ঢাকা ০৩:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

মাঙ্কিপক্সের ভয়াবহতা ও সমাজের করণীয়

  • আপডেট সময় : ১০:৫৯:৪৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩১ জুলাই ২০২২
  • ৭৮ বার পড়া হয়েছে

সাব্বির খান : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিুএইচও) চলতি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে মাঙ্কিপক্সকে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। ডাব্লিউএইচও কতৃক মাঙ্কিপক্সকে মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকিস্বরূপ রোগ হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করার অর্থ হলো- বিশ্বব্যাপী একটি অস্থায়ী সুপারিশ জারি করা, যেখানে সংক্রমিতকে দ্রুত পরীক্ষানীরিক্ষা করা ছাড়াও সংক্রমনের উৎপত্তিস্থল সনাক্তকরণ করা।
এর আগে ডাব্লিউএইচও কতৃক ছয়বার বিশ্বব্যাপী এধরনের অস্থায়ী সুপারিশ জারি করা হয়েছিলো, যার মধ্যে কোভিড-১৯ ছিল অতি সাম্প্রতিক। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৭৫টিরও বেশি দেশে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সার্বিক পরিস্থিতি আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করছেন আক্রান্ত দেশগুলোর চিকিৎসকরা।
এখন পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যার মধ্যে বেশি ছড়িয়েছে স্পেনে। সেখানে রোগী পাওয়া গেছে তিন হাজার ৭০০-রও বেশি। এরপর তালিকায় আছে জামার্নি। জুলাই মাস শেষ হওয়ার আগেই দেশটিতে আড়াই হাজারের বেশি রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। রোগীর সংখ্যার দিক থেকে জার্মানির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে যুক্তরাজ্য। সেখানেও দুই হাজার ৪০০-সর বেশি লোক মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত। ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, ইতালি এবং বেলজিয়ামেও সংক্রমণ বাড়ছে।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭৮টি দেশের ২০ হাজারেরও বেশি লোক মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় এটা যে, এর মধ্যে ৭১টি দেশে আগে কখনো এই রোগে সংক্রমিত রোগী পাওয়া যায়নি।

ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ সত্ত্বেও রোগটি বেশিরভাগ মানুষের জন্য মৃদু ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা। মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিতরা মূলত ২০ থেকে ৬০ এর মধ্যে বয়সের পুরুষ। ইউরোপিয়ান ইনফেকশন কন্ট্রোল এজেন্সির (ইসিডিসি) মতে, ২১ জুলাই পর্যন্ত ইউরোপে প্রায় ৮৬৯৭ সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ পুরুষ। অদ্যাবধি, সংক্রমণ অর্ধেকেরও বেশি ছড়াচ্ছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং স্পেনে।

হিউম্যান-মাঙ্কিপক্স (এমপিএক্স) হল মাঙ্কিপক্স ভাইরাস (এমপিএক্সভি) দ্বারা সৃষ্ট একটি জুনোটিক ভাইরাল রোগ। ১৯৭০ সালে এটি প্রথম মানব রোগ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। বেশকিছু আফ্রিকান দেশে এমপিএক্স রোগের কেইসগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে রিপোর্ট করা হয়েছিলো তখন। আফ্রিকার বাইরে এমপিএক্স সংক্রমণের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে দুইজন ভ্রমণকারীর দেহে এমপিএক্স ধরা পড়ে। তাদের একজন ইজরায়েলি এবং অপর জন সিঙ্গাপুরের, যারা দুইজনই নাইজেরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তারাই প্রথম ভ্রমণকারী যাদের মাধ্যমে মাঙ্কিপক্সভি উৎপত্তিস্থলের বাইরে ধরা পড়ে।

ইউরোপের আগে ভৌগলিকভাবে মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রটি ছিল ভিন্ন। পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার কিছু অংশে মাঙ্কিপক্স একটা স্থানীয় রোগ হিসেবে পরিচিত ছিলো। বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমন কিছু মানুষের দেহে এমপিএক্সভি সংক্রমণ ধরা পড়েছে যারা একই ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন এবং যেখানে তারা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ বা যৌন সম্পর্কিত যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। তবে, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে তারা সংক্রামিত হয়েছিলেন, তা নির্ধারণের জন্য অধিকতর গবেষণা এবং সিকোয়েন্সিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ এবং ডাব্লিউএইচও কর্তৃক জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর থেকে বিশ্ব-জনমনে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে। মাঙ্কিপক্স বেশ পুরনো রোগ হলেও বিশ্বব্যাপী এ রোগের ব্যাপারে জনমনে খুব বেশি ধারণা নেই বললেই চলে।

