মোস্তফা হোসেইন : তেল নিয়ে তেলেসমাতি নয়, এ হচ্ছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্ম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও মন্তব্য হচ্ছে-দুর্বল বিরোধী দলের শূন্যস্থান পূরণ করছে তেলের ব্যবসায়ীরা। যুগান্তকরী উন্নয়ন আর স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে সক্ষম একটি সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ব্যবসায়ীরা সরকারের সহযোগী, তারা মুখে যতই বলুন-তাদের কর্মকা- প্রমাণ করে, তারা মিশনে নেমেছেন সরকারের বিরুদ্ধে। এমন মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরেফিরে আসছে।
বাংলাদেশে প্রায় দুই যুগ স্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ইস্যুভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারেনি। মূলত সরকারের সাফল্যের কারণে। ঠিক ওই মুহূর্তে ব্যবসায়ীরা বিরোধী দলের সেই ব্যর্থতা ঢাকতে মাঠে নেমেছেন। এমন অভিযোগ ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছুদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
একবার পেঁয়াজ নিয়ে রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে তো আরেকবার চিনি নিয়ে, এভাবে সারাবছরই সরকারকে তটস্থ করে রেখেছেন তারা। সর্বশেষ গত ঈদের আগে হঠাৎ করে বাজার থেকে সোয়াবিন তেল উধাও করে দেওয়া হয়। এই কাজটি তারা এমন সময় করলো যখন বাঙালি আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঈদের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মানুষ কেনাকাটা করতে বাজারে গিয়ে দেখে বাজার থেকে তেল উধাও।
পাড়ার ছোট মুদি দোকান থেকে শুরু করে পাশের কাঁচাবাজার কোথাও তেল পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানদারদের সাফ জবাব- সাপ্লাই নেই। গণমাধ্যমগুলো দোকানের তেলশূন্য অবস্থার সংবাদ প্রচার করতে থাকে। দায় পড়ে সরকারের ওপর। মানুষ চরমভাবে বিরক্ত হয় সরকারের ওপর। বলা হয়, সরকারের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেই।
অথচ তেল উধাও হওয়ার প্রাক্কালে সরকারকে দিয়েই ঘোষণা দেওয়া হয়, ঈদের পর বাজারে তেলের দাম আবারও বাড়বে। এর কয়েক মাস আগে তেলের দাম বেড়ে প্রতি বোতল ১ লিটারের দাম হয় ১৬৮ টাকা। ঈদের পর থেকে তা আরও বেড়ে হবে ১৯৮ টাকা প্রতি লিটার, সেই ঘোষণা আসে ঈদের আগে, যখন কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়।
ঈদের রান্না কায়ক্লেশে শেষ করে বাজারে গিয়ে মানুষ দেখে দোকানে তেল আছে। অথচ ঈদের ছুটিতে আমদানি কিংবা সরবরাহ কিছুই করা হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন আমদানি করা ২ কোটি লিটারের বেশি তেল তখনও বন্দরে খালাস হয়নি। সুতরাং এই তেল কোথা থেকে এলো? শুধু তাই নয় প্রতি লিটার বোতলজাত তেল বিক্রি হতে থাকে ১৯৮ টাকা দরে, যা নতুন তেল বাজারে আসার পর কার্যকর হওয়ার কথা। সোজা কথা হচ্ছে- তেল ব্যবসায়ীরা মানুষকে ঈদে বিড়ম্বনায় ফেলে সব তেল সরিয়ে ফেলেছিলেন আর ঈদের পর নতুন তেল আসার আগেই পুরোনোগুলো অধিকমূল্যে বিক্রি করে মুনাফা করতে থাকে।
ঈদের বিরূপ পরিস্থিতির কারণে সরকারের অভিযান শুরু হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য হচ্ছে সরকারি অভিযান চালাতে গিয়ে দিনে ৪ লাখ লিটার তেল জব্দ করার সংবাদও আমরা পড়ি কিংবা দেখতে থাকি। প্রমাণ হলো, অধিক মুনাফালোভী তেল ব্যবসায়ীরা অবৈধ মজুত করে অবৈধ আয়ের ব্যবস্থা শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে করে ফেলেছেন।
ব্যবসায়ীদের এই কর্ম তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের স্পষ্ট প্রমাণ। সেই ভাষ্যও আমরা শুনতে পাই সরকারের মুখপাত্র থেকেই। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রকাশ্যে। ৯ মে তিনি সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ভোজ্যতেলের বাজার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ভোজ্যতেল নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের দেওয়া কথা রাখেনি। তাদের বিশ্বাস করা আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখেছি মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়।’
ব্যবসায়ীরা তাকে কথা দিয়েছিলেন রমজানে তেলের দাম বাড়াবেন না। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়কে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করেননি। শুধু তাই নয়, ঈদ সামনে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনদুর্ভোগ তৈরি করেছেন। যার পরিণতিতে সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় নিতে হয়েছে। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে তাকেই জবাবদিহি করতে হচ্ছে এই ব্যাপারে। মানুষ তার পেশাগত বিষয় নিয়েও সমালোচনা করতে শুরু করেছে। অনেকেই অভিযোগ করতে থাকেন, মন্ত্রী মহোদয় নিজে ব্যবসায়ী হওয়ায় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করেছেন।
ব্যবসায়ী নেতারা বাণিজ্যমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পরপরই, তাদের বক্তব্য বাণিজ্যমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ মন্তব্যে-ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। শুধু তাই নয়, এফবিসিসিআই তাদের সভায় উপস্থিত ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা সরকারি বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘দোকানে যদি মাল মজুত না থাকে তাহলে ব্যবসা করবো কীভাবে?
