ঢাকা ০৫:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫

ময়লা-আবর্জনা রাস্তায় ফেলা বিবেচনাপ্রসূত কাজ নয়

  • আপডেট সময় : ০৯:৪৪:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ জুন ২০২৪
  • ২০৬ বার পড়া হয়েছে

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দেশের অন্যতম প্রধান নগর এবং একটি দ্রুত বর্ধনশীল মহানগর। এই শহরের রাস্তা এবং অলিগলিতে এমনকি রাজপথেও ময়লা-আবর্জনা ফেলার প্রবণতা নগরজীবনকে দিনে দিনে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। এই সমস্যা শুধু পরিবেশগত নয়, এটি স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বেঁচে থাকার জন্য একটি নির্মল পরিবেশ থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।
আমি ঢাকার লালমাটিয়ার এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকি। এলাকাটি আশপাশের অনেক এলাকার চেয়েই বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর অনেকটাই ঝামেলা মুক্ত। বিশেষ করে প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যখন রাস্তায় বের হই রাস্তাগুলো এত সুন্দর ঝকঝকে তকতকে লাগে যে- মনে হয় বিদেশের কোনো একটা শহরে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ এই এলাকাতেই বিকেল চারটা-পাঁচটার দিকে মনে হয় ভয়াবহ রকম নোংরা আর আবর্জনাময় পরিবেশে বন্দি রয়েছি। এর কারণ কী। কারণ হচ্ছে এই এলাকার রাস্তাঘাটে বাইরের অনেক মানুষজন আসে। এমনকি এলাকাবাসী যারা নিয়মিত এই পথ দিয়ে যাতায়াত করে তারা অনেকেই রাস্তায় ময়লা ফেলা নিয়ে সচেতন নয়। ফলে দেখা গেছে, অধিকাংশ লোকজনই নানান ধরনের ময়লা আবর্জনা রাস্তায় ফেলে রাখে। পানি বা কোমল পানীয়ের বোতল, চিপস, চানাচুর, বিস্কুট ইত্যাদির প্যাকেট, সিগারেটের ঠোঙা, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, নারকেল বা ডাবের অবশিষ্টাংশ, ছেড়া কাগজ, টুথপেস্ট-এর অবশিষ্টাংশ এই জাতীয় হরেক রকম ময়লা আবর্জনা দেখা যায় সন্ধ্যার দিকে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর এলোমেলো বাতাসে উড়াউড়ি করছে।
পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রভাব পড়ার মতো এই বিষয়ে কিছু কারণ খতিয়ে দেখা যেতে পারে। আমরা জানি, ঢাকা ও অন্যান শহরের জনসংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশঙ্কাজনক হারে জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং ঘনবসতির কারণে ময়লা ব্যবস্থাপনা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে। বেশিরভাগ নাগরিকের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং অবহেলার কারণে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া বিপুল পরিমাণ ময়লা সঠিক ব্যবস্থাপনার দ্বারা সমাধান না হওয়ার ফলে নগরীর সমস্যা ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠছে।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের দুইটি সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ময়লা ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং জনবল সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। শহরের অনেক এলাকায় নির্ধারিত ময়লার বিন বা ডাম্পিং স্পট নেই। ফলে মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে ময়লা ফেলতে বাধ্য হয়। অবশ্য মানুষের অভ্যাসও এ ক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী বটে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যাপারে তারা অনেকটাই উদাসীন। আমরা সামান্য একটু সচেতন হলেই আবর্জনা ব্যবস্থাকে সুন্দর করে তুলতে পারি।
