প্রত্যাশা ডেস্ক : শুরু হলো গৌরবদীপ্ত বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই মাসের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে রচিত হয় সবচেয়ে বড় গৌরবের অধ্যায়। ডিসেম্বরের বেশ কিছু ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়কে দ্রুত ত্বরান্বিত করে। বিজয়ের ৫৪ বছর ইতোমধ্যে পার করছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকালে তিন ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়া হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। বেশির ভাগ মানুষ বের হয় শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য। কাতারে কাতারে মানুষ যেতে থাকে গ্রামের দিকে। শহরের অনেক রাস্তার পাশে পড়ে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতদের লাশ। মানুষ বুঝতে পারে, কী বিভীষিকা শহরে ঘটে গেছে। সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তম (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) ইংরেজিতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চের মতো এই দিন দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। অনুষ্ঠানে দুবার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জিয়াউর রহমান। প্রথমবার তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান পরিচয় দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। পরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শে ঘোষণাটি দ্বিতীয়বার পাঠ করেন শেখ মুজিবের নামে। জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ প্রথমবার স্বাধীনতার যে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, তার মূল কপিটি নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার শেখ মুজিবের নামে যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ তিনি করেন, সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র-এর তৃতীয় খণ্ডে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার পরিস্থিতি এবং শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭ মার্চেই বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের পত্রিকা, সংবাদ সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়। [সূত্র: প্রথম আলো ২৬ মার্চ ২০২১]
বাঙালি জাতি হাজার বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসে। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলনই একপর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। স্বাধীনতার জন্য ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এই আন্দোলন-সংগ্রাম ১৯৭১ সালের মার্চে এসে স্ফুলিঙ্গয়ে রূপ নেয়। সাত মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে জাতিকে দিক-নির্দেশনা দেন। বাঙালির এই স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে থাকে পাকিস্তানি জান্তারা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বর্বরোচিতভাবে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা পরে মেজর জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। শুরু হয় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধন অভিযান। তবে পাকিস্তানের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার সর্বস্তরের মানুষ। হাতে তুলে নেয় অস্ত্র, শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চলে বাঙালির মরণপণ যুদ্ধ। বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে বাঙালি বিজয়ের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায়। একপর্যায়ে বাঙালির বীরত্বের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয় আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স) মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর (ভারতীয় বাহিনী) যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। রক্তক্ষয়ী এই মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।