প্রত্যাশা ডেস্ক: ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে জাতি। ঢাকার সাভারের অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ এ উপলক্ষে প্রস্তুত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন নির্বিঘ্ন করতে নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থাও।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখন্ডের নাম জানান দেয়ার দিন। ১৯৪৮ সাল থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রায় ৩০ লাখ শহীদ ও দু’ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। সেই হিসাবে বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তির দিন আজ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল ভেঙে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। ২৪ বছরের নাগ পাশ ছিন্ন করে জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্যোদয়। প্রভাত সূর্যের রক্তাভা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। স্বাধীনতার প্রায় ৫৩ বছর পর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় এক নতুন বাংলাদেশের।
নতুন বাস্তবতায় এবার প্রথম পালিত হচ্ছে বিজয় দিবস। দিবসটিকে কেন্দ্র করে সবুজে ঘেরা ১০৮ হেক্টর জমির ওপর নির্মিত স্মৃতিসৌধে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি কার্যক্রম চলেছে। সেখানে ইতিমধ্যে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শেষ করেছে গণপূর্ত বিভাগ। ঢাকা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা নিবেদন ও ভালোবাসা জানাতে স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল নামবে। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টাসহ দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এদিন শ্রদ্ধা জানাতে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে আসবেন।
বিজয় দিবস ঘিরে পুরো সৌধ প্রাঙ্গণকে দেওয়া হয়েছে এক নতুন রূপ। উদযাপন নির্বিঘ্ন করতে ঢাকা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। স্মৃতিসৌধের নানা স্থানে নতুন করে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা।
সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের দায়িত্বে থাকা সাভার গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও মহান বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জাতির বীর শহীদ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টাসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আসবেন। তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সৌধে প্রবেশের ফটকগুলো খুলে দিলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লাখো মানুষের ঢল নামবে সৌধ প্রাঙ্গণে। তাদের হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ফুলে ফুলে ভরে উঠবে বেদি।’
দিবসটি যাথযথভাবে উদযাপনের জন্য বরাবরের মতো এবারও পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে বলে জানান মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গণপূর্ত বিভাগের কর্মীদের টানা ১৫ দিনের পরিশ্রমে সৌধপ্রাঙ্গণ পেয়েছে নতুন রূপ। ধোয়া-মোছা শেষে সিঁড়িসহ অন্যসব স্থাপনায় পড়েছে রং-তুলির আঁচড়। বাহারি ফুল গাছে ঢেকে দেওয়া হয়েছে বেদির সবুজ চত্বর।’
বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে ঢাকা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি একেএম আওলাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘সৌধপ্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। পুরো সাভার এলাকায় বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।’
দিবসটি উপলক্ষে তিন হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পুরো সাভারজুড়ে মোতায়েন থাকবে বলেও জানান পুলিশের এই উর্ধতন কর্মকর্তা। নিরাপত্তা চৌকির পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারিও থাকবে বলে জানান তিনি।
বিজয় র্যালি করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন: ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ‘বিজয় র্যালি’ করার ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রোববার (১৫ ডিসেম্বর) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই পোস্ট বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস আমাদের স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আয়োজন বিজয় র্যালি। জমায়েত হবে সকাল ১০টায়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সবাইকে নিমন্ত্রণ। উল্লেখ্য, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা আয়োজনের ঘোষণা দিলেও পরে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে তা স্থগিত করা হয়। আলোচনা সভা পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত হবে জানালেও তারিখ জানানো হয়নি। ঠিক কী কারণে স্থগিত করা হয়েছে তাও জানা যায়নি।
২২ স্টল নিয়ে ঢাকায় বিজয়মেলা: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এবার প্রথমবারের মতো ঢাকাসহ সব জেলা-উপজেলায় বসছে ‘বিজয়মেলা’। সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) রাজধানীতে ‘বিজয় মেলা’ হবে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে। ইতিমধ্যে ২২টি স্টল বসানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের চারপাশের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।
