ঢাকা ০৫:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস, নি¤œবিত্তের নাভিশ্বাস

  • আপডেট সময় : ১১:০৬:১৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • ৯২ বার পড়া হয়েছে

রুমিন ফারহানা : কত মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে করোনায়? কত মানুষ নেমে গেলো দারিদ্র সীমার নিচে? কত মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে নি¤œ-মধ্যবিত্ত আর কতজনই বা নি¤œ-মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র হয়েছেন? কত মানুষ দরিদ্র থেকে হয়েছেন হতদরিদ্র? কত মানুষ হারিয়েছেন চাকরি? কত মানুষ পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন? কত মানুষের বেতন কমে গেছে? কতজন শহর থেকে চলে গেছেন গ্রামে? এই পরিসংখ্যানগুলো করার কথা ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস)। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম করোনার দুই বছর পার হলেও এই ধরনের কোনও তথ্য বিবিএসের কাছে নেই। অথচ গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক পিপিআরসির যৌথ গবেষণা বলছে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে যুক্ত হয়েছে দরিদ্রের কাতারে আর সানেম বলছে করোনার অভিঘাতে ৪২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে মানুষের অর্থনৈতিক শ্রেণি কাঠামোয়। এগুলো সবই ২০২০ এবং ২১ সালের প্রথম দিকের পরিসংখ্যান। এরপর মানুষের অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার বলছেন বেসরকারি কোনও জরিপ মানতে তিনি প্রস্তুত নন। বেসরকারি জরিপ না মানলে যে সরকারি জরিপ তৈরির বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে অবশ্য মন্ত্রী নীরব।

সরকারি বা বেসরকারি কোনও জরিপ থাক বা না থাক এ কথা সত্য যে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের বেতন কমে গেছে, অনেকে মধ্যবিত্ত থেকে নি¤œ-মধ্যবিত্ত এমনকি নি¤œবিত্তে নেমে গেছেন। অথচ সরকারি দাবি মতে ইতিমধ্যেই মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬০০ ডলার। ৮৭ টাকা ডলার ধরলে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২৫ হাজার টাকার মতো। এর মানে ৪ সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক আয় ৭৫ হাজার টাকা আর ৫ সদস্য হলে সেটি প্রায় ৯৪ হাজার টাকা। এই টাকা হাতে আসুক বা নাই আসুক খাতা-কলম আর সরকারি পরিসংখ্যানে এই অংক পরিষ্কার। সে কারণেই বোধ করি মন্ত্রী বলেছেন রাত পোহালেই আয় বাড়ছে, আমরা নিজের অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি। হীরক রাজার দেশে মজা মন্দ নয়।

বাংলাদেশের ডাটা নিয়ে চরম ম্যানিপুলেশন আছে, কিন্তু আমরা এটাতো জানি না কয় শতাংশ পরিবার এই গড় আয়টি করে। বিবিএস এমন কোনও গবেষণা/জরিপ কোনোদিন করেছে বলে জানা নেই। তবে যেহেতু এই সমাজেই আমাদের বাস, আমরা যদি আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী এবং পরিচিতজনদের মধ্যে বিবেচনা করি তাহলেই একটা ধারণা পাবো কতগুলো পরিবার ওই গড় আয়টি করতে পারে। মাথাপিছু আয় নিয়ে সরকারি তথ্য যদি সঠিক হয় তার মানে হচ্ছে হাতে গোনা কিছু পরিবারের অকল্পনীয় পরিমাণ আয়ের ফলেই হয়েছে এই গড় আয়। সাধারণ নাগরিকদের অবস্থা রয়ে গেছে একই।

অকল্পনীয় পরিমাণ আয় যে শ্রেণির হাতে গেছে তারা সকলেই কোনও না কোনোভাবে সরকার কিংবা সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন আগেই তথাকথিত শুদ্ধি অভিযান আমাদের দেখিয়েছে সরকারি দলের একেবারে সাধারণ কর্মীর ঘর থেকেও এখন হাজার কোটি টাকার কাগজ মেলে। শুদ্ধি অভিযান সরকারের উঁচুতলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি কিন্তু যতটুকু গেছে তাতেই এই সরকার আর তার ক্রনিদের বীভৎস লুটপাট পরিষ্কার।

