মাহজাবিন আলমগীর
দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন প্রতি চারজনে একজন। সবচেয়ে বেশি ভুগছেন মানসিক বিষণ্নতায়। করোনা- পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
গত ১০ অক্টোবর মানসিক রোগের ওপর একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত বিশেষ এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে মানসিক রোগীদের তিন-চতুর্থাংশ মনোবিকৃতি আর চরম বিষণ্নতায় ভোগে। মানসিক রোগের কারণগুলোর মাঝে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক চাপ এবং সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। মূলত সরকারি অবকাঠামোগত সমস্যা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না।
মানুষ যতই আধুনিক হচ্ছে, ধনবাদী সমাজে অস্তিত্বহীনতার সংকট তত প্রকট হচ্ছে। দ্রুত নগরায়ণের প্রভাবে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় নানা মানসিক টানাপোড়েনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নিত্যদিন। বেড়ে যাচ্ছে অবসাদগ্রস্ততা, বিষণ্নতার মতো নানা জটিল মানসিক ব্যাধি।
বর্তমান যুগে ইন্টারনেটের অতি আসক্তি মানুষের মানবিক স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এরূপ ব্যক্তি সমাজ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেন। বাস্তব জগতের চেয়ে ভার্চুয়াল জগৎই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অধিক ডিজিটাল আসক্তি থেকে ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। ঘুমের স্বল্পতার কারণে ব্যক্তির মেজাজ খিটখিটে ও রুক্ষ হয়ে ওঠে; যা থেকে নানা মানসিক সমস্যার সূত্রপাত।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ভূত একাকিত্ব মানসিক বিকারগ্রস্ততার দিকে ঠেলে দিচ্ছে মানুষকে। বাবা-মা, সন্তানসন্ততি একই ছাদের নিচে বসবাস করেও যেন পরস্পর বিচ্ছিন্ন। কেবল তা-ই নয়; নেহাত প্রয়োজন ছাড়া আত্মীয়স্বজন কেউ কারো খোঁজখবর নিতে চায় না। এসব সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে বাড়ছে মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা আর আত্মহত্যার প্রবণতা। অথচ সমাজবদ্ধভাবে মিলেমিশে থাকাই মানসিক প্রতিকূলতা কাটাতে সাহায্য করে।
শরীর থাকলে যেমন তা অসুস্থ হয়; তেমনি মন থাকলে মনের অসুখ হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার; কোনো লজ্জা বা পরিতাপের নয়। অথচ আমাদের সমাজে মানসিক রোগীদের পরিবার থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সঠিক চিকিৎসা থেরাপি আর সমর্থন পেলে মানসিক ব্যাধি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। নিয়মিত ওষুধ সেবন, মেডিটেশন এবং বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের পূর্ণ সমর্থন পেলে মানসিক রোগী সম্পূর্ণ সেরে উঠতে পারেন।
সমাজে মানসিক রোগের বিষয়টি পুরোপুরি অবহেলা করা হয়। এমনকি শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও অনেক সময় দেখা যায়, কারও মানসিক সমস্যা থাকলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে না গিয়ে কবিরাজ দিয়ে ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া ইত্যাদির আশ্রয় নেওয়া হয়। এসব অপচিকিৎসায় অনেক সময় রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। দীর্ঘকাল লালিত অন্ধবিশ্বাসই যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে।
গভীর পরিতাপের বিষয়, দেশে জনসংখ্যার তুলনায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল, প্রতি এক লাখ জনের জন্য শূন্য দশমিক ১৩ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। এটি বড়ই আক্ষেপের বিষয়। আজ যুগের প্রয়োজনেই সময় এসেছে মানসিক রোগ নিয়ে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করার।
শরীর আর মন একে অন্যের পরিপূরক। মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিত হলে সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতেই মানসিক রোগীর চিকিৎসার দিকটি নিশ্চিত করতে হবে।
একজন মানসিক রোগীকে পরিবার থেকে আলাদা করে নয়; বরং পরিবারের সদস্যদের পূর্ণ সমর্থন, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক রোগীর চিকিৎসায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। তাই পরিবারের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক সংস্কার আর ট্যাবু ভাঙার আজ সময় এসেছে। এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সরকারি অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ এবং দক্ষ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে।
লেখক: শিক্ষক, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























