ঢাকা ১২:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মব জাস্টিসের ‘বিশুদ্ধ নমুনা’ ৯২’র গণআদালত: ফরহাদ মজহার

  • আপডেট সময় : ০৮:১৮:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : নব্বইয়ের দশকের শুরুতে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি জোরালো হলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঢাকায় যে ‘গণআদালত’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটি মব জাস্টিসের ‘বিশুদ্ধ নমুনা’ বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও রাষ্ট্র চিন্তক ফরহাদ মজহার। একুশে বইমেলায় ভারতে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের বই ‘তৌহিদী জনতার’ নামে এক দল লোকের প্রত্যাহারের দাবি ও উত্তেজনার পরিস্থিতি এবং সাম্প্রতিক আলোচিত ‘মব জাস্টিস’ শব্দবন্ধ নিয়ে বুধবার নিজের ফেইসবুক পেইজে দেওয়া পোস্টে এই মন্তব্য করেছেন তিনি। দীর্ঘ পোস্টে ফরহাদ মজহার লিখেছেন, “তৌহিদী জনতা হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে অনেককে খুব শরমিন্দা ও অপরাধী মনে হচ্ছে। অন্যদিকে যারা নিজেদের বাম ও প্রগতিশীল দাবি করেন, তারা তৌহিদী জনতার রণধ্বনিকে ‘মব ও সন্ত্রাস’ গণ্য করেন এবং আইনের শাসনের নামে মূর্ছা যান। “ইনসাফ হবে যদি গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তৌহিদী জনতাও ‘গণ আদালত’ কায়েম করে।

কিন্তু তারা সেটা করেনি। শুধু একুশের বই মেলায় গণঅভ্যুত্থান বিরোধী একজন লেখিকার বই প্রত্যাহারের দাবি করেছে। তাতেই তৌহিদী জনতাকে মব ডাকা এবং মব জাস্টিসের ভীতি দেখানো শুরু হয়ে গেছে। ভালো।” পোস্টে তিনি ‘তৌহিদী জনতা’, ‘মব জাস্টিস’ ও নব্বইয়ের দশকের ‘গণআদালত’ ও বামপন্থি রাজনীতির ধারাসহ বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার দশম দিন সোমবার সন্ধ্যায় ‘সব্যসাচী’ প্রকাশনীর স্টলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ‘তৌহিদী জনতা’র নামে একদল লোক সেখানে চড়াও হয়। তারা স্টলটিতে গিয়ে প্রকাশককে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সব্যসাচীর প্রকাশক শতাব্দী ভবকে বইমেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষও ঘিরে রাখে উত্তেজিত ওই ব্যক্তিরা। এই ঘটনায় তীব্র সমালোচনা হলে ওই দিন রাতেই দোষীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

বিষয়টি নিয়ে সরকারের এক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ‘দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা মব’ সৃষ্টি করা হলে জড়িতদের শক্ত হাতে দমনের হুঁশিয়ারি দেন। ‘তৌহিদী জনতার’ উদ্দেশে মাহফুজ বলেন, “অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাইলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট (গণ্য) করা হবে। আজকের (সোমবার) ঘটনার পর আর কোনো অনুরোধ করা হবে না।” এই বক্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলে ফেইসবুকে অপর এক পোস্টে ব্যাখ্যাও দেন মাহফুজ। ‘তৌহিদী জনতাকে’ ‘মবের সঙ্গে তুলনার’ সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার তার পোস্টে লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিত স্বজনদের উদ্যোগে এবং জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়। সেই সংগঠন ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় গণআদালত আয়োজন করে। “সেটা ছিল বিদ্যমান সংবিধান, আইন ও আদালতের বাইরে এবং রাষ্ট্রের বিপরীতে ‘মব জাস্টিসের’ বিশুদ্ধ নমুনা।”
‘তসলিমা ঘোষণা দিয়েই অভ্যুত্থানবিরোধী’

