প্রযুক্তি ডেস্ক: পৃথিবীর অনেক প্রাণীরই চোখে দেখা যায় এমন আলো নির্গত করার সক্ষমতা রয়েছে। তবে মানুষের বেলায় সাধারণত এমন কিছু বিবেচনা করা হয় না।
এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। ১৯২৩ সাল থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি গবেষণায় উঠে এসেছে, মানুষ এমন কিছু আলো বিকিরণ করে যেগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আসলে দৃশ্যমান হলেও এতটাই দুর্বল যে তা খালি চোখে দেখা যায় না। গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষ সত্যিই এক ধরনের আলো ছড়ায়।
নিঃসন্দেহে এটি বিতর্কিত এক বিষয়। তবে এ নির্গত আলোকে ‘বায়োফোটন’ বলা হচ্ছে, যা শনাক্ত করতে পারলে মানুষের শরীরের ভেতরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট সায়েন্স অ্যালার্ট।
সম্প্রতি মানবদেহে থেকে নির্গত এ ক্ষীণ আলো নিয়ে গবেষণা করেছেন ‘অ্যালগোমা ইউনিভার্সিটি অফ কানাডা’র জীববিজ্ঞানী হেইলি কেসির নেতৃত্বে একদল গবেষক। মানুষের মস্তিষ্ক নিঃসরিত হয় এই দুর্বল আলো। আর বিশেষ এক যন্ত্রের সাহায্যে নির্গত এ আলো পরিমাপ করতে পেরেছেন তারা। গবেষণায় উঠে এসেছে, মস্তিষ্ক যখন কোনো কাজ বা চিন্তা করে তখন এই নির্গত আলোর পরিবর্তিন ঘটে, অর্থাৎ মানুষের চিন্তা ও অনুভূতির মতো মস্তিষ্কের কার্যকলাপ এ আলোকে প্রভাবিত করতে পারে। গবেষকরা বলছেন, মস্তিষ্কের সুস্থতা যাচাইয়ের নতুন ও রোমাঞ্চকর সম্ভাবনার দিক দেখাতে পারে এ গবেষণা। তারা এ পদ্ধতির সম্ভাব্য নাম দিয়েছেন ‘ফটোএনসেফালোগ্রাফি’। এটি এখনও পুরোপুরি তৈরি না হলেও ভবিষ্যতের এমন এক প্রযুক্তি হতে পারে, যা নির্গত আলো বিশ্লেষণ করে মানুষের মস্তিষ্কের অবস্থা বোঝার সুযোগ করে দেবে। গবেষণাপত্রে উল্লেখ রয়েছে, মানব মস্তিষ্ক থেকে নির্গত অতিক্ষীণ আলোক বিকিরণ দিয়ে মস্তিষ্কের কার্যকরী অবস্থা বোঝা যায়। আর এ ধারণার প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে আমরা এ গবেষণাটি করেছি।
গবেষণার সময় অংশগ্রহণকারীরা যখন বিশ্রামে ছিলেন বা শব্দ শোনার কাজ করছিলেন তখন তাদের মস্তিষ্ক থেকে নির্গত এ ক্ষীণ আলোর পরিমাণ মাপেন গবেষকরা।
তারা বলেছেন, মস্তিষ্ক থেকে যে ক্ষীণ আলো বের হয় তা আশপাশের সাধারণ আলো থেকে আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের গবেষণার ফলাফল থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, কোনো নির্দিষ্ট কাজ করার সময় নির্গত এ আলো নির্দিষ্ট মাত্রায় গিয়ে স্থির হতে পারে।
মহাবিশ্বের যে কোনো কিছু, যার তাপমাত্রা পরম শূন্যের চেয়ে বেশি সেসব কিছুই ‘তাপ বিকিরণ’ নামে পরিচিত এক ধরনের ইনফ্রারেড রশ্মি ছড়ায়। তবে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে যে অতিক্ষীণ আলোক বিকিরণ বা ইউপিই বের হয় সেটি তাপ বিকিরণ থেকে একেবারে আলাদা এক ঘটনা।
ইউপিই বা ‘আল্ট্রাইউক ফোটন ইমিশনস’ এমন এক ধরনের দুর্বল আলো, যা মানবদেহে বিভিন্ন রাসায়নিক বা জৈবিক কাজের কারণে ইলেকট্রন যখন শক্তি হারিয়ে ফোটন বা আলোর কণা ছাড়ে তখন নির্গত হয়। এ আলো চোখে দেখা না গেলেও একেবারে স্বাভাবিক এক ঘটনা, যা দেহের জীবিত কোষে নিয়মিত ঘটছে।
গবেষণায় কেসি ও তার সহকর্মীরা দুইটি মূল লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন। একটি হচ্ছে, মস্তিষ্ক থেকে যে ক্ষীণ আলো বের হয় সেটি আশপাশের সাধারণ আলো থেকে আলাদা কি না। অন্যটি হচ্ছে, এ আলো মস্তিষ্কের কার্যকলাপের বিভিন্ন স্তরের ওপর নির্ভর করে বদলে যায় কি না।
গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের অন্ধকার একটি ঘরে রাখেন গবেষকরা, যাতে বাইরের কোনো আলো ভেতরে না আসে। এরপর অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পরিমাপের জন্য মাথায় ইইজি ক্যাপ পরানো হয়। তাদের আশপাশে ‘ফোটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব’ও বসানো হয়, এগুলো এমন এক ধরনের বিশেষ ভ্যাকুয়াম টিউব, যা অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির আলোও শনাক্ত করতে পারে। এরপর গবেষণায় তাদের দুইভাবে পরীক্ষা করা হয়। একটি, বিশ্রামের সময় যখন তারা কিছুই করছিলেন না এবং অন্যটি শব্দ শোনা বা বোঝার মতো কাজ, যেগুলো অন্ধকারেও করা যায়।
পরীক্ষার ফলাফলে উঠে এসেছে, অতিক্ষীণ আলো সত্যিই কেবল দেহের কোষের ভেতরেই আটকে নেই, বরং বাইরে থেকেও ধরা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইইজি ক্যাপে ধরা পড়া মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সঙ্গে ইউপিই-এর স্পষ্ট সম্পর্ক মিলেছে। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতের গবেষণায় যেসব বিষয় আরো বিস্তারিতভাবে গবেষণা করা যেতে পারে সেগুলো হচ্ছে, মানুষের মস্তিষ্কের গঠন বা আকৃতি ইউপিই আলোর পরিমাণে কোনো প্রভাব ফেলে কি না। কেবল বিশ্রাম ও কাজ নয়, বরং ভাবনা, আবেগ, ভয় বা স্মৃতি মনে করার মতো নানা কাজে মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া আলোর ধরন কেমন হয়। তবে এখনও বোঝা যায়নি প্রতিটি মানুষের ইউপিই স্বতন্ত্র কি না। যদি হয়ে থাকে তবে কারো মস্তিষ্কে কোনো সমস্যা বা পরিবর্তন ধরতে গেলে আগে জানতে হবে স্বাভাবিক অবস্থায় কতটা আলো নির্গত হয় তার। ফলে ‘বেসলাইন’ না জানলে বোঝা কঠিন হবে কার আলো স্বাভাবিক আর কারটা নয়। গবেষকরা বলেছেন, আমরা এই ফলাফলকে প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে দেখছি, যা থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, মানুষের মস্তিষ্ক থেকে নির্গত ইউপিই সংকেত খুব দুর্বল হলেও অন্ধকার পরিবেশে আশপাশের আলো থেকে আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব। গবেষণার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘কারেন্ট বায়োলজি’তে।