গত বেশ কিছুদিন যাবত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। চাল থেকে শুরু করে সাবান, সব্জি থেকে শুরু করে দাঁত মাজার পেস্ট, দাম বেড়েছে সবকিছুর। বাড়ি ভাড়া, পরিবহণ খরচ, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় সব কিছুই ঊর্ধ্বমুখী, বাড়ছে না কেবল আয়। টিসিবির লম্বা লাইন স্পষ্ট বার্তা দেয় ভালো নেই মানুষ। কেবল নি¤œবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত মানুষও বাধ্য হচ্ছে টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে। এমনকি বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যন্ত স্বীকার করেছেন ভালো পোশাক পরা মানুষজনও আছেন টিসিবির লাইনে।

তেল, পেয়াজ, ডাল, চিনি পাওয়া যাচ্ছে টিসিবির ট্রাকে। বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্ট বলছে ২ লিটার তেল, ২ কেজি ডাল, ২ কেজি চিনি আর ৫ কেজি পেঁয়াজ এর প্যাকেজ কিনতে পারলে বাঁচানো যায় প্রায় আড়াই শ’ টাকা। এই আড়াই শ টাকা বাঁচানোর জন্য টিসিবির লাইনে মানুষ দাঁড়াচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক দিন লাইনে দাঁড়ালেই যে পণ্য পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তাও নেই। পণ্য কম, তুলনামূলকভাবে মানুষ অনেক বেশি। তাই মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় পণ্য। ব্যয়ের সব খাতে এই চাপ এমন একটা সময়ে পড়েছে, যখন করোনার কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত। যদিও সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের কথা শুনলে মনে হয় বাস্তব পরিস্থিতির ব্যাপারে হয় তাঁদের ন্যূনতম ধারণা নেই, না হয় তারা অস্বীকারের সংস্কৃতির (ডিনায়াল সিন্ড্রোম) মধ্যে আছে।

শুধু যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে তাই নয়, দাম বেড়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো পরিষেবারও। বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন দুই চুলার গ্যাসের জন্য দাম দিতে হতো ৪০০ টাকা, পাঁচ দফায় দাম বাড়ানোর পর এখন দিতে হচ্ছে ৯৭৫ টাকা। দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ২১০০ টাকা। একইভাবে, এ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় বিদ্যুতের দাম দিতে হতো প্রতি ইউনিটে ৩.৭৫ টাকা। ১০ বার দাম বাড়িয়ে এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.১৩ টাকা। একটি মাঝারি পরিবারে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে মাসে বিদ্যুতের জন্য খরচ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ টাকা। এখন বলা হচ্ছে এর দাম আরও বাড়বে। একই অবস্থা পানির দামেও। ২০০৮ সালে প্রতি ইউনিট পানির দাম ছিল ৫.৭৫ টাকা। ১৪ বার দাম বাড়ানোর পর এখন তা ১৫.১৮ টাকা। একটি পরিবারে মাসে ১৮০০ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে পানির বিল দিতে। পানির সঙ্গে সমপরিমাণ বাড়ে স্যুয়ারেজ বিল। এবার আবারও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে ৪০ শতাংশ। দামের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস আর নি¤œবিত্তের নাভিশ্বাস।

ইতিমধ্যেই বাণিজ্য মন্ত্রী জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির জন্যই জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তার মতে ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন কৃষিমন্ত্রী। তার মতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সারে ব্যাপকভাবে ভর্তুকি বাড়াতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বছর সার সরবরাহ করতে ভর্তুকি বাবদ ২৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। অন্যান্য বছর এ খাতে সরকারের ৮-৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। এত ভর্তুকি দিলে অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকা- স্থবির হয়ে যাবে। বছরে ভর্তুকির ২৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে আরেকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। পানির দাম বাড়ানোর প্রসঙ্গে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন ওয়াসার এমডি।

মুশকিল হলো এই ধরনের সরকারের কাছে উন্নয়ন মানেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন; ব্রিজ, ফ্লাই ওভার, মেট্রোরেল নির্মাণ। এতে লাভ হয় দুই ধরনের। এক মানুষকে দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখানো যায় আর দুই অবকাঠামো নির্মাণের নামে লুটপাটের মহোৎসব চালানো যায়। কিন্তু কিছুটা ভর্তুকি দিয়ে সাধারণ মানুষকে একটু ভালো রাখার চেষ্টা এই ধরনের সরকারের চরিত্র বিরোধী।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

