প্রযুক্তি ডেস্ক : বছর তিনেক ধরেই পৃথিবীর চারপাশে একের পর এক স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের কোম্পানি স্টারলিংক। অনেকের দাবি, খালি চোখেই মহাকাশে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট দেখেছেন তারা। আবার বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মহাকাশেও ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করতে পারে স্যাটেলাইটগুলো। তবে, মাস্কের দাবি, স্টারলিংক প্রকল্পের অংশ হিসেবে পৃথিবীর দুর্গম অঞ্চলগুলোতে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা চালু করতে মহাকাশে হাজারো স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে তার কোম্পানি।
‘স্টারলিংক’ প্রকল্পে আসলে কী হচ্ছে? ছোট ছোট স্যাটেলাইটের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে পুরো বিশ্বে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে স্টারলিংক। প্রচারণায় মূলত দুর্গম অঞ্চলের মানুষদেরই সেবা দেওয়ার কথা বলছে কোম্পানিটি। বর্তমান বাস্তবতায় স্টারলিংকের প্রাসঙ্গিকতা সমর্থন করে ইউনিভার্সিটি অফ পোর্টসমাউথের স্পেস প্রোজেক্ট ম্যানেজার ড. লুসিন্ডা কিং বলেন, “এই শ্রেণিতে পড়েন এমন মানুষ যুক্তরাজ্যে আছেন, আফ্রিকাতেও আছেন।”
স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলোর অবস্থান ‘লো-লেভেল অরবিট’-এ। সাধারণ স্যাটেলাইটগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬২১ মাইলের বেশি উচ্চতায় পৃথিবীকে ঘিরে চক্কর দিলেও স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলোর অবস্থান ৩৪১ মাইল উচ্চতায় বলে জানিয়েছে বিবিসি। ইন্টারনেটে গতি বেশি রাখতেই এতো কম উচ্চতায় থাকছে স্যাটেলাইট বহর। আর উচ্চতার কারণেই হাজারো স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক প্রয়োজন স্টারলিংকের।
২০১৮ সালের পর থেকে স্টারলিংক মহাকাশে অন্তত তিন হাজার স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রকল্প শেষে মহাকাশে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট সংখ্যা ১০ থেকে ১২ হাজার হতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। স্যাটেলাইট নির্ভর ইন্টারনেট সেবা চালু হলে মরুভূমি বা পাহাড়-পর্বতের মতো দুর্গম অঞ্চলেও ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া সম্ভব হবে।
খরচ কেমন? কার জন্য এই ইন্টারনেট সেবা? বাজারের প্রচলিত ইন্টারনেট সেবাদাতা কোম্পানির প্যাকেজের সঙ্গে তুলনা করলে মোটেই সস্তা নয় স্টারলিংকের সেবা। প্রতি মাসে ৯৯ ডলার করে গুণতে হবে ব্যবহারকারীকে। স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কে সংযোগ পেতে যে ডিস ও রাউটার প্রয়োজন, স্টারলিংক তার দাম রাখে ৫৪৯ ডলার। তবে, ‘উন্নত বিশ্বের’ দেশগুলোতে ৯০ শতাংশের বেশি বাসাবাড়িতে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগ আছে। সেক্ষেত্রে ‘গরীব’ দেশগুলোতে চাহিদা বেশি থাকলেও তার সঙ্গে স্টারলিংকের সেবার অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়ার মতোই। এ পরিস্থিতে স্টারলিংক অল্পসংখ্যক সেবাগ্রাহকের কাছ থেকে মুনাফা কামাইয়ের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বলে মনে করেন লন্ডন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সা’ইদ মোসতেশার।
বিবিসি জানিয়েছে, বর্তমানে ৩৬টি দেশে চার লাখ সেবাগ্রাহক আছে স্টারলিংকের। মূলত উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলেশিয়ার দেশগুলোতেই সেবা দিচ্ছে কোম্পানিটি। বাসাবাড়ি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উভয়েরই আছে স্টারলিংকের সেবাগ্রাহকদের তালিকায়।
২০২৩ সালে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়াকে নিজস্ব সেবার আওতায় আনতে চায় স্টারলিংক। ইউরোপের তুলনায় বিশ্বের এই অঞ্চলগুলোর ইন্টারনেট সংযোগ অনেকটাই ‘জোড়াতালি’ দেওয়া। স্টারলিংকের নিজস্ব ওয়েবসাইট বলছে, বালাদেশেও সেবাটি চালু হবে ২০২৩ সালে। ‘গরীব’ দেশগুলো বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগের জন্য স্টারলিংক বেশি ব্যয়বহুল মনে হলেও দুর্গম অঞ্চলের স্কুল এবং হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সংযোগ দিতে স্টারলিংক ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইউক্রেইনকে কীভাবে সহযোগিতা করছে স্টারলিংক? ইউক্রেইনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করার পর থেকেই দেশটিকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে রাশিয়া। ইউক্রেইনের জনপ্রতিনিধিদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশটির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে স্টারলিংক সেবা চালু করেছেন ইলন মাস্ক। অন্তত ১৫ হাজার স্টারলিংক ডিশ ও রাউটার এরইমধ্যে পৌঁছেছে দেশটিতে। স্টারলিংকের সংযোগের মাধ্যমে ইউক্রেইন সরকার জনসেবাগুলো চালু রাখতে পেরেছে বলে উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে। যুদ্ধক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে স্টারলিংকের সেবা। “ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনী যোগাযোগ করতে এটি ব্যবহার করছে; যেমন, হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সৈনিকদের যোগাযোগের বেলায়,”– বলেছেন কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষক ড. মারিনা মিরন। “রেডিও সিগনালের মতো এর সিগনাল জ্যাম করা সম্ভব নয়। পুরো কিট সেটআপ করতেও সময় লাগে কম, মাত্র ১৫ মিনিট।”
মহাকাশে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করবে স্টারলিংক? স্টারলিংক ছাড়াও মহাকাশে ইন্টারনেট স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক গঠনে হাজারো স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে ওয়ানওয়েব এবং ভায়াস্যাটের মতো কোম্পানিগুলো। এই পরিস্থিতি জটিলতা সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন অধ্যাপক সা’ইদ মোসতেশার। “এতে মহাকাশ আরও অনিরাপদ হয়ে উঠছে,” বলেন তিনি। “স্যাটেলাইটগুলো অন্য মহাকাশযানে আঘাত করতে পারে যার ফলে সৃষ্ট ধ্বংসস্তুপের দ্রুত গতিতে ছুটে চলে আরও বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।” সাম্প্রতিক মাসগুলোতে স্পেসস্টেশনের সঙ্গে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট সংঘর্ষের পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছিল। চীনের নির্মাণাধীন স্পেসস্টেশনে অল্পের জন্য ধাক্কা লাগেনি স্টারলিংক স্যাটেলাইটের। নভোচারীদের জন্যেও নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে স্টারলিংক। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময়ে ছোট ছোট স্যাটেলাইটগুলোর ডানায় আলোর প্রতিফলন নজরে চোখে পড়ে নভোচারীদের। এর মূল সমস্যা হলো, মহাবিশ্বের গ্রহ নক্ষত্র পর্যাবেক্ষণে সময় টেলিস্কোপের ছবিতে দাগ সৃষ্টি করতে পারে স্যাটেলাইটের ডানা থেকে আসা আলোর প্রতিফলন।
মহাকাশে হাজারো স্যাটেলাইট কেন পাঠাচ্ছেন মাস্ক?
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