ড. হারুন রশীদ
এমন বলা হয়ে থাকে- ‘একটি মৃত্যু শোকের। কিন্তু অধিক মৃত্যু কেবলই সংখ্যা’। আমাদের দেশের অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এই কথা আরো বেশি প্রযোজ্য। যে মানুষগুলো রুটি-রোজগারের সন্ধানে সকাল বেলা কাজে এসেছিলেন তারা যে আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না- সেটি কি কেউ ভেবেছিল। কিন্তু হয়েছে তাই।
১৬ জন মানুষ রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুনের ঘটনায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন। এ ঘটনায় আহতের সংখ্যাও অনেক। গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে এই আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ‘আনোয়ার ফ্যাশন’ নামের একটি পোশাক কারখানা এবং তার পাশে থাকা টিনশেড ঘরে রাসায়নিকের গুদামে আগুন পুড়িয়ে দেয় অনেক জীবন, বহু মানুষের স্বপ্ন।
অতি লাভ ও লোভের আশায় আমরা ঢাকা শহরটাকে অ্যাটম বোমা বানিয়ে রেখেছি। যেখানে আবাসিক এলাকা সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে কেমিক্যাল গুদাম। একটা বিল্ডিং এর গা ঘেঁষে আরেকটি বিল্ডিং। সূর্যের আলোও ঢুকে না। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকবে তো দূরের কথা। শহরের ভেতরে তো গার্মেন্টস কারখানাও থাকার কথা না। ইপিজেড এলাকায় অথবা কোনো নিরাপদ স্থানে হবে গার্মেন্টস।
বিদেশি ক্রেতারা গার্মেন্টস এর নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জন্য নানা রকম চাপ দেয়, শর্তারোপ করে। এরপরও গার্মেন্টস কারখানা থেকে যায় অনিরাপদ। পোশককর্মীর জীবন যায়। অনিশ্চিত হয়ে পরে পোশাক খাতের রেমিট্যান্স। অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়তো নানাভাবে পুষিয়ে নেয়া যায় কিন্তু জীবন গেলে আর তো আসে না।
পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার কেমিক্যালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭১ জন নিহত হন। এই ট্র্যাজেডির প্রায় সাড়ে ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও মৃত্যুপুরী সেই এলাকা এখনো নিরাপদ নয়। আজ থেকে ১৬ বছর আগে ভয়াবহ নিমতলী ট্র্যাজেডির ঘটনায় আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় ১২৪ জনের। আহত হন অনেকে।
অগ্নি দুর্ঘটনার পর নিয়মমাফিক বাণী বিবৃতি আসে শোক জানিয়ে। কিন্তু ঘটনা ঘটতেই থাকে প্রতিকারহীনভাবে। অগ্নি দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিসংখ্যান তো অনেক। তাহলে সেসব থেকে আমরা কোনো শিক্ষা নিই না কেন? প্রশাসন, গার্মেন্টস মালিক সংশ্লিষ্ট সবাই কেন ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন সরব থেকে চুপ হয়ে যাই। যতক্ষণ আরেকটা দুর্ঘটনা না ঘটছে। আসলে এগুলো কি দুর্ঘটনা নাকি মানুষের অপরিণামদর্শিতার ফল?
আরো কিছু পরিসংখ্যান হাজির করি। ফায়ার সার্ভিসের সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনাগুলোতে ৭৯২ কোটি টাকার বেশি সম্পদের ক্ষতি হয় এবং ১০২ জন নিহত হন। ২০২৪ সালে সারাদেশে মোট ২৬ হাজার ৬৫৯টি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪০ জন, আহত হয়েছেন ৩৪১ জন। ২০২৫ সালের প্রথম ৭ মাসে ১৫৪ জন আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা গেছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক পণ্যের গুদাম রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসাবাড়িতেই। তাছাড়া সারা ঢাকা শহরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থা ৪,৮৫০টিরও বেশি গোডাউনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার মধ্যে মিরপুর ও উত্তরা রয়েছে। এসব তথ্য আমাদের আতঙ্কগ্রস্ত করে।
দুই.
অগ্নি দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ, এবং নিয়মকানুন না মানা। এই দুর্ঘটনা রোধে ভবন নির্মাণের সময় অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিয়মিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করা, এবং জরুরি পরিস্থিতিতে কী করণীয়, এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
অনেক ভবন নির্মাণে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে না। ত্রুটিপূর্ণ ওয়্যারিং এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের অপব্যবহার থেকে প্রায়শই আগুনের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের অবহেলাজনিত আগুন, গ্যাসের চুলা বা অন্য কোনো দাহ্য পদার্থের কাছাকাছি খোলা আগুন রাখা বা ভুল ব্যবহার করা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সরু রাস্তা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ অগ্নিকাণ্ডের সময় উদ্ধার কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। রাস্তা সরু থাকায় ফায়ার সার্ভিসে গাড়ি অনেক সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না।
অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন ও নিয়মকানুন অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না। ভবন নির্মাণেই ফায়ার সেফটি বা অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি বহির্গমন পথ, ধোঁয়া ও আগুন প্রতিরোধী জরুরি দরজা থাকা জরুরি। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, গ্যাসের লাইন এবং অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিপূর্ণ সরঞ্জাম নিয়মিত পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করেন বা কাজ করেন, তাদের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের উপায় এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ ও শিল্পাঞ্চলগুলোতে, ফায়ার হাইড্রান্ট স্থাপন এবং আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
অগ্নিনরাপত্তা সংক্রান্ত সরকারি নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এর জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জরুরি পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরতে হবে। মাথা ঠান্ডা রাখা এবং প্রথমেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সুইচ বন্ধ করার চেষ্টা করতে হবে এবং বিলম্ব না করে নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে জরুরি নম্বর ডায়াল করে জানাতে হবে। জরুরি বহির্গমন পথ ব্যবহার করে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হবে। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ধোঁয়া থেকে বাঁচতে ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়া এবং দরজায় পৌঁছানোর আগে দরজাটি স্পর্শ করে দেখতে হবে গরম আছে কি না। যদি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তিন.
এ সংক্রান্ত এক রিপোর্ট বলছে, ২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর দুর্ঘটনা রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কেমিক্যাল গুদাম অপসারণসহ ১৭ দফা নির্দেশনা দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই সুপারিশমালা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ফাইলবন্দি। এর মধ্যেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নিমতলীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। এসময়ও বেশ কিছু সুপারিশ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি। কিন্তু সুপারিশের যে কী অবস্থা তা তো মিরপুরের ট্র্যাজেডিই বলে দিচ্ছে।
আমরা স্বজন হারানোর বেদনায় আর কাতর হতে চাই না। দেখতে চাই না আর কোনো অগ্নি দুর্ঘটনা। এজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। আর এটা করতে হবে নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
drharun.press@gmail.com
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