এই রক্তস্রোত যেন বৃথা না যায়, ঐক্য বজায় রাখতে হবে: খালেদা জিয়া

মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস, নি¤œবিত্তের নাভিশ্বাস

আপডেট সময় : ১১:০৬:১৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২২

রুমিন ফারহানা : কত মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে করোনায়? কত মানুষ নেমে গেলো দারিদ্র সীমার নিচে? কত মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে নি¤œ-মধ্যবিত্ত আর কতজনই বা নি¤œ-মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র হয়েছেন? কত মানুষ দরিদ্র থেকে হয়েছেন হতদরিদ্র? কত মানুষ হারিয়েছেন চাকরি? কত মানুষ পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন? কত মানুষের বেতন কমে গেছে? কতজন শহর থেকে চলে গেছেন গ্রামে? এই পরিসংখ্যানগুলো করার কথা ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস)। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম করোনার দুই বছর পার হলেও এই ধরনের কোনও তথ্য বিবিএসের কাছে নেই। অথচ গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক পিপিআরসির যৌথ গবেষণা বলছে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে যুক্ত হয়েছে দরিদ্রের কাতারে আর সানেম বলছে করোনার অভিঘাতে ৪২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে মানুষের অর্থনৈতিক শ্রেণি কাঠামোয়। এগুলো সবই ২০২০ এবং ২১ সালের প্রথম দিকের পরিসংখ্যান। এরপর মানুষের অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার বলছেন বেসরকারি কোনও জরিপ মানতে তিনি প্রস্তুত নন। বেসরকারি জরিপ না মানলে যে সরকারি জরিপ তৈরির বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে অবশ্য মন্ত্রী নীরব।

সরকারি বা বেসরকারি কোনও জরিপ থাক বা না থাক এ কথা সত্য যে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের বেতন কমে গেছে, অনেকে মধ্যবিত্ত থেকে নি¤œ-মধ্যবিত্ত এমনকি নি¤œবিত্তে নেমে গেছেন। অথচ সরকারি দাবি মতে ইতিমধ্যেই মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬০০ ডলার। ৮৭ টাকা ডলার ধরলে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২৫ হাজার টাকার মতো। এর মানে ৪ সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক আয় ৭৫ হাজার টাকা আর ৫ সদস্য হলে সেটি প্রায় ৯৪ হাজার টাকা। এই টাকা হাতে আসুক বা নাই আসুক খাতা-কলম আর সরকারি পরিসংখ্যানে এই অংক পরিষ্কার। সে কারণেই বোধ করি মন্ত্রী বলেছেন রাত পোহালেই আয় বাড়ছে, আমরা নিজের অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি। হীরক রাজার দেশে মজা মন্দ নয়।

বাংলাদেশের ডাটা নিয়ে চরম ম্যানিপুলেশন আছে, কিন্তু আমরা এটাতো জানি না কয় শতাংশ পরিবার এই গড় আয়টি করে। বিবিএস এমন কোনও গবেষণা/জরিপ কোনোদিন করেছে বলে জানা নেই। তবে যেহেতু এই সমাজেই আমাদের বাস, আমরা যদি আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী এবং পরিচিতজনদের মধ্যে বিবেচনা করি তাহলেই একটা ধারণা পাবো কতগুলো পরিবার ওই গড় আয়টি করতে পারে। মাথাপিছু আয় নিয়ে সরকারি তথ্য যদি সঠিক হয় তার মানে হচ্ছে হাতে গোনা কিছু পরিবারের অকল্পনীয় পরিমাণ আয়ের ফলেই হয়েছে এই গড় আয়। সাধারণ নাগরিকদের অবস্থা রয়ে গেছে একই।

অকল্পনীয় পরিমাণ আয় যে শ্রেণির হাতে গেছে তারা সকলেই কোনও না কোনোভাবে সরকার কিংবা সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন আগেই তথাকথিত শুদ্ধি অভিযান আমাদের দেখিয়েছে সরকারি দলের একেবারে সাধারণ কর্মীর ঘর থেকেও এখন হাজার কোটি টাকার কাগজ মেলে। শুদ্ধি অভিযান সরকারের উঁচুতলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি কিন্তু যতটুকু গেছে তাতেই এই সরকার আর তার ক্রনিদের বীভৎস লুটপাট পরিষ্কার।

