বিশেষ সংবাদদাতা : করোনাজনিত মন্দার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার হিড়িক পড়েছে। এছাড়া পণ্য রফতানি বেড়েছে যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ আমদানি- রফতানি যে কোনও সময়ের চেয়ে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়েছে যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও গতিশীল হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেসব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে আমদানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৩ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বর মাসে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। একইভাবে আগস্ট মাসে সরকারের রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ শতাংশের বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা দীর্ঘদিনের স্থবিরতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন উদ্যমে উৎপাদন কর্মকা-ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সে কারণেই একদিকে রফতানি আয় বাড়ছে, অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানিই বেড়ে গেছে; বাড়ছে এলসি খোলার পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে , আগস্টে ৬০৯ কোটি ১০ লাখ (৬.০৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। গতবছরের আগস্টে পণ্য আমদানি হয়েছিল ৩৫২ কোটি ১০ লাখ (৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন) ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) আমদানি বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ দুই মাসে পণ্য আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৮৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৭৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলার।
এছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে ৪১৬ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। গত বছর সেপ্টেম্বরে সার্বিকভাবে ৩০১ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এক হাজার ১০২ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। এদিকে রফতানি আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় এই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্ববাজারে রফতানি বেড়েছে ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তথ্য মতে, আগস্ট মাসে তৈরি পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশের বাজারে দেশীয় পোশাক রফতানি হয়েছে ৩৪১ কোটি ৮৮ লাখ ইউএস ডলার। যা এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ২৪১ কোটি ৩৪ লাখ ইউএস ডলার। সেই হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় এই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ কোটি ইউএস ডলার রফতানি আয় বেড়েছে পোশাক খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ৯০৫ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ।
অপরদিকে আগস্টে ৭১৮ কোটি ৪০ লাখ (৭.১৮ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা) টাকার অংকে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এর আগে কখনই কোনও একক মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এত বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে দেখা যায়নি। হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) হিসাবে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই দুই মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির জন্য ১ হাজার ২১৩ কোটি (১২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে খোলা হয়েছিল ৮১৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের এলসি। তথ্য বলছে, ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-আগস্ট সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে ৪৪৭ কোটি ৪৮ লাখ (৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে; বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৯৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যান্য শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৩৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। এছাড়া জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৯৪ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬২ শতাংশ। খাদ্যপণ্য (চাল ও গম) আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৪৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৩ শতাংশ।
অন্যদিকে আগস্ট মাসে সরকারের রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আগের মাস জুলাইতে রাজস্ব আদায় বেড়েছিল ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছিল ১৫ হাজার ৩৫৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে রাজস্ব আয় হয়েছে ১৯ হাজার ১৯২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রথম দুই মাসে এনবিআরের আয় হয়েছে ৩৪ হাজার ৫৪৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছরে জুলাই-আগস্ট মাসে ৩০ হাজার ১৬০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) আয়কর থেকে ১০ হাজার ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। ভ্যাট থেকে এসেছে ১২ হাজার ৯৬৪ কোটি ৩ লাখ টাকা এবং শুল্ক খাত থেকে প্রতিষ্ঠানটি আদায় করেছে ১১ হাজার ৫৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
মসৃণ পথে অর্থনীতির চাকা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