নিজস্ব প্রতিবেদক : সাক্ষ্য আইনের বিতর্কিত ধারা বাতিলের দাবিতে মধ্যরাতে রাজধানীতে পদযাত্রা করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অর্ধশতাধিক নারী।
ঢাকার বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ধর্ষণ মামলার রায়ে বিচারকের একটি বক্তব্য নিয়ে অধিকারকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার রাতে এই ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ থেকে মশাল হাতে পদযাত্রা শুরু করে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে গিয়ে তারা সমাবেশে মিলিত হন।
শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার বলেন, “গৃহ, কর্মস্থল, গণপরিবহনে নারীর জন্যে নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে ওই প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীরা। পুলিশ পদযাত্রায় সার্বিক নিরাপত্তা দিয়েছে।”
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলার রায়ে আসামিদের খালাস দেয় ঢাকার একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। বিচারক বলেন, “তারা উইলিংলি পার্টনার ছিল, তারা ধর্ষণের শিকার হয়নি।”
৭২ ঘণ্টার পর মেডিকেল পরীক্ষা করা হলে যে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না, সে কথা তুলে ধরে বিচারক পুলিশকে ওই সময়ের পরে কোনো মামলা না নিতে বলেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও মশাল তৈরির কাজ শুরু হয়।
পরে রাতে সাক্ষ্য আইনের বিতর্কিত ধারা বাতিলসহ অন্যান্য দাবিতে পদযাত্রা শুরু হয় শাহবাগ থেকে। সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকলি, অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।
গতবছর নভেম্বরে আন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সাজা বাড়িয়ে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন’ আইন সংশোধন করে সরকার। সেখানে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি বদলে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দ দুটি বসানো হয়। কিন্তু সাক্ষ্য আইন সংশোধন করা হয়নি।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১৫৫(৪) ধারায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে কথা বলার যে সুযোগ রাখা হয়েছে আইনজীবীদের জন্য। অর্থাৎ, আসামিপক্ষের আইনজীবী শুনানিতে এই যুক্তি দেখাতে পারেন যে, অভিযোগকারী সাধারণভাবে ‘দুশ্চরিত্রা’, ধর্ষণের শিকার নন। ওই ধারা সংশোধনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন অধিকারকর্মীরা। গত ৩০ জুন আইনমনন্ত্রী আনিসুল হকও আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে পরে তা আর এগোয়নি।
পদযাত্রায় সংহতি জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ বলেন, “কেবল নারীর নেতৃত্ব যেমন নারীর সার্বিক অবস্থায় কোনো উন্নতি করে না, তেমনি শুধুমাত্র নারী বিচারক হলেই সুচিন্তিত ও ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই।”
রায়ের পর্যবেক্ষণের নিন্দা জানিয়ে এর প্রতিবাদে ও সাক্ষ্য আইনের বিতর্কিত ধারা বাতিলের দাবিতে অন্যদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান এই অধিকার কর্মী। প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ৪ অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবিতে গণস্বাক্ষরও আদায় করা হয়।
‘ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেওয়ার সুপারিশ’, বিভিন্ন সংস্থার উদ্বেগ : বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে ‘৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেওয়ার জন্য আদালতের পরামর্শে’ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো পৃথক বিবৃতে এই উদ্বেগের কথা জানায় সংস্থা দুটি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিবৃতিতে জানায়, গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, ৭২ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হলে মামলা না নেওয়ার জন্য পুলিশ সুপারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মামলা দায়ের করার জন্য বিধিনিষেধ বিচারপ্রাপ্তির সুযোগকে সংকুচিত করবে, যা মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। তাছাড়া মেডিক্যাল রিপোর্টই ধর্ষণ মামলার একমাত্র অ্যাভিডেন্স না। আরও অনেকগুলো পারিপার্শ্বিক অ্যাভিডেন্স থাকে, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার বিচার এগিয়ে চলে। বিচারিক আদালত যদি এ ধরনের বিধিনিষেধ তৈরির মন্তব্য প্রদান করে, ভবিষ্যতে ধর্ষণের ঘটনায় ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। অপরদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে, বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় কোনও অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা গ্রহণের নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অপরাধ সংঘটনের অনেক বছর পরও মামলা ও বিচারকাজ সম্পাদিত হওয়ার নজির রয়েছে। যেখানে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার ওপর বারবার জোর দেওয়া হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে উচ্চ আদালত বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী নির্দেশনা প্রদান করেছেন, সেখানে এ মামলার ক্ষেত্রে আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা আমাদের হতাশ করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সাংঘর্ষিক।
মধ্যরাতে ‘শেকল ভাঙার’ পদযাত্রায় নারীরা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