এ ব্যাপারে সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের সংক্রামক রোগ এবং ক্লিনিকাল ভাইরোলজির অধ্যাপক অ্যান্ডারস সনারবার্গের বলেন, ”বেশিরভাগ মানুষের জন্য মাঙ্কিপক্স মোটেও বিপজ্জনক নয়। তবে দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এমনকি নবজাতক এবং এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও ভাইরাসটি মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে।”

তিনি বলেন, ”ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে বা যৌন ক্রিয়াকলাপের সময় রোগটি সংক্রামিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি। একাধিক যৌনসঙ্গী আছে এমন লোক ছাড়াও পুরুষে-পুরুষে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারীদের মধ্যে এমপিএক্সভি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। উল্লেখ্য যে, এই গোষ্ঠীটি মূলত ইইউ/ইইএ-তে সবচেয়ে বেশি বলে বিবেচিত হয়। তবে, মাঙ্কিপক্স মহামারী আকার ধারণ করে বৃহত্তর জনসংখ্যার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম, যা বর্তমান প্রাদুর্ভাবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছুটা লক্ষণীয়।”

সংক্রমণজনিত সব রোগেরই কিছু পরিচিত লক্ষণ রয়েছে। মাঙ্কিপক্সের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো জ্বর, গলা ব্যথা এবং মাথাব্যথা, যা কয়েক দিন পর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোসকা দ্বারা অনুষঙ্গী হয়। চিকেনপক্সের মতো ফোসকাগুলো চুলকাতে পারে, ঘা হতে পারে এবং দাগ হতে পারে। ভালো স্বাস্থ্যবিধির অভাব বা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে ক্ষত থেকে সংক্রমণ হয়ে রক্তে বিষক্রিয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতিতে এ বিষয়টি প্রাসঙ্গিক বলে মনে না হলেও অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে এর সম্ভাবনা খুব বেশি।

মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে সংক্রমিত কোন ব্যক্তির ত্বকের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ বা সংস্পর্শের মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি কেউ যদি সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড় বা বিছানার চাদর ব্যবহার করেন, তাহলেও এটি সংক্রমিত হতে পারে। এ মুহূর্তে সংক্রমণটি প্রধানত পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্কযুক্ত পুরুষদের মধ্যেই বেশি ঘটছে। কারণ বেশিভাগ ক্ষেত্রেই উল্লেখিত গোষ্ঠীতে বেশি ধরা পড়ছে সংক্রমণটি বলে জানান অ্যান্ডারস সনারবার্গ। তার মতে, মাঙ্কিপক্স থেকে রক্ষার সহজ উপায় হলো, অপরিচিত কারো সাথে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন না করা। যেহেতু ভাইরাসটি ত্বকের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তাই যৌনক্রিয়ায় কনডম ব্যবহারও মাঙ্কিপক্স থেকে রক্ষা করতে পারে না।

বর্তমানে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে বিশেষভাবে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও গুটিবসন্ত প্রতিরোধেও ইতিমধ্যে একটি ভ্যাকসিন রয়েছে, যা মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে কিছুটা সুরক্ষা দেয়। ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) ফার্মাসিউটিক্যাল কর্তৃপক্ষ ’ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ)’ গত ২৪ জুলাই সুপারিশ করেছে যে, গুটিবসন্ত প্রতিরোধক ভ্যাকসিন ইমভেনেক্স (ওসাধহবী) মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে।

গবেষকদের মতে, একটি ভ্যাকসিন একই ধরনের ভাইরাসের একটি সম্পূর্ণ পরিবারের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। তবে, এটি নির্ভর করে ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য এবং তা কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তার উপর। ইমভেনেক্স নামের ভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারক ডেনিশ ঔষধ কোম্পানি ’বাভারিয়ান নরডিক’ এবং এটি ২০১৩ সালে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইইউ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কতৃক ইতিপূর্বে অনুমোদিত হয়েছিল। তবে, ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা বর্তমানে খুবই সীমিত এবং সুইডেন প্রায় দেড় হাজার জনের জন্য পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পেয়েছে। ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা দেহে সংক্রমণের প্রক্রিয়াটি শুরু হতে সময় লাগে প্রায় তিন সপ্তাহ। সুতরাং কেবলই তাদেরই ভ্যাকসিনটি প্রাথমিকভাবে দেওয়া উচিত, যারা ইতিমধ্যে সংক্রমণের সংস্পর্শে এসেছেন।

