প্রযুক্তি ডেস্ক: জাতিসংঘ পরামর্শ দিচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন কেবল আমাদের সময়েরই বড় সংকট নয়, বরং আমরা এখন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রয়েছি, যেখানে আবহাওয়ার ধরন বদলে যাচ্ছে, যা হুমকির মুখে ফেলছে খাদ্য উৎপাদনকে। একইসঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা হতে পারে।
এমন পরিস্থিতি এড়াতে বিভিন্ন দেশকে কঠোর ও বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে পৃথিবীর জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যে এমন ক্ষতির মুখে পড়বে, যা আর ফেরানো সম্ভব হবে না বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট হাওস্টাফওয়ার্কস। তবে কেবল সরকার নয়, পৃথিবীকে বাঁচাতে আমরা নিজেরা কী করতে পারি? আসলে, প্রতিদিন কিছু ছোট কাজ করলেই আমরা আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে ও পৃথিবীর ক্ষতি ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারি। পৃথিবীর যত্ন নেওয়া কেবল সম্ভব নয়, এটা প্রয়োজনও। সেই ভাবনা থেকেই পৃথিবীকে আমরা কীভাবে রক্ষা করতে পারি তা জেনে নেওয়া যাক-
পানি সাশ্রয়: ছোট ছোট কাজের মাধ্যমেই বড় পরিবর্তন আসে। দাঁত ব্রাশ করার সময় ট্যাপ বন্ধ রাখার মাধ্যমে এরইমধ্যে পৃথিবীর উপকার করছি আমরা। কারণ, মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ইপিএ বলছে, ট্যাপ সময়মতো বন্ধ না করার ফলে প্রতিদিন প্রায় তিনশ ৪০ লিটার পানি অপচয় হতে পারে। ফলে যত দ্রুত সম্ভব আমরা এ কাজটি করতে পারি, যা আমাদের জন্য করাও সহজ। বোতলজাত পানি পান করাও বন্ধ করতে পারি। এর বদলে ফিল্টার করা কলের পানি পান ভাল। এতে টাকাও বাঁচবে এবং প্লাস্টিক বর্জ্যও অনেক কমে আসবে।
হাঁটা, সাইকেল চালানো বা গণপরিবহনের ব্যবহার: হাঁটা ও সাইকেল চালানো কেবল কার্বন নিঃসরণ কমায় না, আমাদের শরীরের জন্যও উপকারী। যেমন-হাঁটার মাধ্যমে আমাদের দেহের ফিটনেস বাড়ে ও ক্যালোরি পোড়ে। তবে আমরা যদি এমন এলাকায় থাকি, যেখানে হাঁটা বা সাইকেল চালানো কঠিন, সেক্ষেত্রে আমরা গণপরিবহন ব্যবহার করতে পারি। একটি গাড়িও যদি রাস্তায় কম নামে তাহলেও পৃথিবী কিছুটা বাঁচবে।
এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল অস্ট্রেলিয়ার সাইকেল প্রোমোশন ফান্ড। তারা দেখিয়েছে রাজপথে ৬৯ জন ব্যক্তির জন্য কতটা জায়গা দখল হয় ও এতে দূষণ কতটা হয়।
রিডিউস, রিইউস, রিসাইকেল: একটি সোডার ক্যান রিসাইকেল বিনে ফেলেও আমরা পরিবেশ দূষণ কমাতে পারি। ‘ব্রিগহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটি’র তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর গড়পড়তা আমেরিকান পরিবার প্রায় ১৩ হাজারটি কাগজের টুকরা ফেলে দেয়, যার মধ্যে বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয় চিঠি বা প্যাকেজিং। আমরা চাইলে বাজারে নিজেদের পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন ব্যাগ নিয়ে যেতে পারি, ডিসপোজেবল বা একবার ব্যবহার করা যায় এমন প্লেট, কাপ, চামচ, ন্যাপকিনের ব্যবহার বন্ধ, বিভিন্ন অনলাইন অর্ডার একসঙ্গে কিনতে এবং রিসাইকেল করা উপাদান দিয়ে তৈরি পণ্য কেনা বাড়াতে পারি। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে আমরা যেন নিজেদের ব্যবহৃত কাগজ, প্লাস্টিক ও ক্যান রিসাইকেল করতে না ভুলি।
টেকসই খাবার খাওয়া: বর্তমানে দিনে বড় আকারে খাবারের উৎপাদন ব্যবস্থা মোট কার্বন নিঃসরণের প্রায় ২৫ শতাংশের জন্য দায়ী। এক্ষেত্রে আমরা প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে কাজ করে ও জমিতে যতটা সম্ভব কম প্রভাব ফেলে এমন খাবার কৃষকদের কাছ থেকে কিনতে পারি। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি, ফল, বাদাম বেশি কিনতে পারি। পাশাপাশি লাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খেতে পারি। সম্ভব হলে নিজের বাড়িতে ছোট এক সবজি বাগান তৈরি করতে পারি, যা বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
গাছ লাগানো: ২০২৩ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে খারাপ। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে ও বেশিরভাগ দেশ কার্বন নির্গমন কমাচ্ছে না। এখনকার পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। তবে সহজ ও প্রাকৃতিক উপায় আছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, তা হচ্ছে গাছ লাগানো। একটি গাছ প্রতি বছর প্রায় ৫ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। আর ১০ বছর বয়সী গাছ হলে তা বছরে প্রায় ২১ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে! গাছ কেবল কার্বন নয়, বাতাসের সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসহ নানা দূষণও কমিয়ে আনে। ফলে আজই একটি গাছ লাগান, যা আমার, আপনার, পৃথিবীর, সবার জন্য মঙ্গলকর।
প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ: জাতিসংঘের ইউএনইপি-এর তথ্য বলছে, মানুষ প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক বোতল কেনে এবং বছরে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার হয় পাঁচ লাখ কোটি! এসব প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহার হয় কেবল ৯ শতাংশ। অন্যদিকে, সমুদ্রে জমে রয়েছে সাড়ে সাত থেকে প্রায় দুশো কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য। আমাদের এ চক্র ভাঙতে হবে। এজন্য আমরা বোতলজাত পানি কিনব না, কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের চেষ্টা করব, প্লাস্টিক স্ট্র-এর ব্যবহার বন্ধ ও পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন কাপ ব্যবহার করব। এসব ছোট ছোট কাজের মাধ্যম আমরা অসংখ্য টন প্লাস্টিক বর্জ্যকে সমুদ্র ও মাটিতে যাওয়া থেকে ঠেকাতে পারব। পৃথিবীই আমাদের ঘর। একটু সচেতনতা, একটু যত্ন– এসব মিলিয়েই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর ও টেকসই পৃথিবী রেখে যেতে পারব। আজই শুরু হোক, ছোট পরিবর্তনেই আসবে বড় পরিবর্তন।
শক্তি সাশ্রয়ী জীবনযাপন: এক্ষেত্রে বাড়িতে সামান্য পরিবর্তন আনলেই শক্তি ও টাকা দুটোই বাঁচবে। পুরানো বিভিন্ন জানালা ঘরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে না। ফলে গরমে ঘর বেশি গরম হয় ও ঠান্ডায় বেশি ঠান্ডা। সম্ভব হলে আমরা শক্তিসক্ষম জানালা ব্যবহার করতে পারি। এসে এসির ব্যবহার কমে আসবে। বাড়ির ইনসুলেশন বা তাপ নিরোধক ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না তা-ও দেখে নিতে পারি আমরা। ইনসুলেশনের কার্যকারিতা বোঝা হয় ‘আর-ভালব’ দিয়ে, এর যত বেশি মান তা তত ভালো ইনসুলেশন। এ ছাড়া ছোট ছোট পদক্ষেপও গুরুত্বপূর্ণ, যেমন– নিয়মিত এয়ার ফিল্টার বদলানো, প্রচণ্ড গরম বা ঠান্ডায় জানালার পর্দা টেনে রাখা।
সানা/আপ্র/১৯/১০/২০২৫