আবুল মোমেন : অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ছয় সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও মাঠ পর্যায়ে অর্থাৎ জেলা থেকে পরবর্তী ধাপের প্রশাসন এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে সক্রিয় হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসক নিয়োগে বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সচিবালয়ে জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ প্রত্যাশী উপসচিবদের বিক্ষোভের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমন ঘটনা অভিনব এবং অপ্রত্যাশিত হলেও একটি ভিন্ন বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা মানুষ মেনে নিচ্ছে। কিন্তু যা প্রয়োজন তা হলো সর্বস্তরে জনপ্রশাসনের সক্রিয় উপস্থিতি ও কার্যকর ভূমিকা। তার অভাব এখনো কাটেনি।
দেশের সব থানায় পুলিশ সদস্যরা যোগ দিলেও এখনো যোগদান শতভাগ হয়নি। গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সম্পাদকদের বৈঠকে একজন সম্পাদক জানিয়েছিলেন যে, তখনো পর্যন্ত তথ্য হলো থানায় পুলিশের যোগদানের হার মাত্র চল্লিশ শতাংশ। আমাদের জানামতে, এর বারো দিন পর পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হলেও তা স্বাভাবিক হয়নি। তা ছাড়া অভ্যুত্থানের সময় বিক্ষুব্ধ মানুষ বহু থানা পুড়িয়ে দিয়েছিল। তাতে আসবাবপত্রসহ দপ্তর ও যানবাহন পুড়েছে অনেক এবং অস্ত্র ও গুলিও লুট হয়েছিল বিস্তর। বর্তমানে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের অভিযান চলছে এবং তাতে মোটামুটি কার্যসিদ্ধিও হচ্ছে। তবে এখনো দেখা যাচ্ছে অনেক থানায় কর্মকর্তারা বারান্দায় বা বাইরে বসে কাজ করছেন। রাস্তায় টহল পুলিশ সর্বত্র দৃশ্যমান নয়। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। মোট কথা মাঠ পর্যায়ে পুলিশের ভূমিকায়ও ঘাটতি রয়েছে।
সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে এবং জাতির উদ্দেশে ভাষণ ও অন্যান্য বক্তৃতা-সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা সাংবাদিকদের কাছ থেকে তার সরকারের কাজের নির্ভীক সমালোচনা আহ্বান করেছেন। তার বক্তব্য হলো, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনাকে সুষ্ঠু পথে ফেরানোর যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা সবাই মিলে কাজে লাগাতে হবে। সেদিক থেকে মিডিয়াকে ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারের এবং অন্যান্য সংস্থার কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সমালোচনার মাধ্যমে তাকে ঠিক পথে রাখতে হবে। কারণ অতীতে আমরা একাধিক সুযোগ নষ্ট করেছি, কাজে লাগাতে পারিনি, আরেকবার তা করা যাবে না। প্রধান উপদেষ্টার ভাষায়, সম্ভবত এটি শেষ সুযোগ। রাষ্ট্র গঠন ও রাষ্ট্র বাঁচানো আজ সবার দায়িত্ব।
সেদিক থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আর তাই গণমাধ্যমকর্মীদের উচিত হবে সময়মতো যথাযথ পরামর্শ ও সমালোচনা হাজির করা। এর আরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাগামছাড়া ব্যবহারের ফলে। এতে প্রকৃত তথ্য এবং তার যথার্থ তাৎপর্য ও সামগ্রিক প্রভাব সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে সমাজের সত্যাসত্য বোধ নষ্ট হওয়ার শঙ্কা বাড়ে। আমাদের মনে হয় দায়িত্ব গ্রহণের ছয় সপ্তাহ পরও মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করতে না পারলে জনভোগান্তি বাড়বে। শেষ পর্যন্ত মানুষ জীবনযাপনে স্বস্তি ও শান্তির নিশ্চয়তা চায়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী অনিশ্চয়তা সম্পর্কে তারা সচেতন, কিন্তু তারও একটা সময়সীমা রয়েছে। সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান এবং সরকার পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পেছনে মূল কুশীলব অবশ্যই ছাত্ররা। তারা পরিবর্তনের পরও মাঠে থাকবে এটা স্বাভাবিক। প্রধান উপদেষ্টা তাদের সরকারের কাজসহ সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার কথা বলেছেন, যাতে বিপ্লবের ফসল তোলায় কোনোরূপ বিঘ্ন না ঘটে। আমাদের মনে হয় এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কেমন ও কতদূর হবে তার একটা ধারণা তাদের এবং মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে থাকতে হবে, যাতে পরস্পর সমঝোতার মাধ্যমে প্রশাসনিক কাজ মসৃণভাবে চলে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কোনোভাবে দ্বৈত শাসনের সমস্যা তৈরি না হয়। পরিস্থিতির কারণে ছাত্রদের ভূমিকা যেমন প্রাধান্য পেতে পারে, আবার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাদের প্রাধান্যকে অনেকে নিজ স্বার্থে কাজে লাগাতেও চাইবে। এতে কখনো পরিস্থিতি জটিল হয়ে যেতে পারে, আবার কখনো প্রশাসনে ইতস্তত ভাব, এমনকি স্থবিরতা দেখা দিতে পারে এবং কর্ম সম্পাদন বিঘ্নিত হতে পারে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি করবে যা এক সময় আস্থার সংকটে রূপ নিতে পারে। তাই বলব, দ্রুত দ্বৈতশাসনের সম্ভাবনার পথ বন্ধ করা দরকার।
দুজন সমন্বয়ক অর্থাৎ ছাত্রনেতা উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন, এর ওপর একজন খোদ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। আমাদের মনে হয় এর বাইরে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে শিক্ষার্থীদের এবার নিজ নিজ কাজে ফিরে যাওয়াই হবে ভালো। তাদের অন্তরে তো বিপ্লবের প্রেরণা রয়েছে, এর প্রতি দায়বোধও বহাল আছে। জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যেও একই চেতনা কার্যকর রয়েছে। ফলে যে কোনো প্রয়োজনে তারা আবার রাজপথে ফিরতে পারবে। প্রয়োজনে সরকারের পাশে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু সার্বক্ষণিক মাঠে উপস্থিত থাকলে বা নানা বিষয়ে দায়িত্ব নিতে থাকলে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তার কাজ ব্যাহত হতে পারে। কারণ সর্বত্র উভয় পক্ষে মসৃণভাবে কাজের পরিবেশ নাও থাকতে পারে। তা ছাড়া এ অবস্থায় কোনো ভুল-ভ্রান্তির দায় গ্রহণের ক্ষেত্রেও নানারকম কৈফিয়তের সুযোগ তৈরি হবে। এ পরিস্থিতি দক্ষ প্রশাসনের অন্তরায়। আশা করি বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মহল বিবেচনায় নেবেন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক