নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের স্বাধীনতার জন্য ৫৪ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ করার কথা উল্লেখ করে দেশবাসীর উদ্দেশে বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান প্রশ্ন করেছেন, এই দেশে তাঁর বেঁচে থাকার অধিকার আছে কি না। বিশ্বজুড়ে ঘৃণিত ‘মব জাস্টিস’ তাঁর ওপর চলতে পারে কি না। এগুলোর উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে এসবের প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ফজলুর রহমান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে ‘কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগে গত রোববার (২৪ আগস্ট) তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিএনপি। এরপর মধ্যরাত থেকে তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ফজলুর রহমানের বাসার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন একদল ব্যক্তি।
এ পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফজলুর রহমান সোমবার (২৫ আগস্ট) দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘হে বাংলাদেশের মানুষ, আমি তো আজ থেকে ৫৪ বছর আগে আপনাদের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আজকে যে সন্তানেরা আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়, তোমাদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করার জন্য আমি যুদ্ধ করেছিলাম। তোমাদের কাছ থেকে কি অপমৃত্যুটা আমার কাম্য?’
ফজলুর রহমান বলেন, ‘যদি আমার কোনো কথায় তোমরা মনে করো, আমি দেশের বিরুদ্ধে কথা বলছি বা তোমাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলছি, আমার বিরুদ্ধে মামলা করো, আমাকে গ্রেপ্তার করো, আমাকে শাস্তি দাও। কিন্তু আমাকে হত্যা করার জন্য আমার বাসা পর্যন্ত মব সৃষ্টি করো গিয়া, যেটা গত এক বছর যাবৎ বাংলাদেশে, এই পৃথিবীতে এবং বাংলাদেশে সবচেয়ে কুখ্যাত নাম মব, সেই মব জাস্টিস আমার ওপর চলতে পারে কি না এবং চলবে কি না, সেটা আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করতে চাই।’ এর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে অবস্থিত ল রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যালয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ফজলুর রহমান। এ সময় তাঁর স্ত্রী ও ছেলেও উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে ফজলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের মানুষ, আপনারা জেনে রাখুন, আমার জীবন বড় শঙ্কায় আছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আমি একজন মানুষ। আমার অধিকার আছে বেঁচে থাকার।
এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করবেন কি না প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, ‘জিডি করব না, মাইরা ফেললেও… জিডি-টিডি কিছুই করব না।’
সংবাদ সম্মেলনে ফজলুর রহমান বলেন, আমার প্রধান কাজ হলো, রাজনীতি করা। আর নিজের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য আমি ওকালিত করি। গতকালকে (রোববার) একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি পাঁচটার দিকে শুনতে পেলাম যে আমাকে দল একটা শোকজ নোটিশ দিয়েছে, আমার দল জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। রাত নয়টায় দলের একটা কাগজও পেলাম। দেখলাম, আমার নামে দল কিছু কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তার জন্য শোকজ নোটিশ করেছে, উত্তর দেওয়ার জন্য। এটা খুবই একটা স্বাভাবিক ঘটনা। একটা রাজনৈতিক দলের একজন কর্মীর প্রতি তাঁর দল যদি মনে করে, কর্মীর বোধ হয় কিছু ক্রটি-বিচ্যুতি আছে, তাকে শোকজ করতেই পারে। আমাকেও করেছে। নির্দিষ্টভাবেই আমি বলতে চাই, আমি তার উত্তর দলকে দেবো। দল যা জানতে চায়, তা-ও আমি বলবো। তারপরে দল আমার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেবে। এখন পর্যন্ত কিন্তু আমি দলের মধ্যেই আছি, এখন পর্যন্ত আমি দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
শোকজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কোনো লিঙ্ক (যোগসূত্র) খুঁজে পাচ্ছেন কি না প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, ‘শোকজের সঙ্গে লিঙ্ক খুঁজে পাচ্ছি, এটি এখনো বলবো না। তবে তারা আগে থেকে অনেক মানুষের..আমি তো ফজলুর রহমান, সামান্য মানুষ; কত মহান মানুষের গালে তারা জুতা মারছে…। আমার কথা হলো জুতা মারে, কথা বলে, সেটা তো বলবেই। তাদের ব্যাপারে মানুষ বিচার করবে। কিন্তু আমার বাসার সামনে গিয়া আমাকে হত্যা করার জন্য বা আমার মৌলিক অধিকারকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য; কথাটা জাতির সামনে জানিয়ে গেলাম। তারা আমাকে জুতা মারবে না মিছিল করবে, এটা করুক গিয়ে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলে থাকলে তারা গিয়া মামলা করুক আমার বিরুদ্ধে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমার জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপার বলে গেলাম। আমার এ দেশে বাঁচার অধিকার আছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এখন আমার বাসার সামনে গিয়ে যেগুলো হচ্ছে, আপনাদের মাধ্যমে জাতিকে, দেশকে এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে জানিয়ে গেলাম।’
‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিরুদ্ধে বলেছি, বলব’: এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান বলেন, ‘ছেলেরা বা ছাত্ররা যদি মনে করে, অন্য দলের লোকেরা যদি মনে করে, আমি জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোকজনের বিরুদ্ধে আমি কথা বলেছি, এটা আমি বলব। এতে যদি কোনো ধরনের আমার কথার মধ্যে কারও প্রতি অসম্মান করে থাকি, আঘাত করে থাকি, তারা মনে করে, তাহলে তারা রাজনৈতিকভাবে এটার জবাব দেবে, আমি তাদের জবাব দেবো। এটার জন্য তো পরস্পরকে হত্যা করার ব্যাপার নাই। বাসার সামনে মব করার তো দরকার নাই।’
আগে সংবাদ সম্মেলনে ফজলুর রহমান বলেন, আজকে (সোমবার) হঠাৎ করে যেটি দুর্ভাগ্যজনক, আমার বাসার সামনে কিছু মিছিলের শব্দ পাইলাম। সেই শব্দগুলো বলাটাও আমার কাছে মনে হইল, কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমার সন্তানের সমান। এরা কারা, আমি চিনিও না। এরা স্লোগান আমার নামে দিল, ফজু পাগলাকে গ্রেফতার করো…ইত্যাদি ইত্যাদি। ফজু পাগলা মানে আমি বাংলাদেশে এখন ফজু পাগলা হয়ে গেছি। এই নামটা আমাকে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামী- আমি নাকি ফজু পাগলা। প্রথম এই কথাটা বলেছে, মুফতি আমির হামজা নামে একজন লোক। এই ছেলেপেলেরাও আমার নামে ফজু পাগলা স্লোগান দিয়েছে, আমি বাংলাদেশের একজন পাগলা। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, তারা আমাকে হত্যা করতে চায়। আমাকে মারতে চায়, তারা আমার বাসার সামনে যেভাবে গিয়ে মব সৃষ্টি করেছে… আমি দেখছি, গত এক বছর যাবৎ ৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের কিছু সন্তান মব সৃষ্টি করে তাদের দাবিদাওয়া বলেন, আর যা-ই বলেন, আদায় করতে চায়। কিন্তু আমার মতো একজন সিনিয়র মানুষ যে দেশটার জন্য যুদ্ধ করেছি, আমি যুদ্ধ না করলে বা মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ না করলে এই সন্তনেরা তো বাংলাদেশের সন্তান হইত না, এরা হইত পাকিস্তানের সন্তান। আমাদেরকে হত্যা করা বা আমাদের নামে বিশ্রী স্লোগান দেওয়া বা আমি একটা ভাড়া বাসায় (সেগুনবাগিচাস্থ কনকর্ড টাওয়ার) থাকি, এটা নিজের কোনো বাসা না।’
ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করতাছি, আমি যে ভাড়া বাসায় আছি, যেভাবে গিয়ে আমার সঙ্গে মব সৃষ্টি করা হইছে, বাসায় আমাকে থাকতে দেবে কি না?…মালিক বলতে পারে, ভাই, আপনাকে বাসা ভাড়া দিলে আমার বাড়িঘর পুইড়া ফেলবে, যেইটা করতাছে মব। আমি আমার জীবন নিয়ে চিন্তিত যতটা, তার চেয়ে আমার স্ত্রী দেখেন বসে আছে। আমার সন্তানেরাও ওখানে থাকে। দুই সন্তান আমার সাথে থাকে। তাদের তো কোনো অপরাধ নাই। একজনের বাসা পর্যন্ত গিয়া মব সৃষ্টি করা যেটি বাংলাদেশে হচ্ছে, সেটি ন্যায়ভিত্তিক মনে করেন কি না?’
অপমৃত্যু আমার কাছে সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক: বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমি আমার জীবন, আমি কোনো ভয় করি না। মৃত্যুকে আমি কোনো দিন ভয় করি না। কিন্তু অপমৃত্যু আমার কাছে সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক। আমার কাছে মনে হচ্ছে, দেশ–বিদেশ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির যারা ইউটিউবার এবং যারা তাদের পক্ষে সাংবাদিকতা করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষে দেশ–বিদেশে থেকে বেশ কয়েক দিন যাবৎ প্রথম বলছে, ফজলুর রহমানকে মব জাস্টিস করো, তার ওপর মব জাস্টিস এখন প্রযোজ্য।ৃফান্স থেকে দুজন সাংবাদিক বলেছে, তাকে হত্যা করাই দরকার।ৃজামায়াতের একজন ইউটিউবার বলেছে, ফজলু পাগলাকে জবাই করেই হত্যা করতে হবে। এই যে অবস্থা, এই অবস্থাটা জানানোর জন্য আমি আপনাদের কাছে এসেছি। তার রেজাল্ট দেখছি, আমার বাড়ির সামনে সাত–আট বা নয়জন ছেলেমেয়ে, তারা কারা, কোন দলের; আমি চিনি না।’
আমার বাঁচার অধিকার এ দেশে আছে: ‘এই যে অবস্থা, এই অবস্থাতে আমি তো বাংলাদেশের একজন নাগরিক; আমার তো বাঁচার অধিকার আছে’ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে বাংলাদেশের জনগণের কাছে হাত জোড় করে আহ্বান জানাব, আমি বাংলাদেশের ফজলুর রহমান। আমি হাত জোড় করে জানাব, আমি একজন মানুষ। আমি হাত জোড় করে আপনাদের কাছে, জনগণের কাছে বলতে চাই, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার বাঁচার অধিকার এ দেশে আছে, এটা আমি মনে করি। এটা আপনারা মনে করেন কি না? কিন্তু আপনারা কি মনে করেন, এভাবে আমাকে হত্যা করলে পরে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের যে অবস্থা, সে অবস্থাটা কি এ রকমই থাকবে? আমাকে হত্যা করা উচিত বলেই কি আপনারা মনে করেন? আর আমার দলকে আমি বলব, এই কথাটা দল আমাকে একটা শোকজ করতেই পারে, আমি উত্তর দেব। এটা দলের সঙ্গে আমার ব্যাপার, তখন দেখা যাবে। কিন্তু আমাকে হত্যা করার জন্য যারা আসল, আমি তাদেরকে চিনি না, জানি না। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কও নাই। তাদের সঙ্গে আমার শত্রুতাও নাই। আমার কোনো মিত্রতাও নাই। কিন্তু এই যে মব একটা সিচুয়েশন সৃষ্টি হইয়া আমাকে যে হত্যা করার জন্য বা আমার ছেলেমেয়েদের সর্বনাশ করার জন্য, আমার পরিবারকে সর্বনাশ করার জন্য, আমি একটা ভাড়া বাসায় থাকি, এর মধ্য দিয়ে আমার কাছে মনে হচ্ছে যে এই দেশে আমার বাঁচার অধিকার আছে কি নাই, এটা জনগণকে জানানো উচিত।’
আমি একা দেশে চলতে পারব না: সংবাদ সম্মেলনে ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণকে আবারও প্রশ্ন করতে চাই, এ দেশে আমার বাঁচার অধিকার আছে কি না? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমার স্ত্রীর যোগোযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসেছে। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। আমি শুনেছি আর্মিও এসেছে। তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু পুলিশ আর আর্মি আসাই কি আমার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে আমার জন্য খুব সম্মানজনক ব্যাপার। যারা আমাকে বাঁচাইতে চাবে যে পুলিশ-আর্মি গার্ড করবে, আমি একা একা দেশে চলতে পারবো না?’
ফজলুর রহমান বলেন, ‘সারা জাতিকে জানাতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ, আপনারা জেনে রাখুন, আমার জীবন বড় শঙ্কায় আছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি।ৃআমি একজন মানুষ। আমার অধিকার আছে বেঁচে থাকার।’
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