নিজস্ব প্রতিবেদক : ওনাইসী সাঈদ ওরফে রেয়ার সাঈদ। একসময় আমেরিকায় পড়াশুনা করতেন। সেখান থেকে ধারণা আনেন ভয়ঙ্কর মাদক ‘কুশ’-এর। দেশেই শুরু করেন চাষ। এজন্য প্রধান উপকরণের ‘বীজ’ আনতেন আমেরিকা থেকে। তাছাড়া অপ্রচলিত ও নতুন মাদক ‘এক্সট্যাসি’ বিদেশ থেকে কখনো নিজে কখনো পার্সেলের মাধ্যমে আমদানি করতেন। আর টাকা পাঠাতেন হুন্ডির মাধ্যমে। এরপর বিশ্বস্ত সার্কেলের মাধ্যমে হাতে হাতে তা রাজধানীর বিভিন্ন পার্টিতে সরবরাহ করতেন।
র্যাব বলছে, নতুন নতুন মাদক কিভাবে উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি ও বাজারজাত করা যায় তা নিয়ে বিস্তর অধ্যয়ন করতেন সাঈদ। এ লক্ষ্যে তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে তাপ নিয়ন্ত্রণ গ্রো-টেন্টের মাধ্যমে অভিনব পন্থায় বিদেশি প্রজাতির কুশ তৈরির প্লান্ট ও সেটআপ করেছিলেন।
গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে ‘এক্সট্যাসি’ নামক একটি নতুন মাদকের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানতে পেরে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ায়।
সর্বশেষ সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশান থেকে সাঈদকে গ্রেপ্তার করে র্যাবের একটি দল। এ সময় বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অপ্রচলিত মাদক এক্সট্যাসি, কুশ, হেম্প এবং মলি, এডারল, ফেন্টানিলসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার ও প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের দেশি ও বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়। এক্সট্যাসি হলো মেথানিল ডাই অক্সি মেথাফিটামিন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রচলিত নয়; কিন্তু বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রচলিত এমন কিছু মাদকের ব্যবহার বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যাতে ধীরে ধীরে আমাদের যুব সমাজ এতে আসক্ত হয়ে উঠছে। তার প্রমাণ এই নতুন মাদকের সন্ধান। র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এর অভিযানে রাজধানীর গুলশান এলাকা হতে ওনাইসী সাঈদকে গ্রেপ্তার করে। এসময় ১০১ গ্রাম কুশ, ৬ গ্রাম হেম্প, ০.০৫ গ্রাম মলি, ১ গ্রাম ফেন্টানল, ১৮ গ্রাম কোকেন, ১২৩ পিচ এক্সট্যাসি, ২৮ পিচ এডারল ট্যাবলেট এবং ২ কোটি ৪০ লাখ নগদ টাকা ও অর্ধলক্ষাধিক মার্কিন ডলার। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদপুরের একটি ফ্ল্যাট বাসা থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে তাপ নিয়ন্ত্রণ গ্রো-টেন্ট এর মাধ্যমে অভিনব পন্থায় বিদেশি প্রজাতির কুশ তৈরির প্ল্যান্ট ও সেটআপ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ওনাইসী সাঈদ তার মাদক কারবার সংশ্লিষ্টতার নানা তথ্য দিয়েছে র্যাবকে।
র্যাব কমান্ডার মঈন বলেন, সাঈদ বাংলাদেশে একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কলেজ থেকে পড়াশুনা শেষ করে আমেরিকায় যায়। সেখানে বিবিএ ও মালয়েশিয়ায় গিয়ে এমবিএ সম্পন্ন করে। ২০১৪ সাল থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছিল সাঈদ। থাইল্যান্ডে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের ফয়সাল নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে ওনাইসী সাঈদ নতুন নতুন মাদক সম্পর্কে জানতে পারেন। ব্যবসায়িকভাবে নতুন মাদক কারবারে আগ্রহী হন। ফয়সালই প্রথম বিভিন্ন ধরণের অপ্রচলিত মাদক সরবরাহ করে আসছিল। থাইল্যান্ড থেকে বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করা ফয়সালই নতুন মাদক সরবরাহকারী। আর এভাবেই সাঈদ আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, বাংলাদেশে নতুন মাদক ‘এক্সট্যাসি’র অন্যতম সরবরাহকারী সাঈদ প্রায় চার বছর যাবত এক্সট্যাসিসহ অন্যান্য উচ্চমূল্যের মাদকের কারবারের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে ৭/৮ জন তার সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে।
পার্সেলের মাধ্যমে মাদক সংগ্রহ: বাংলাদেশে অপ্রচলিত মাদক এক্সট্যাসি, কুশ, হেম্প এবং মলি, এডারল, ফেন্টানিলসহ অন্যান্য মাদক পার্সেলের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ হতে সংগ্রহ করে থাকে। মাঝে মধ্যে সাঈদ নিজেও বিদেশে গিয়ে লাগেজে এসব মাদক বহন করে দেশে নিয়ে আনতেন। তবে পার্সেলে মাদক আনার ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করতেন। আর হুন্ডির মাধ্যমে সরবরাকৃত মাদকের অর্থ পরিশোধ করতেন তিনি।