ফরহাদ মজহার লিখেছেন, “তসলিমা নাসরিন স্রেফ একজন লেখক নন, তিনি ঘোষণা দিয়েই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিরোধী। তাকে বাংলাদেশের জনগণ দিল্লির আগ্রাসী স্বার্থ এবং ‘হিন্দুত্ববাদের প্রপাগান্ডিস্ট’ হিসেবেই গণ্য করে। “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দিল্লির আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদের একজন রাজনৈতিক ‘প্রপাগান্ডিস্টকে’ লেখকের স্বাধীনতার আড়ালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করবার তৎপরতার বিচার সাহিত্য নয়, রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। “আবার দেখুন, খোদ একুশের বই মেলাতেই লেখকের স্বাধীনতার নামে হিন্দুত্ববাদী দিল্লির আগ্রাসী সাংস্কৃতিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা কেন? কারা এটা করছে? কেন করছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই এর জবাব দিতে হবে।” বইমেলায় সব্যসাচী স্টলের ঘটনাকে ‘লেখকের স্বাধীনতার নামে হিন্দুত্ববাদী দিল্লির আগ্রাসী সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার কৌশল’ বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। এর বিপরীতেই ‘তৌহিদী জনতার প্রতিরোধ ও তাদের রণধ্বনি’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“এই রণধ্বনি সকল প্রকার গোলামির বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট রক্ষার স্লোগান হিসেবে হাজির হয়েছে। উপদেষ্টা সরকারকে বুঝতে হবে এর পেছনে জনগণের গণঅভিপ্রায়ের উপাদান আছে। “খেয়াল করুন, যখন একের পর এক মাজার ভাঙা চলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার কোনো বিহিত করেনি। এখন তসলিমা নাসরিনের বইয়ের স্টলে জনগণ প্রতিবাদ করায় তাদের বিরুদ্ধে অপারেশান ডেভিল হান্ট লেলিয়ে দেবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।”

বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের বই নিয়ে উত্তেজনা, স্টলে চড়াও ‘তৌহিদী জনতা’
বই মেলায় ‘তৌহিদী জনতার’ ক্ষোভ-বিক্ষোভকে ‘ন্যায়সঙ্গত’ মন্তব্য করে তিনি লিখেছেন, “যারা সহ্য করতে পারছেন না, তারা তৌহিদী জনতাকে ‘মব’ বলে নিন্দা করতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। “ভুলে যাবেন না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সৃষ্ট ক্ষত শুকাবার আগে রাজাকারের ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই হুংকারে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস বাম ও প্রগতিশীলরা জাতিবাদী বাঙালিদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রকম্পিত করেছিল। ‘আমি কে তুমি কে বাঙালি বাঙালি’ বলে উচ্চবর্ণের হিন্দুর তৈরি বাঙালি পরিচয়কেই তারা একমাত্র পরিচয় দাবি করেছে। “তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রকল্প হচ্ছে ইসলাম নির্মূল। নির্মূলের রাজনীতিই বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। তৌহিদী জনতার তকবিরে তাই অনেকের হৃদকম্পন শুরু হয়। তৌহিদী জনতা নিকৃষ্ট জাতিবাদী ও ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বিপরীতেই গড়ে উঠেছে।”
‘বামপন্থি রাজনীতি ইসলাম বিদ্বেষী”

