঝড়সব ড়ভ ঁং ষবঃ ঃযবংব মৎবধঃ ফৎবধসং ফরব, নঁঃ ড়ঃযবৎং হড়ঁৎরংয ধহফ ঢ়ৎড়ঃবপঃ ঃযবস; হঁৎংব ঃযবস ঃযৎড়ঁময নধফ ফধুং ঃরষষ ঃযবু নৎরহম ঃযবস ঃড় ঃযব ংঁহংযরহব ধহফ ষরমযঃ যিরপয পড়সবং ধষধিুং ঃড় ঃযড়ংব যিড় ংরহপবৎবষু যড়ঢ়ব ঃযধঃ ঃযবরৎ ফৎবধসং রিষষ পড়সব ঃৎঁব.’
মানুষ আসলেই তার স্বপ্নের সমান বড় হতে পারে। বাস্তব স্বপ্ন ও চেষ্টা কখনোই ব্যর্থ হয় না। যদি স্বপ্নকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে পারা যায়, তাহলে তা অর্জনও করা যায়। বিশাল এই পৃথিবীতে দূর মহাকাশের নক্ষত্র থেকে আলো এসে পড়ে।
লেখক : সাংবাদিক, অনুবাদক এবং কলামনিস্ট।