গত বেশ কিছুদিন যাবত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। চাল থেকে শুরু করে সাবান, সব্জি থেকে শুরু করে দাঁত মাজার পেস্ট, দাম বেড়েছে সবকিছুর। বাড়ি ভাড়া, পরিবহণ খরচ, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় সব কিছুই ঊর্ধ্বমুখী, বাড়ছে না কেবল আয়। টিসিবির লম্বা লাইন স্পষ্ট বার্তা দেয় ভালো নেই মানুষ। কেবল নি¤œবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত মানুষও বাধ্য হচ্ছে টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে। এমনকি বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যন্ত স্বীকার করেছেন ভালো পোশাক পরা মানুষজনও আছেন টিসিবির লাইনে।

তেল, পেয়াজ, ডাল, চিনি পাওয়া যাচ্ছে টিসিবির ট্রাকে। বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্ট বলছে ২ লিটার তেল, ২ কেজি ডাল, ২ কেজি চিনি আর ৫ কেজি পেঁয়াজ এর প্যাকেজ কিনতে পারলে বাঁচানো যায় প্রায় আড়াই শ’ টাকা। এই আড়াই শ টাকা বাঁচানোর জন্য টিসিবির লাইনে মানুষ দাঁড়াচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক দিন লাইনে দাঁড়ালেই যে পণ্য পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তাও নেই। পণ্য কম, তুলনামূলকভাবে মানুষ অনেক বেশি। তাই মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় পণ্য। ব্যয়ের সব খাতে এই চাপ এমন একটা সময়ে পড়েছে, যখন করোনার কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত। যদিও সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের কথা শুনলে মনে হয় বাস্তব পরিস্থিতির ব্যাপারে হয় তাঁদের ন্যূনতম ধারণা নেই, না হয় তারা অস্বীকারের সংস্কৃতির (ডিনায়াল সিন্ড্রোম) মধ্যে আছে।

শুধু যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে তাই নয়, দাম বেড়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো পরিষেবারও। বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন দুই চুলার গ্যাসের জন্য দাম দিতে হতো ৪০০ টাকা, পাঁচ দফায় দাম বাড়ানোর পর এখন দিতে হচ্ছে ৯৭৫ টাকা। দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ২১০০ টাকা। একইভাবে, এ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় বিদ্যুতের দাম দিতে হতো প্রতি ইউনিটে ৩.৭৫ টাকা। ১০ বার দাম বাড়িয়ে এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.১৩ টাকা। একটি মাঝারি পরিবারে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে মাসে বিদ্যুতের জন্য খরচ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ টাকা। এখন বলা হচ্ছে এর দাম আরও বাড়বে। একই অবস্থা পানির দামেও। ২০০৮ সালে প্রতি ইউনিট পানির দাম ছিল ৫.৭৫ টাকা। ১৪ বার দাম বাড়ানোর পর এখন তা ১৫.১৮ টাকা। একটি পরিবারে মাসে ১৮০০ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে পানির বিল দিতে। পানির সঙ্গে সমপরিমাণ বাড়ে স্যুয়ারেজ বিল। এবার আবারও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে ৪০ শতাংশ। দামের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস আর নি¤œবিত্তের নাভিশ্বাস।

ইতিমধ্যেই বাণিজ্য মন্ত্রী জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির জন্যই জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তার মতে ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন কৃষিমন্ত্রী। তার মতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সারে ব্যাপকভাবে ভর্তুকি বাড়াতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বছর সার সরবরাহ করতে ভর্তুকি বাবদ ২৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। অন্যান্য বছর এ খাতে সরকারের ৮-৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। এত ভর্তুকি দিলে অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকা- স্থবির হয়ে যাবে। বছরে ভর্তুকির ২৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে আরেকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। পানির দাম বাড়ানোর প্রসঙ্গে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন ওয়াসার এমডি।

মুশকিল হলো এই ধরনের সরকারের কাছে উন্নয়ন মানেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন; ব্রিজ, ফ্লাই ওভার, মেট্রোরেল নির্মাণ। এতে লাভ হয় দুই ধরনের। এক মানুষকে দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখানো যায় আর দুই অবকাঠামো নির্মাণের নামে লুটপাটের মহোৎসব চালানো যায়। কিন্তু কিছুটা ভর্তুকি দিয়ে সাধারণ মানুষকে একটু ভালো রাখার চেষ্টা এই ধরনের সরকারের চরিত্র বিরোধী।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।