রমজানের আগে বাজারে ঘাটতি দূর করতে ব্যবসায়ীরা দোকানে মাল মজুত করেছেন। অথচ এজন্য ব্যবসায়ীদের নাজেহাল করা হচ্ছে। দোকানে অভিযান চালিয়ে কিছু তেল পাওয়া গেলেই ব্যবসায়ীদের অপদস্থ করা হচ্ছে।’ তাদের বক্তব্যের আগে পরের ঘটনা বাদ দিয়ে যদি যুক্তি খোঁজা হয় তাহলে মনে হবে, তারা ঠিকই বলছেন। অথচ দেশের মানুষ ঈদের আগে দেখেছে দোকানগুলোতে তেল নেই। খুচরা দোকানদারদের একই জবাব ছিল, ডিলারদের কাছ থেকে তারা সরবরাহ পাচ্ছেন না তাই তাদের তেল নেই।
অর্থাৎ ঈদের সময় প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহ করা থেকে ডিলাররা বিরত ছিল এবং সেগুলো বেশি দামে বিক্রি করার জন্য মজুত করে রেখেছিল। তাই এই ব্যবসায়ী নেতার বক্তব্য অনুযায়ী বৈধ ব্যবসার উদ্দেশে এই তেল মজুত করা হয়নি। কিন্তু ঈদের পরপরই বাজারই শুধু নয়, গুদামে গুদামে পাওয়া যাচ্ছে তেল। এই নিবন্ধ লেখার সময় টিভিতে সংবাদ প্রচার হচ্ছিলো শুধু খুলনায়ই সয়াবিন ও পাম তেল মিলে আড়াই লাখ লিটারের বেশি পাওয়া গেছে গুদামে। একইভাবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বরিশাল, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযানে এমন হাজার হাজার লিটার তেল জব্দ করে আগের দরে বিক্রি করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অবৈধভাবে মজুত ও অধিক মূল্যে বিক্রি রোধ করার উদ্যোগকে কি অপদস্থ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়? মনে করার কারণ নেই শুধু তেল নিয়েই এমনটা ঘটছে। প্রায়ই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানো হচ্ছে দেশে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে প্রচ- ক্ষোভ। যার দায় পড়ছে সরকারের ওপর। অথচ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে প্রায় সবক্ষেত্রেই তেলের মতো তেলেসমাতি কারবার কাজ করছে।
ব্যবসায়ীদের এই কর্মকা- কি নিছক অতিমুনাফার লোভ নাকি এর পেছনে অন্য কোনো শক্তি জড়িত। সরকারের সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য পেছন থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছে কি না তাও ভেবে দেখার বিষয়। এতে করে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে জনমতে ধস আনা হতে পারে। যে কাজটি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টায় সফল হয়নি, সেই কাজটি ব্যবসায়ীদের দিয়ে করিয়ে নিতে পারলে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করা সম্ভব হবে তাদের।
তেলের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যে। কোনো কারণ ছাড়াই পেঁয়াজ, রসুন ও আদার মতো পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। বলা হচ্ছে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এই মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু বাজারের মজুত পণ্যগুলো আনা হয়েছে আগেই। বর্ধিত ব্যয় বাজারে থাকা পণ্যগুলোতে কার্যকর হয়নি। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাই অনেকেই বলছেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে যে প্রচারণা চালাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা সেই কাজটিই বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রকারান্তরে কার্যকর সরকার বিরোধী দল হিসেবে ব্যবসায়ীদের আবির্ভাব হয়েছে মন্তব্য করছেন অনেকেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- অতি মুনাফার উদ্দেশ্যেই হোক আর রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই হোক বিষয়টি সরকারের জন্য সুখকর নয়। সুতরাং এই অপকর্মের হোতাদের অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে। আর এই কাজটি করতে হবে সরকারকেই। আশা করি শিগগির এর একটা বিহিত হবে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।