কারো শরীরে যদি উল্লেখিত উপসর্গগুলো দেখা দেয় এবং কেউ যদি কোনো অপরিচিত কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে থাকেন অথবা এমন কারো সাথে সংস্পর্শের ফলস্বরূপ লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই তাকে স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে হবে, যেখানে প্রাথমিক পরামর্শ দেওয়া ছাড়াও কোথায় পরীক্ষা এবং চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে, সেব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হবে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে নিজ থেকে কিছু করার আগে নিকটস্থ স্বাস্থ্য পরিষেবা কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এমনকি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালের জরুরী বিভাগ বা ক্লিনিকে চিকিৎসকের সাক্ষাতের অপেক্ষায় ওয়েটিং রুমেও বসে থাকা উচিত নয়।

মাঙ্কিপক্স একটি জুনোসিস, অর্থাৎ এটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয় বা হতে পারে। ভাইরাসটি প্রথম ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের একটি পরীক্ষাগারে গবেষণার জন্য রাখা একটি বানরের মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছিল। ভাইরাসটি প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন প্রজাতির ইঁদুরের মধ্যেও পাওয়া গেছে। সে কারণে ইঁদুরকে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের প্রধান আধার এবং বিস্তৃতিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ’মাঙ্কিপক্স’ নামটিতে এক ধরনের নেতিবাচক-ভীতিকারক আস্বাদন থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) রোগটির নাম পরিবর্তনের কথা ভাবছে।

মাঙ্কিপক্স এমন একটি সংক্রমিত রোগ, যা আক্রান্ত ব্যক্তি যেকোন অবস্থায়, যেকোন জায়গায়, যে কাউকেই সংক্রমিত করতে পারে। সেকারণে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইনগতভাবে বাধ্য করা উচিত তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে, যাতে কেউ সংক্রমিত হলে স্থানীয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সম্ভাব্য সংক্রমণ সনাক্তকরণ, উৎপত্তিস্থল খুঁজে বের করা ছাড়াও সংক্রমিত ব্যক্তিকে অন্যান্যদের থেকে পৃথক করতে পারেন।
লেখক : কলামিস্ট

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

মাঙ্কিপক্সের ভয়াবহতা ও সমাজের করণীয়

আপডেট সময় : ১০:৫৯:৪৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩১ জুলাই ২০২২

সাব্বির খান : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিুএইচও) চলতি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে মাঙ্কিপক্সকে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। ডাব্লিউএইচও কতৃক মাঙ্কিপক্সকে মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকিস্বরূপ রোগ হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করার অর্থ হলো- বিশ্বব্যাপী একটি অস্থায়ী সুপারিশ জারি করা, যেখানে সংক্রমিতকে দ্রুত পরীক্ষানীরিক্ষা করা ছাড়াও সংক্রমনের উৎপত্তিস্থল সনাক্তকরণ করা।
এর আগে ডাব্লিউএইচও কতৃক ছয়বার বিশ্বব্যাপী এধরনের অস্থায়ী সুপারিশ জারি করা হয়েছিলো, যার মধ্যে কোভিড-১৯ ছিল অতি সাম্প্রতিক। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৭৫টিরও বেশি দেশে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সার্বিক পরিস্থিতি আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করছেন আক্রান্ত দেশগুলোর চিকিৎসকরা।
এখন পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যার মধ্যে বেশি ছড়িয়েছে স্পেনে। সেখানে রোগী পাওয়া গেছে তিন হাজার ৭০০-রও বেশি। এরপর তালিকায় আছে জামার্নি। জুলাই মাস শেষ হওয়ার আগেই দেশটিতে আড়াই হাজারের বেশি রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। রোগীর সংখ্যার দিক থেকে জার্মানির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে যুক্তরাজ্য। সেখানেও দুই হাজার ৪০০-সর বেশি লোক মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত। ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, ইতালি এবং বেলজিয়ামেও সংক্রমণ বাড়ছে।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭৮টি দেশের ২০ হাজারেরও বেশি লোক মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় এটা যে, এর মধ্যে ৭১টি দেশে আগে কখনো এই রোগে সংক্রমিত রোগী পাওয়া যায়নি।

ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ সত্ত্বেও রোগটি বেশিরভাগ মানুষের জন্য মৃদু ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা। মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিতরা মূলত ২০ থেকে ৬০ এর মধ্যে বয়সের পুরুষ। ইউরোপিয়ান ইনফেকশন কন্ট্রোল এজেন্সির (ইসিডিসি) মতে, ২১ জুলাই পর্যন্ত ইউরোপে প্রায় ৮৬৯৭ সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ পুরুষ। অদ্যাবধি, সংক্রমণ অর্ধেকেরও বেশি ছড়াচ্ছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং স্পেনে।

হিউম্যান-মাঙ্কিপক্স (এমপিএক্স) হল মাঙ্কিপক্স ভাইরাস (এমপিএক্সভি) দ্বারা সৃষ্ট একটি জুনোটিক ভাইরাল রোগ। ১৯৭০ সালে এটি প্রথম মানব রোগ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। বেশকিছু আফ্রিকান দেশে এমপিএক্স রোগের কেইসগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে রিপোর্ট করা হয়েছিলো তখন। আফ্রিকার বাইরে এমপিএক্স সংক্রমণের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে দুইজন ভ্রমণকারীর দেহে এমপিএক্স ধরা পড়ে। তাদের একজন ইজরায়েলি এবং অপর জন সিঙ্গাপুরের, যারা দুইজনই নাইজেরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তারাই প্রথম ভ্রমণকারী যাদের মাধ্যমে মাঙ্কিপক্সভি উৎপত্তিস্থলের বাইরে ধরা পড়ে।

ইউরোপের আগে ভৌগলিকভাবে মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রটি ছিল ভিন্ন। পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার কিছু অংশে মাঙ্কিপক্স একটা স্থানীয় রোগ হিসেবে পরিচিত ছিলো। বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমন কিছু মানুষের দেহে এমপিএক্সভি সংক্রমণ ধরা পড়েছে যারা একই ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন এবং যেখানে তারা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ বা যৌন সম্পর্কিত যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। তবে, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে তারা সংক্রামিত হয়েছিলেন, তা নির্ধারণের জন্য অধিকতর গবেষণা এবং সিকোয়েন্সিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ এবং ডাব্লিউএইচও কর্তৃক জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর থেকে বিশ্ব-জনমনে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে। মাঙ্কিপক্স বেশ পুরনো রোগ হলেও বিশ্বব্যাপী এ রোগের ব্যাপারে জনমনে খুব বেশি ধারণা নেই বললেই চলে।

এ ব্যাপারে সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের সংক্রামক রোগ এবং ক্লিনিকাল ভাইরোলজির অধ্যাপক অ্যান্ডারস সনারবার্গের বলেন, ”বেশিরভাগ মানুষের জন্য মাঙ্কিপক্স মোটেও বিপজ্জনক নয়। তবে দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এমনকি নবজাতক এবং এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও ভাইরাসটি মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে।”

তিনি বলেন, ”ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে বা যৌন ক্রিয়াকলাপের সময় রোগটি সংক্রামিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি। একাধিক যৌনসঙ্গী আছে এমন লোক ছাড়াও পুরুষে-পুরুষে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারীদের মধ্যে এমপিএক্সভি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। উল্লেখ্য যে, এই গোষ্ঠীটি মূলত ইইউ/ইইএ-তে সবচেয়ে বেশি বলে বিবেচিত হয়। তবে, মাঙ্কিপক্স মহামারী আকার ধারণ করে বৃহত্তর জনসংখ্যার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম, যা বর্তমান প্রাদুর্ভাবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছুটা লক্ষণীয়।”

সংক্রমণজনিত সব রোগেরই কিছু পরিচিত লক্ষণ রয়েছে। মাঙ্কিপক্সের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো জ্বর, গলা ব্যথা এবং মাথাব্যথা, যা কয়েক দিন পর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোসকা দ্বারা অনুষঙ্গী হয়। চিকেনপক্সের মতো ফোসকাগুলো চুলকাতে পারে, ঘা হতে পারে এবং দাগ হতে পারে। ভালো স্বাস্থ্যবিধির অভাব বা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে ক্ষত থেকে সংক্রমণ হয়ে রক্তে বিষক্রিয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতিতে এ বিষয়টি প্রাসঙ্গিক বলে মনে না হলেও অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে এর সম্ভাবনা খুব বেশি।

মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে সংক্রমিত কোন ব্যক্তির ত্বকের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ বা সংস্পর্শের মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি কেউ যদি সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড় বা বিছানার চাদর ব্যবহার করেন, তাহলেও এটি সংক্রমিত হতে পারে। এ মুহূর্তে সংক্রমণটি প্রধানত পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্কযুক্ত পুরুষদের মধ্যেই বেশি ঘটছে। কারণ বেশিভাগ ক্ষেত্রেই উল্লেখিত গোষ্ঠীতে বেশি ধরা পড়ছে সংক্রমণটি বলে জানান অ্যান্ডারস সনারবার্গ। তার মতে, মাঙ্কিপক্স থেকে রক্ষার সহজ উপায় হলো, অপরিচিত কারো সাথে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন না করা। যেহেতু ভাইরাসটি ত্বকের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তাই যৌনক্রিয়ায় কনডম ব্যবহারও মাঙ্কিপক্স থেকে রক্ষা করতে পারে না।

বর্তমানে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে বিশেষভাবে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও গুটিবসন্ত প্রতিরোধেও ইতিমধ্যে একটি ভ্যাকসিন রয়েছে, যা মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে কিছুটা সুরক্ষা দেয়। ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) ফার্মাসিউটিক্যাল কর্তৃপক্ষ ’ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ)’ গত ২৪ জুলাই সুপারিশ করেছে যে, গুটিবসন্ত প্রতিরোধক ভ্যাকসিন ইমভেনেক্স (ওসাধহবী) মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে।

গবেষকদের মতে, একটি ভ্যাকসিন একই ধরনের ভাইরাসের একটি সম্পূর্ণ পরিবারের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। তবে, এটি নির্ভর করে ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য এবং তা কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তার উপর। ইমভেনেক্স নামের ভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারক ডেনিশ ঔষধ কোম্পানি ’বাভারিয়ান নরডিক’ এবং এটি ২০১৩ সালে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইইউ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কতৃক ইতিপূর্বে অনুমোদিত হয়েছিল। তবে, ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা বর্তমানে খুবই সীমিত এবং সুইডেন প্রায় দেড় হাজার জনের জন্য পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পেয়েছে। ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা দেহে সংক্রমণের প্রক্রিয়াটি শুরু হতে সময় লাগে প্রায় তিন সপ্তাহ। সুতরাং কেবলই তাদেরই ভ্যাকসিনটি প্রাথমিকভাবে দেওয়া উচিত, যারা ইতিমধ্যে সংক্রমণের সংস্পর্শে এসেছেন।

কারো শরীরে যদি উল্লেখিত উপসর্গগুলো দেখা দেয় এবং কেউ যদি কোনো অপরিচিত কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে থাকেন অথবা এমন কারো সাথে সংস্পর্শের ফলস্বরূপ লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই তাকে স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে হবে, যেখানে প্রাথমিক পরামর্শ দেওয়া ছাড়াও কোথায় পরীক্ষা এবং চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে, সেব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হবে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে নিজ থেকে কিছু করার আগে নিকটস্থ স্বাস্থ্য পরিষেবা কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এমনকি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালের জরুরী বিভাগ বা ক্লিনিকে চিকিৎসকের সাক্ষাতের অপেক্ষায় ওয়েটিং রুমেও বসে থাকা উচিত নয়।

মাঙ্কিপক্স একটি জুনোসিস, অর্থাৎ এটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয় বা হতে পারে। ভাইরাসটি প্রথম ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের একটি পরীক্ষাগারে গবেষণার জন্য রাখা একটি বানরের মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছিল। ভাইরাসটি প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন প্রজাতির ইঁদুরের মধ্যেও পাওয়া গেছে। সে কারণে ইঁদুরকে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের প্রধান আধার এবং বিস্তৃতিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ’মাঙ্কিপক্স’ নামটিতে এক ধরনের নেতিবাচক-ভীতিকারক আস্বাদন থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) রোগটির নাম পরিবর্তনের কথা ভাবছে।

মাঙ্কিপক্স এমন একটি সংক্রমিত রোগ, যা আক্রান্ত ব্যক্তি যেকোন অবস্থায়, যেকোন জায়গায়, যে কাউকেই সংক্রমিত করতে পারে। সেকারণে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইনগতভাবে বাধ্য করা উচিত তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে, যাতে কেউ সংক্রমিত হলে স্থানীয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সম্ভাব্য সংক্রমণ সনাক্তকরণ, উৎপত্তিস্থল খুঁজে বের করা ছাড়াও সংক্রমিত ব্যক্তিকে অন্যান্যদের থেকে পৃথক করতে পারেন।
লেখক : কলামিস্ট