মাদকের ক্রেতা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান: অধিকাংশ ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানেরা সাঈদের নতুন মাদকের ক্রেতা। এছাড়া অভিজাত এলকায় বিভিন্ন পার্টিতে চাহিদার ভিত্তিতে সরবরাহ করে থাকে। মাদক পরিবহনের ক্ষেত্রে বিশ্বস্তদের নিয়োগ করেন সাঈদ। এই বিশ্বস্তরা মাদক বিক্রিলব্ধ টাকা তার কাছে পুনরায় পৌঁছে দিতেন। তার নতুন মাদকের ব্যবহার হতো বিভিন্ন হোটেল-বারের পার্টিতে। জিজ্ঞাসাবাদে সাঈদ জানিয়েছেন, তিনি ২০১৪ সালের পর থেকে ধূমপান ও অ্যালকোহলে আসক্ত হলেও নিজে কখনো নতুন মাদকে আসক্ত হননি। তবে তিনি নতুন বিভিন্ন মাদকের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টির ফলে তা নিয়ে অধ্যায়ন এবং গবেষণা শুরু করেন। এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, প্রতি মাসে ৪০ থেকে ৫০ পিস কুশ মাদক তৈরি করে তা বিক্রি করতেন সাঈদ। প্রতি পিস তৈরিতে তার সবমিলে খরচা হতো ৪/৫ হাজার টাকা। কিন্তু তিনি তা বিক্রি করতেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। পার্সেলে ও নিজে বহন করার সময় এই নতুন মাদক তল্লাশি করা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, সাঈদ নিজে গত ডিসেম্বর ও গত এপ্রিলে লাগেজে করে এই মাদক আনেন। কিন্তু বাংলাদেশে কখনো তার মাদকের চালান আটকা পড়েনি। তবে কিছুদিন আগে কানাডাতে তার একটি চালান আটকে যায়।
সাঈদের আত্মীয়-স্বজনরাও জানে না: বিদেশ থেকে নতুন মাদক পার্সেলে আনার ক্ষেত্রে তিনি আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করতেন। তবে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আনা সেই মাদকের পার্সেল তিনি নিজে রিসিভ করতেন। আত্মীয়-স্বজনরা মনে করতেন, উন্নত দেশে তার যাতায়াত, পার্সেল আসা স্বাভাবিক। তবে পার্সেলে যে মাদক আসছে তা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানতেন না।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন নতুন মাদক প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে উন্নত দেশে সরবরাহের লক্ষ্যে কুশ প্ল্যান্টের ফার্ম তৈরি করেন সাঈদ। টেস্ট অ্যান্ড ট্রায়াল হিসেবে তিনি গত সাত মাস আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ভাড়া ফ্ল্যাটের ভেতরে তাপ নিয়ন্ত্রণ গ্রো-টেন্ট পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন। সেই ফার্ম হতে একবার হারভেস্ট ও পরবর্তীতে প্রসেস করে কুশ মাদক উৎপাদন করেন, যা বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদকাসক্ত ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। নতুন মাদক প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে বিক্রি করে ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হওয়াই ছিল সাঈদের লক্ষ্য।
সাঈদের বিরুদ্ধে তিন মামলা: নতুন মাদকের আমদানি, প্রক্রিয়াজাতের বিষয়টি তদন্ত করবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সাঈদ এই নতুন মাদকের আমদানি করতে গিয়ে বিদেশে মুদ্রা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন। সবমিলে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, মাদক মামলা, বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হবে। সিআইডি মানি লন্ডারিং মামলা তদন্ত করবে।
শক্তিশালী মাদক ‘ফেন্টালন’ ও ‘কুশ’ : এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, আমরা জব্দকৃত সব মাদক ল্যাবে পরীক্ষা করবো। আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, আফিমের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী মাদক ‘ফেন্টালন’। আর মারিজুয়ানার চেয়ে ১২ গুণ বেশি শক্তিশালী মাদক ‘কুশ’। এসব মাদক সেবনে স্নায়ু উদ্দীপনা তৈরি করে। ৪/৫ ঘণ্টার জন্য পার্টি মুড তৈরি করে। এখন পর্যন্ত সাঈদ ১০০ গ্রাম কুশ মাদক বিক্রি করেছে তিন লাখ টাকায়। এভাবে ৪০০ গ্রাম বিক্রি করেছে।
মাদক বিজ্ঞানী গ্রেপ্তার
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