রোববার সরেজমিন দেখা যায়, বিজয় মেলা উপলক্ষে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয় প্রাঙ্গণে সরকারি ২২টি প্রতিষ্ঠান স্টল দিয়েছে। এক নম্বর স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। স্টলের নাম ‘এসো মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি’। দুই ও তিন নম্বর স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা ও রাজস্ব শাখাকে। এ ছাড়া স্টল দিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), এসএমই ফাউন্ডেশন, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, জয়িতা ফাউন্ডেশন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ বাঁশ ও বেত শিল্প। এসব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উৎপাদিত পণ্য মেলায় প্রদর্শন করবে। মেলা দিনভর চলবে। ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয় বলছে, পণ্য কেনাবেচার চেয়ে তাদের মূল লক্ষ্য প্রদর্শনী। অনেককে স্টলে ঘুরতে দেখা গেছে। মেলায় কী কী পণ্য থাকবে, তা জানতে এসেছেন অনেকে। আবার কেউ এসেছে স্টল দেওয়া যাবে কি না, তা জানতে। এসএমই ফাউন্ডেশনসহ সরকারের একাধিক দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা আরও বেশি স্টল চেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানের অভাবে বেশি স্টল পাওয়া যায়নি।
ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয় জানিয়েছে, এবারের মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিজয় মেলার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবার ১৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেবে। সোমবার বেলা ১১টায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার হিসেবে প্রাইজবন্ড দেওয়া হবে। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় বিজয় মেলা শুরু হবে। স্টল সাজানো ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান উইনার ইভেন্ট লজিস্টিকসের সমন্বয়ক শাহ মোহাম্মদ জীবন বলেন, ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে পুরো এলাকা সাজানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ছবি তোলার জন্য ফটো বুথ বানানো হয়েছে।
ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ফুয়ারা খাতুন বলেন, বিজয় মেলা প্রথমে শিল্পকলা একাডেমির সামনে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা বাস্তবতায় সেখানে করা যায়নি। তাই ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে করতে হচ্ছে। এক দিনের মেলায় পণ্য বেচাকেনার চেয়ে প্রদর্শনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষদের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মেলায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের দুটি শাখাকে বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে ফুয়ারা খাতুন বলেন, এ দুটি শাখা কী ধরনের কাজ করে, তা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা হবে।
যান চলাচলে ডিএমপির বিশেষ নির্দেশনা: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকা-আরিচা রুটের যান চলাচলে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
এই রুটে চলাচলকারী যানবাহনকে ঢাকা থেকে সাভার স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত এলাকা পরিহার করে বিকল্প সড়কে চলাচলের অনুরোধ জানানো হয়েছে। রোববার ডিএমপি’র মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের দেওয়া এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে ভোর ৪টা থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাগণ, বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিকগণ এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ঢাকা থেকে আমিন বাজার হয়ে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গমনাগমন করবেন। এ উপলক্ষে রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টা থেকে সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনকে গাবতলী-আমিন বাজার ব্রিজ-সাভার রোড পরিহার করে বিকল্প সড়কে চলাচলের অনুরোধ করা হয়।
বিকল্প সড়ক: ১। গাবতলী হতে সাভার হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া যানবাহন ঢাকা এয়ারপোর্ট রোড হয়ে আব্দুল্লাহপুর ক্রসিং দিয়ে আশুলিয়া সড়ক হয়ে চলাচল করবে। ২। কল্যাণপুর ও টেকনিক্যাল ক্রসিং থেকে ঢাকার বাইরে ছেড়ে যাওয়া যানবাহন টেকনিক্যাল ক্রসিং হতে ডানে টার্ন করে মিরপুর-১ নম্বর হয়ে দিয়াবাড়ি ক্রসিং দিয়ে চলাচল করবে। ৩। আরিচা হতে আমিন বাজার হয়ে ঢাকা মহানগরগামী যানবাহনসমূহ নবীনগর বাজারে বামে টার্ন করে আশুলিয়া হয়ে চলাচল করবে।
৪। টাঙ্গাইল হতে ঢাকাগামী যানবাহনসমূহ কালিয়াকৈর-গাজীপুর চৌরাস্তা-টঙ্গী হয়ে চলাচল করবে। অনুষ্ঠানসমূহ চলাকালীন নাগরিকরা পুলিশের নির্দেশিত বিকল্প সড়কে যানবাহন চলাচল করতে অনুরোধ জানিয়ে ডিএমপি কর্তৃপক্ষ নগরবাসী, যানবাহন মালিক ও শ্রমিকরা সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান জানায়।