দেশের বামপন্থি রাজনীতিকে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ হিসেবে দেখেন ফরহাদ মজহার।
এ বিষয়ে তার ফেইসবুক পেইজে তিনি লিখেছেন, “আমি বরাবরই গণমানুষের রাজনীতি করেছি। তাই বাম ও প্রগতিশীলের ইসলাম নির্মূল রাজনীতির বিরোধিতা করেছি। বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতি ইসলাম বিদ্বেষী। এই ধর্ম বিদ্বেষ শ্রেণি রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই বরাবরই এর বিরোধিতা করেছি। আজ ‘মব’ কিংবা ‘মব জাস্টিসের’ ভয় দেখিয়ে যেভাবে জনগণের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভকে দাবিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। “ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতি বাংলাদেশে সেক্যুলার জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতির মর্মবস্তু। এই ভুল রাজনীতির কারণে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতজীবী শ্রেণির পক্ষে শক্তিশালী গণরাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলা যায়নি।” জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ওপর গণঅভ্যুত্থানের পূর্ণ বিজয়ের সাফল্য নির্ভর করে জানিয়ে তিনি লিখেছেন, “অথচ জনগণকে শ্রেণি ও শ্রেণি সচেতনতার জায়গা থেকে নয়– বরং ইসলাম বনাম ইসলাম নির্মূল রাজনীতির বিভাজন দণ্ড দিয়ে বিভক্ত রাখবার কায়দা দিয়ে আমরা বুঝি। এটা ঠিক নয়। এই কারণেই বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারা বিকশিত হতে পারেনি। “এরই প্রতিক্রিয়ায় সেক্যুলার জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট ধারার বিপরীতে বাংলাদেশে ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। ধর্মীয় জাতিবাদ এবং পরিচয় সর্বস্ব রাজনীতির আড়ালে ইসলামের ইহলৌকিক, মানবিক এবং সার্বজনীন মর্ম ও আবেদন মুখ থুবড়ে পড়ছে বারবার। বিপজ্জনক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের রণনীতি ও রণকৌশলের নির্ণয় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কার্যকর ভাষা আমরা তৈরি করতে পারিনি।”

ফরহাদ মজহার বলেন, “ইসলাম নির্মূল রাজনীতি একইসঙ্গে ছিল দিল্লির আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ‘তাঁবেদারি’। আজকাল যারা কথায় কথায় ‘মব’ এবং ‘মব জাস্টিস’ এর কথা বলছেন তারা পুরনো ইতিহাস মনে রাখবেন, প্লিজ। “বাম ও প্রগতিশীলরা নিজেদের ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ দাবি করে আইন বা সংবিধানের তোয়াক্কা করেনি। চিরকাল ‘মব জাস্টিস’ করে গিয়েছে। এখন তৌহিদী জনতা বর্গটির বিরুদ্ধে তাদের আক্রোশ চরম বিনোদনের জন্ম দিয়েছে।”

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আয়নাঘরের পরতে পরতে নির্যাতনের চিহ্ন

মব জাস্টিসের ‘বিশুদ্ধ নমুনা’ ৯২’র গণআদালত: ফরহাদ মজহার

আপডেট সময় : ০৮:১৮:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক : নব্বইয়ের দশকের শুরুতে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি জোরালো হলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঢাকায় যে ‘গণআদালত’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটি মব জাস্টিসের ‘বিশুদ্ধ নমুনা’ বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও রাষ্ট্র চিন্তক ফরহাদ মজহার। একুশে বইমেলায় ভারতে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের বই ‘তৌহিদী জনতার’ নামে এক দল লোকের প্রত্যাহারের দাবি ও উত্তেজনার পরিস্থিতি এবং সাম্প্রতিক আলোচিত ‘মব জাস্টিস’ শব্দবন্ধ নিয়ে বুধবার নিজের ফেইসবুক পেইজে দেওয়া পোস্টে এই মন্তব্য করেছেন তিনি। দীর্ঘ পোস্টে ফরহাদ মজহার লিখেছেন, “তৌহিদী জনতা হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে অনেককে খুব শরমিন্দা ও অপরাধী মনে হচ্ছে। অন্যদিকে যারা নিজেদের বাম ও প্রগতিশীল দাবি করেন, তারা তৌহিদী জনতার রণধ্বনিকে ‘মব ও সন্ত্রাস’ গণ্য করেন এবং আইনের শাসনের নামে মূর্ছা যান। “ইনসাফ হবে যদি গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তৌহিদী জনতাও ‘গণ আদালত’ কায়েম করে।