জনসাধারণকে সচেতন করার ব্যাপারে বেতার-টিভি ও পত্রপত্রিকা খুব একটা ভূমিকা রাখছে বলেও মনে হয় না। মানুষ যেন ধরেই নিয়েছে ময়লা-আবর্জনার মধ্যে বসবাস করাই হচ্ছে নিয়ম ও নিয়তি। ময়লা ফেলার উপর যথাযথ আইন এবং তার কার্যকর প্রয়োগের অভাবও আমি মনে করি ঢাকার রাস্তায় ময়লা ফেলার প্রবণতাকে অনেক গুণ বাড়িয়েছে। যেসব আইন আছে, সেগুলোর প্রয়োগ না হওয়া এবং নাগরিকদের আইন মানতে উৎসাহিত না করার ফলে পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
অস্বীকার করা যাবে না যে- ঢাকার রাস্তায় ময়লা ফেলার কারণে বিভিন্ন রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। ময়লা জমে থাকার কারণে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য মশাবাহিত রোগের প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও, বায়ুদূষণ এবং মাটিদূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
এক স্থানে অনেক সময় ধরে ময়লা জমে থাকার কারণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে দারুণভাবে। প্লাস্টিক, রাসায়নিক এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ মাটিতে মিশে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে এবং জলাশয় দূষিত করছে। এ ধরনের দূষণ জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে নিশ্চয়ই। ঢাকা শহরের বাতাস দূষিত হবার সাথে সাথে বেশি দূষিত হয়েছে ঢাকার প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা। ঢাকার বিভিন্ন নর্দমা, কলকারখানার ময়লা ও গৃহস্থালীর ময়লার অধিকাংশেরই শেষ গন্তব্য বুড়িগঙ্গা নদী। নদীটি এখন বলতে গেলে মৃতপ্রায়। ঢাকা শহরের যেকোন ড্রেনের পানির সাথে এই নদীর পানির কোনো পার্থক্য নেই। কুচকুচে কালো পানি। তাতে তীব্র কটু গন্ধ উৎপন্ন হচ্ছে। ঢাকা শহরের মোড়ে মোড়ে অবহেলায় জমে থাকা ময়লার কারণে ঢাকার সড়কগুলোতে যানজট বাড়ছে এবং এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এছাড়া, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্যও শহরটি ক্রমাগত আকর্ষণ হারাচ্ছে। ফলে পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ময়লা পরিষ্কারের জন্য সরকারের অর্থব্যয় বাড়ছে, যা অন্য খাতে বিনিয়োগ করা যেত। তাহলে একটি প্রশ্ন প্রায়ই মনের মধ্যে উদিত হ; সেটি হচ্ছে- ময়লা তবে কোথায় ফেলতে হবে?
এক বাক্যে সবাই যেন বলবে- কেন, রাস্তায়! ময়লা ফেলার উপযুক্ত স্থানই হচ্ছে রাস্তা। রাস্তা থাকতে ময়লা কোথায় ফেলতে হবে- এই কথা জিজ্ঞেস করার কী আছে। সবাই তো ময়লা রাস্তায়ই ফেলে। এটা তো আর নতুন কিছু নয়! যদিও নিয়মটি এই যে- ময়লা ফেলতে হবে নির্ধারিত ময়লা ফেলার ঝুড়ি কিংবা ডাস্টবিনে। বাড়িতে, পথে-ঘাটে, দোকানে, মার্কেটে, বাজারে সব জায়গায়ই থাকবে ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট ডাস্টবিন। সেখানে ময়লা ফেলা হলে পরে সেই ময়লা আবার সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লোকজন। কিন্তু এই সব সুযোগ সব জায়গায় সহজলভ্য নয়। বিধায় কারো কারো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও অবশ্যই আছে। দেখা যায়, মানুষ ময়লা রাস্তাতে ফেলতেই বেশি পছন্দ করে, বেশি ভালোবাসে। রাস্তায় চলতে গেলে দেখা যায়- বাংলাদেশের পথ-ঘাট ময়লা আবর্জনা দিয়ে ভরা। ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষজন সবাই পথের মাঝখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে চলে যাচ্ছে। সকাল বেলায় হাঁটলে একটি কমন দৃশ্য চোখে পড়বে তা হলো- দোকানিরা দোকান ঝাড়ু দিয়ে ময়লাটা ফেলছে রাস্তায়। এমনকি চলাচলরত পথচারীদের দিকেও তারা অনেক সময় ফিরে তাকায় না। তাদের গায়ের উপরই ময়লা ঝাড়ু দিয়ে ফেলে।