কিন্তু তারা সেটা করেনি। শুধু একুশের বই মেলায় গণঅভ্যুত্থান বিরোধী একজন লেখিকার বই প্রত্যাহারের দাবি করেছে। তাতেই তৌহিদী জনতাকে মব ডাকা এবং মব জাস্টিসের ভীতি দেখানো শুরু হয়ে গেছে। ভালো।” পোস্টে তিনি ‘তৌহিদী জনতা’, ‘মব জাস্টিস’ ও নব্বইয়ের দশকের ‘গণআদালত’ ও বামপন্থি রাজনীতির ধারাসহ বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার দশম দিন সোমবার সন্ধ্যায় ‘সব্যসাচী’ প্রকাশনীর স্টলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ‘তৌহিদী জনতা’র নামে একদল লোক সেখানে চড়াও হয়। তারা স্টলটিতে গিয়ে প্রকাশককে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সব্যসাচীর প্রকাশক শতাব্দী ভবকে বইমেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষও ঘিরে রাখে উত্তেজিত ওই ব্যক্তিরা। এই ঘটনায় তীব্র সমালোচনা হলে ওই দিন রাতেই দোষীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

বিষয়টি নিয়ে সরকারের এক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ‘দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা মব’ সৃষ্টি করা হলে জড়িতদের শক্ত হাতে দমনের হুঁশিয়ারি দেন। ‘তৌহিদী জনতার’ উদ্দেশে মাহফুজ বলেন, “অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাইলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট (গণ্য) করা হবে। আজকের (সোমবার) ঘটনার পর আর কোনো অনুরোধ করা হবে না।” এই বক্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলে ফেইসবুকে অপর এক পোস্টে ব্যাখ্যাও দেন মাহফুজ। ‘তৌহিদী জনতাকে’ ‘মবের সঙ্গে তুলনার’ সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার তার পোস্টে লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিত স্বজনদের উদ্যোগে এবং জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়। সেই সংগঠন ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় গণআদালত আয়োজন করে। “সেটা ছিল বিদ্যমান সংবিধান, আইন ও আদালতের বাইরে এবং রাষ্ট্রের বিপরীতে ‘মব জাস্টিসের’ বিশুদ্ধ নমুনা।”
‘তসলিমা ঘোষণা দিয়েই অভ্যুত্থানবিরোধী’

ফরহাদ মজহার লিখেছেন, “তসলিমা নাসরিন স্রেফ একজন লেখক নন, তিনি ঘোষণা দিয়েই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিরোধী। তাকে বাংলাদেশের জনগণ দিল্লির আগ্রাসী স্বার্থ এবং ‘হিন্দুত্ববাদের প্রপাগান্ডিস্ট’ হিসেবেই গণ্য করে। “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দিল্লির আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদের একজন রাজনৈতিক ‘প্রপাগান্ডিস্টকে’ লেখকের স্বাধীনতার আড়ালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করবার তৎপরতার বিচার সাহিত্য নয়, রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। “আবার দেখুন, খোদ একুশের বই মেলাতেই লেখকের স্বাধীনতার নামে হিন্দুত্ববাদী দিল্লির আগ্রাসী সাংস্কৃতিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা কেন? কারা এটা করছে? কেন করছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই এর জবাব দিতে হবে।” বইমেলায় সব্যসাচী স্টলের ঘটনাকে ‘লেখকের স্বাধীনতার নামে হিন্দুত্ববাদী দিল্লির আগ্রাসী সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার কৌশল’ বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। এর বিপরীতেই ‘তৌহিদী জনতার প্রতিরোধ ও তাদের রণধ্বনি’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“এই রণধ্বনি সকল প্রকার গোলামির বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট রক্ষার স্লোগান হিসেবে হাজির হয়েছে। উপদেষ্টা সরকারকে বুঝতে হবে এর পেছনে জনগণের গণঅভিপ্রায়ের উপাদান আছে। “খেয়াল করুন, যখন একের পর এক মাজার ভাঙা চলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার কোনো বিহিত করেনি। এখন তসলিমা নাসরিনের বইয়ের স্টলে জনগণ প্রতিবাদ করায় তাদের বিরুদ্ধে অপারেশান ডেভিল হান্ট লেলিয়ে দেবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।”

বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের বই নিয়ে উত্তেজনা, স্টলে চড়াও ‘তৌহিদী জনতা’
বই মেলায় ‘তৌহিদী জনতার’ ক্ষোভ-বিক্ষোভকে ‘ন্যায়সঙ্গত’ মন্তব্য করে তিনি লিখেছেন, “যারা সহ্য করতে পারছেন না, তারা তৌহিদী জনতাকে ‘মব’ বলে নিন্দা করতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। “ভুলে যাবেন না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সৃষ্ট ক্ষত শুকাবার আগে রাজাকারের ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই হুংকারে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস বাম ও প্রগতিশীলরা জাতিবাদী বাঙালিদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রকম্পিত করেছিল। ‘আমি কে তুমি কে বাঙালি বাঙালি’ বলে উচ্চবর্ণের হিন্দুর তৈরি বাঙালি পরিচয়কেই তারা একমাত্র পরিচয় দাবি করেছে। “তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রকল্প হচ্ছে ইসলাম নির্মূল। নির্মূলের রাজনীতিই বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। তৌহিদী জনতার তকবিরে তাই অনেকের হৃদকম্পন শুরু হয়। তৌহিদী জনতা নিকৃষ্ট জাতিবাদী ও ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বিপরীতেই গড়ে উঠেছে।”
‘বামপন্থি রাজনীতি ইসলাম বিদ্বেষী”

দেশের বামপন্থি রাজনীতিকে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ হিসেবে দেখেন ফরহাদ মজহার।
এ বিষয়ে তার ফেইসবুক পেইজে তিনি লিখেছেন, “আমি বরাবরই গণমানুষের রাজনীতি করেছি। তাই বাম ও প্রগতিশীলের ইসলাম নির্মূল রাজনীতির বিরোধিতা করেছি। বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতি ইসলাম বিদ্বেষী। এই ধর্ম বিদ্বেষ শ্রেণি রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই বরাবরই এর বিরোধিতা করেছি। আজ ‘মব’ কিংবা ‘মব জাস্টিসের’ ভয় দেখিয়ে যেভাবে জনগণের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভকে দাবিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। “ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতি বাংলাদেশে সেক্যুলার জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতির মর্মবস্তু। এই ভুল রাজনীতির কারণে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতজীবী শ্রেণির পক্ষে শক্তিশালী গণরাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলা যায়নি।” জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ওপর গণঅভ্যুত্থানের পূর্ণ বিজয়ের সাফল্য নির্ভর করে জানিয়ে তিনি লিখেছেন, “অথচ জনগণকে শ্রেণি ও শ্রেণি সচেতনতার জায়গা থেকে নয়– বরং ইসলাম বনাম ইসলাম নির্মূল রাজনীতির বিভাজন দণ্ড দিয়ে বিভক্ত রাখবার কায়দা দিয়ে আমরা বুঝি। এটা ঠিক নয়। এই কারণেই বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারা বিকশিত হতে পারেনি। “এরই প্রতিক্রিয়ায় সেক্যুলার জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট ধারার বিপরীতে বাংলাদেশে ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। ধর্মীয় জাতিবাদ এবং পরিচয় সর্বস্ব রাজনীতির আড়ালে ইসলামের ইহলৌকিক, মানবিক এবং সার্বজনীন মর্ম ও আবেদন মুখ থুবড়ে পড়ছে বারবার। বিপজ্জনক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের রণনীতি ও রণকৌশলের নির্ণয় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কার্যকর ভাষা আমরা তৈরি করতে পারিনি।”

ফরহাদ মজহার বলেন, “ইসলাম নির্মূল রাজনীতি একইসঙ্গে ছিল দিল্লির আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ‘তাঁবেদারি’। আজকাল যারা কথায় কথায় ‘মব’ এবং ‘মব জাস্টিস’ এর কথা বলছেন তারা পুরনো ইতিহাস মনে রাখবেন, প্লিজ। “বাম ও প্রগতিশীলরা নিজেদের ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ দাবি করে আইন বা সংবিধানের তোয়াক্কা করেনি। চিরকাল ‘মব জাস্টিস’ করে গিয়েছে। এখন তৌহিদী জনতা বর্গটির বিরুদ্ধে তাদের আক্রোশ চরম বিনোদনের জন্ম দিয়েছে।”