আবার শুকনা মৌসুমে দোকানের সামনে পানি ছিটিয়ে ধুলা উড়ানো বন্ধ করার চেষ্টা করতে দেখা যায় অনেককেই। পথচারীদের উপরও পানি ছুড়ে দিতে কার্পণ্য করে না তারা। নিরীহ গোবেচারা পথচারীদের কখনো কখনো ধুলায় ধূসরিত হতেও দেখা যায়। ধুলা বেশি জমলে বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে পরিবেশ হয় দারুণভাবে দূষিত। নাকে-চোখে-মুখে প্রবেশ করে অপবিত্র সব নোংরা ধুলা। আর বৃষ্টি এলে এইসব ধুলাই পরিণত হয়ে যায় নোংরা সব কাদায়। তখন পথে হাঁটার কোনো উপায়ই থাকে না। আর ঢাকার ধুলাবালি মানেই সাংঘাতিক রকমের দুর্গন্ধযুক্ত। যেমন ড্রেন থেকে ময়লা তুলে ড্রেনের পাশেই রেখে দেওয়া হয়। এই ময়লা শুকিয়ে ধুলা হয়ে আবারও বাতাসে উড়ে বেড়ায়। এরপর সেটা মানুষের নাক দিয়ে তার ফুসফুসে প্রবেশ করে। অবশেষে রক্তের মধ্যে দিয়ে পুরো শরীরে ঢুকে পড়ে নোংরা এইসব ময়লা থেকে সৃষ্টি হওয়া ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া।
নগরীর বেশিরভাগ নাগরিকের কাণ্ডজ্ঞান দেখলেই আমার মনে হয় তারা চায় না দেশটা সুন্দর আর পরিষ্কার ঝকঝকে থাকুক। দেশের বাইরে গিয়ে আমরা দেখতে পাই রাস্তাঘাট কতই-না পরিষ্কার ও ঝকঝকে-তকতকে। সেখানে প্রতিদিনই আধুনিক পদ্ধতিতে ঝাড়ু দেওয়া হয়। ধুলা তুলে নেওয়া হয় রাস্তা থেকে। সেই ধুলা ময়লার গাড়িতে ভরে শহর থেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ধুলার সাথে কোনো আপস করে না তারা। এভাবেই তারা শহরে উৎপন্ন ধুলা-ময়লার ব্যস্থাপনা করে থাকে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো- আমাদের নিজের দেশের রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার না থাকলেও বিদেশের রাস্তাঘাট ঝাড়ু দিয়ে দারুণ ঝকঝকে রাখছে আমাদের বাংলাদেশেরই মানুষ। তারা শ্রমিক হিসেবে সেখানে কাজ করে। সেখান থেকেও যদি তারা শিখে আমাদের দেশে এসে তার কোনো বিষয় অ্যাপ্লাই করে তাহলেও দেশের মানুষ উপকৃত হতে পারে। আবার এটাও দেখা যায়- অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বিদেশে থেকে বাংলাদেশে অনেকদিন পরে এলেন, সেখানে তার ভালো একটি অভ্যাস হয়েছে; যেখানে-সেখানে তিনি ময়লা ফেলেন না। এখন দেশে এসে ময়লা ফেলার জন্য অনেক সময় তিনি কোনো ডাস্টবিন খুঁজে পান না। তাদের ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে- অনেকে পকেটেও টুকটাক ময়লা নিয়ে ঘুরে বেড়ান ময়লা ফেলার যথাযথ জায়গার অভাবে। তাদের দেখে বাংলাদেশের অনেকে আবার এসময় বক্র উক্তি করতেও ছাড়ে না। আসলে ময়লা-আবর্জনা সঠিক জায়গায় ফেলতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে পরিবেশ দূষণ করা যাবে না। ময়লা-আবর্জনা নির্ধারিত ডাস্টবিনেই ফেলা উচিত। মনে রাখতে হবে- ঘরদুয়ার ঝাড়ু দিয়ে সংগৃহীত ময়লা এবং রান্না-বান্নার উপকরণের উচ্ছিষ্ট ময়লা কোনোভাবেই রাস্তার মাঝখানে ছুড়ে ফেলা যাবে না। তা জমিয়ে রেখে একটি নির্ধারিত ডাস্টবিনেই ফেলে আসতে হবে। এই ভালো অভ্যাস ছোটোদেরও শেখাতে হবে। আর সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক কলেজ শিক্ষক

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ময়লা-আবর্জনা রাস্তায় ফেলা বিবেচনাপ্রসূত কাজ নয়

আপডেট সময় : ০৯:৪৪:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ জুন ২০২৪

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দেশের অন্যতম প্রধান নগর এবং একটি দ্রুত বর্ধনশীল মহানগর। এই শহরের রাস্তা এবং অলিগলিতে এমনকি রাজপথেও ময়লা-আবর্জনা ফেলার প্রবণতা নগরজীবনকে দিনে দিনে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। এই সমস্যা শুধু পরিবেশগত নয়, এটি স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বেঁচে থাকার জন্য একটি নির্মল পরিবেশ থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।
আমি ঢাকার লালমাটিয়ার এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকি। এলাকাটি আশপাশের অনেক এলাকার চেয়েই বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর অনেকটাই ঝামেলা মুক্ত। বিশেষ করে প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যখন রাস্তায় বের হই রাস্তাগুলো এত সুন্দর ঝকঝকে তকতকে লাগে যে- মনে হয় বিদেশের কোনো একটা শহরে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ এই এলাকাতেই বিকেল চারটা-পাঁচটার দিকে মনে হয় ভয়াবহ রকম নোংরা আর আবর্জনাময় পরিবেশে বন্দি রয়েছি। এর কারণ কী। কারণ হচ্ছে এই এলাকার রাস্তাঘাটে বাইরের অনেক মানুষজন আসে। এমনকি এলাকাবাসী যারা নিয়মিত এই পথ দিয়ে যাতায়াত করে তারা অনেকেই রাস্তায় ময়লা ফেলা নিয়ে সচেতন নয়। ফলে দেখা গেছে, অধিকাংশ লোকজনই নানান ধরনের ময়লা আবর্জনা রাস্তায় ফেলে রাখে। পানি বা কোমল পানীয়ের বোতল, চিপস, চানাচুর, বিস্কুট ইত্যাদির প্যাকেট, সিগারেটের ঠোঙা, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, নারকেল বা ডাবের অবশিষ্টাংশ, ছেড়া কাগজ, টুথপেস্ট-এর অবশিষ্টাংশ এই জাতীয় হরেক রকম ময়লা আবর্জনা দেখা যায় সন্ধ্যার দিকে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর এলোমেলো বাতাসে উড়াউড়ি করছে।
পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রভাব পড়ার মতো এই বিষয়ে কিছু কারণ খতিয়ে দেখা যেতে পারে। আমরা জানি, ঢাকা ও অন্যান শহরের জনসংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশঙ্কাজনক হারে জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং ঘনবসতির কারণে ময়লা ব্যবস্থাপনা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে। বেশিরভাগ নাগরিকের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং অবহেলার কারণে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া বিপুল পরিমাণ ময়লা সঠিক ব্যবস্থাপনার দ্বারা সমাধান না হওয়ার ফলে নগরীর সমস্যা ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠছে।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের দুইটি সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ময়লা ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং জনবল সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। শহরের অনেক এলাকায় নির্ধারিত ময়লার বিন বা ডাম্পিং স্পট নেই। ফলে মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে ময়লা ফেলতে বাধ্য হয়। অবশ্য মানুষের অভ্যাসও এ ক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী বটে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যাপারে তারা অনেকটাই উদাসীন। আমরা সামান্য একটু সচেতন হলেই আবর্জনা ব্যবস্থাকে সুন্দর করে তুলতে পারি।
জনসাধারণকে সচেতন করার ব্যাপারে বেতার-টিভি ও পত্রপত্রিকা খুব একটা ভূমিকা রাখছে বলেও মনে হয় না। মানুষ যেন ধরেই নিয়েছে ময়লা-আবর্জনার মধ্যে বসবাস করাই হচ্ছে নিয়ম ও নিয়তি। ময়লা ফেলার উপর যথাযথ আইন এবং তার কার্যকর প্রয়োগের অভাবও আমি মনে করি ঢাকার রাস্তায় ময়লা ফেলার প্রবণতাকে অনেক গুণ বাড়িয়েছে। যেসব আইন আছে, সেগুলোর প্রয়োগ না হওয়া এবং নাগরিকদের আইন মানতে উৎসাহিত না করার ফলে পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
অস্বীকার করা যাবে না যে- ঢাকার রাস্তায় ময়লা ফেলার কারণে বিভিন্ন রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। ময়লা জমে থাকার কারণে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য মশাবাহিত রোগের প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও, বায়ুদূষণ এবং মাটিদূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
এক স্থানে অনেক সময় ধরে ময়লা জমে থাকার কারণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে দারুণভাবে। প্লাস্টিক, রাসায়নিক এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ মাটিতে মিশে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে এবং জলাশয় দূষিত করছে। এ ধরনের দূষণ জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে নিশ্চয়ই। ঢাকা শহরের বাতাস দূষিত হবার সাথে সাথে বেশি দূষিত হয়েছে ঢাকার প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা। ঢাকার বিভিন্ন নর্দমা, কলকারখানার ময়লা ও গৃহস্থালীর ময়লার অধিকাংশেরই শেষ গন্তব্য বুড়িগঙ্গা নদী। নদীটি এখন বলতে গেলে মৃতপ্রায়। ঢাকা শহরের যেকোন ড্রেনের পানির সাথে এই নদীর পানির কোনো পার্থক্য নেই। কুচকুচে কালো পানি। তাতে তীব্র কটু গন্ধ উৎপন্ন হচ্ছে। ঢাকা শহরের মোড়ে মোড়ে অবহেলায় জমে থাকা ময়লার কারণে ঢাকার সড়কগুলোতে যানজট বাড়ছে এবং এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এছাড়া, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্যও শহরটি ক্রমাগত আকর্ষণ হারাচ্ছে। ফলে পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ময়লা পরিষ্কারের জন্য সরকারের অর্থব্যয় বাড়ছে, যা অন্য খাতে বিনিয়োগ করা যেত। তাহলে একটি প্রশ্ন প্রায়ই মনের মধ্যে উদিত হ; সেটি হচ্ছে- ময়লা তবে কোথায় ফেলতে হবে?
এক বাক্যে সবাই যেন বলবে- কেন, রাস্তায়! ময়লা ফেলার উপযুক্ত স্থানই হচ্ছে রাস্তা। রাস্তা থাকতে ময়লা কোথায় ফেলতে হবে- এই কথা জিজ্ঞেস করার কী আছে। সবাই তো ময়লা রাস্তায়ই ফেলে। এটা তো আর নতুন কিছু নয়! যদিও নিয়মটি এই যে- ময়লা ফেলতে হবে নির্ধারিত ময়লা ফেলার ঝুড়ি কিংবা ডাস্টবিনে। বাড়িতে, পথে-ঘাটে, দোকানে, মার্কেটে, বাজারে সব জায়গায়ই থাকবে ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট ডাস্টবিন। সেখানে ময়লা ফেলা হলে পরে সেই ময়লা আবার সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লোকজন। কিন্তু এই সব সুযোগ সব জায়গায় সহজলভ্য নয়। বিধায় কারো কারো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও অবশ্যই আছে। দেখা যায়, মানুষ ময়লা রাস্তাতে ফেলতেই বেশি পছন্দ করে, বেশি ভালোবাসে। রাস্তায় চলতে গেলে দেখা যায়- বাংলাদেশের পথ-ঘাট ময়লা আবর্জনা দিয়ে ভরা। ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষজন সবাই পথের মাঝখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে চলে যাচ্ছে। সকাল বেলায় হাঁটলে একটি কমন দৃশ্য চোখে পড়বে তা হলো- দোকানিরা দোকান ঝাড়ু দিয়ে ময়লাটা ফেলছে রাস্তায়। এমনকি চলাচলরত পথচারীদের দিকেও তারা অনেক সময় ফিরে তাকায় না। তাদের গায়ের উপরই ময়লা ঝাড়ু দিয়ে ফেলে।
আবার শুকনা মৌসুমে দোকানের সামনে পানি ছিটিয়ে ধুলা উড়ানো বন্ধ করার চেষ্টা করতে দেখা যায় অনেককেই। পথচারীদের উপরও পানি ছুড়ে দিতে কার্পণ্য করে না তারা। নিরীহ গোবেচারা পথচারীদের কখনো কখনো ধুলায় ধূসরিত হতেও দেখা যায়। ধুলা বেশি জমলে বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে পরিবেশ হয় দারুণভাবে দূষিত। নাকে-চোখে-মুখে প্রবেশ করে অপবিত্র সব নোংরা ধুলা। আর বৃষ্টি এলে এইসব ধুলাই পরিণত হয়ে যায় নোংরা সব কাদায়। তখন পথে হাঁটার কোনো উপায়ই থাকে না। আর ঢাকার ধুলাবালি মানেই সাংঘাতিক রকমের দুর্গন্ধযুক্ত। যেমন ড্রেন থেকে ময়লা তুলে ড্রেনের পাশেই রেখে দেওয়া হয়। এই ময়লা শুকিয়ে ধুলা হয়ে আবারও বাতাসে উড়ে বেড়ায়। এরপর সেটা মানুষের নাক দিয়ে তার ফুসফুসে প্রবেশ করে। অবশেষে রক্তের মধ্যে দিয়ে পুরো শরীরে ঢুকে পড়ে নোংরা এইসব ময়লা থেকে সৃষ্টি হওয়া ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া।
নগরীর বেশিরভাগ নাগরিকের কাণ্ডজ্ঞান দেখলেই আমার মনে হয় তারা চায় না দেশটা সুন্দর আর পরিষ্কার ঝকঝকে থাকুক। দেশের বাইরে গিয়ে আমরা দেখতে পাই রাস্তাঘাট কতই-না পরিষ্কার ও ঝকঝকে-তকতকে। সেখানে প্রতিদিনই আধুনিক পদ্ধতিতে ঝাড়ু দেওয়া হয়। ধুলা তুলে নেওয়া হয় রাস্তা থেকে। সেই ধুলা ময়লার গাড়িতে ভরে শহর থেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ধুলার সাথে কোনো আপস করে না তারা। এভাবেই তারা শহরে উৎপন্ন ধুলা-ময়লার ব্যস্থাপনা করে থাকে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো- আমাদের নিজের দেশের রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার না থাকলেও বিদেশের রাস্তাঘাট ঝাড়ু দিয়ে দারুণ ঝকঝকে রাখছে আমাদের বাংলাদেশেরই মানুষ। তারা শ্রমিক হিসেবে সেখানে কাজ করে। সেখান থেকেও যদি তারা শিখে আমাদের দেশে এসে তার কোনো বিষয় অ্যাপ্লাই করে তাহলেও দেশের মানুষ উপকৃত হতে পারে। আবার এটাও দেখা যায়- অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বিদেশে থেকে বাংলাদেশে অনেকদিন পরে এলেন, সেখানে তার ভালো একটি অভ্যাস হয়েছে; যেখানে-সেখানে তিনি ময়লা ফেলেন না। এখন দেশে এসে ময়লা ফেলার জন্য অনেক সময় তিনি কোনো ডাস্টবিন খুঁজে পান না। তাদের ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে- অনেকে পকেটেও টুকটাক ময়লা নিয়ে ঘুরে বেড়ান ময়লা ফেলার যথাযথ জায়গার অভাবে। তাদের দেখে বাংলাদেশের অনেকে আবার এসময় বক্র উক্তি করতেও ছাড়ে না। আসলে ময়লা-আবর্জনা সঠিক জায়গায় ফেলতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে পরিবেশ দূষণ করা যাবে না। ময়লা-আবর্জনা নির্ধারিত ডাস্টবিনেই ফেলা উচিত। মনে রাখতে হবে- ঘরদুয়ার ঝাড়ু দিয়ে সংগৃহীত ময়লা এবং রান্না-বান্নার উপকরণের উচ্ছিষ্ট ময়লা কোনোভাবেই রাস্তার মাঝখানে ছুড়ে ফেলা যাবে না। তা জমিয়ে রেখে একটি নির্ধারিত ডাস্টবিনেই ফেলে আসতে হবে। এই ভালো অভ্যাস ছোটোদেরও শেখাতে হবে। আর সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক কলেজ শিক্ষক