ঢাকা ০৭:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫

ভয় নেই, বেপরোয়া মানুষ

  • আপডেট সময় : ০২:১২:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মে ২০২১
  • ৯১ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : গত বছর ঈদুল ফিতরের সময় গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ঈদের অজুহাতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়। এরপরই বাড়ি ফিরতে মরিয়া হয়ে ওঠে সবাই। আর এবছর ঈদযাত্রা যেন ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে দেশে, আরেকদিকে বেপরোয়া মানুষ। নির্দেশনা, কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েও ঘরে রাখা যাচ্ছে লোকজনকে। বৃহস্পতিবার থেকে মানুষ ছুটছে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে।
ঈদে ঘুরমুখো যাত্রীরা ঘাটে দুর্ভোগে পড়েছেন। হঠাৎ ফেরি বন্ধের ঘোষণায় ঘাট এলাকায় ছোট গাড়ির লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন আটকে থাকা গাড়ির চালক ও সাধারণ যাত্রীরা। এরমধ্যে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি যান পারাপারে একটি ফেরি পাটুরিয়া ঘাটে ভেড়াতে গেলে যাত্রীরা দৌঁড়ে সেখানে ওঠার চেষ্টা করেন। ঘাট পারাপারে মরিয়া হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা। ঈদের ঘুরমুখো যাত্রীদের মানবিকতার কথা বিবেচনা করে সব রুটে ফেরি চলাচলের অনুমতি দিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। দু’দিন বন্ধ রাখার পর গতকাল সোমবার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, মাওয়া ঘাটে ফেরি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ঘাটে ঈদে ঘুরমুখো যাত্রীরা অনেক দুর্ভোগে পড়েছেন। এসব মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করেই ফেরি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মূলত মানবিক বিষয় চিন্তা করেই ফেরি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেসব মানুষ ঘাটে পৌঁছে গেছেন তারা যাবেন কোথায়? ঈদ পর্যন্ত ফেরি চলাচল করবে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ঈদ পর্যন্ত সব রুটেই ফেরি চলবে প্রাথমিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তী কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে করোনা সংক্রমণ কমাতে চলমান কঠোর বিধিনিষেধে দূরপাল্লার পরিবহন না চালানো ও দিনের বেলায় ফেরি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত থাকলেও ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের স্রোত আটকানো যাচ্ছে না। গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে ভোগান্তি টেনে ও অতিরিক্ত ভাড়া গুণে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে ছুটছে মানুষ।
গতকাল সোমবার রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল, শ্যামলী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, হাতে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে মানুষ। সিএনজি, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে যে যেভাবে পারছেন ঢাকা ছাড়ছেন। আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকলেও গাবতলী পুলিশ বক্সের আগে কয়েকটি বাসকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত যাত্রী নিতে দেখা যায়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে পরিবহন চালানো কিংবা জেলার বাইরে না যাওয়ার নিয়মকে তোয়াক্কা না করে এসব গাড়ি চলছে।
ডি লিংক, ঠিকানা পরিবহনের দুটো বাস যাত্রীপ্রতি ৩০০ টাকা করে ভাড়া নিয়ে গাবতলী থেকে পাটুরিয়া যাচ্ছে জানিয়ে ঠিকানা বাসের এক হেলপার বলেন, ‘এখন ফেরি বন্ধ; তবে রাতের দিকে ফেরি খুলে দেয়। আমিনবাজার থেকে উত্তরবঙ্গগামী বাসও ছাড়ে রাতে। এ কারণে যাত্রীদের ভিড় আছে।’
এদিকে সিএনজি, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ছোট ও হালকা যানবাহনে সাভার, বাইপাইল ও পাটুরিয়া যাচ্ছেন যাত্রীরা। এক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের। বেশিরভাগ মানুষই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। উপেক্ষিত হচ্ছে সামাজিক দূরত্বও।
ব্যবসায়ী নাজমুল হাসান ব্যাগ গুছিয়ে ছুটছেন আমিনবাজারের উদ্দেশ্যে। তার গন্তব্য যশোর। গাড়ি আমিনবাজার থেকে ছাড়বে শুনে তিনি গাবতলী থেকে ৫০ টাকায় ভ্যান ভাড়া করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমিনবাজার থেকে একটা ব্যবস্থা করবো, বাস যদি না পাই তাহলে আবার ফিরে আসবো।’ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত ভোগান্তি নিয়ে তারা গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে চান। মানসুর ও আবেদিন ঢাকার একটি পলিটেকনিক কলেজে পড়েন। লকডাউন, তীব্র রোদ উপেক্ষা করে দুই বন্ধু যাত্রা শুরু করেছেন। তাদের গন্তব্য পাবনার আরামবাড়িয়া।
রাজধানীর তেজগাঁও থেকে গাবতলীর যাত্রা সুখের হলেও এরপর শুরু অনিশ্চিত যাত্রা আর পদে পদে ভোগান্তি। আবেদিন বলেন, ঢাকার মেসে ঈদ কীভাবে করবো? ঈদ তো বছরে দুবার আসে। কষ্ট হলেও বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করবো।’
গোপনে চলছ দূরপাল্লার বাস : সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রশাসন ম্যানেজ করে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালক বলেন, ‘বাস রাতে ছাড়ে। আমিনবাজার, সাভারসহ বিভিন্ন জায়গা থেকেই বাস জেলার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আবার যাত্রীরা আরিচা, পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত কষ্ট করে যায়। ফেরি পার হলে অন্য জেলার বাস পাওয়া যায়।’
যাত্রীরা বলছেন, ভেঙে ভেঙে যেতে তাদের বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। পাবনার যাত্রী মানসুর বলেন, ‘এক জায়গায় কথা হয়েছে। বলছে রাতে গাড়ি ছাড়বে আমিনবাজার থেকে। ভাড়া ২ হাজার টাকা বলছে। ভাবছি ভেঙে ভেঙে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড়ে যাব। মোটরসাইকেলে ব্রিজ পাড় হয়ে ওপার থেকে আবার গাড়ি, অটোরিকশা যা পাই তা দিয়ে বাড়ি চলে যাব। সেতু পাড় করে দিতে মোটরসাইকেলে ৪০০ টাকা দিতে হবে শুনেছি। এভাবে দেখা যাচ্ছে বাড়ি যেতে এ হাজার থেকে পনেরশ টাকা খরচ হবে।’ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলগামী যাত্রীরা ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে রাজবাড়ীর বাসে ফরিদপুরের সীমানা সাইনবোর্ড পর্যন্ত, ফরিদপুর থেকে কামারখালী ব্রিজ পর্যন্ত, মাগুরার বাসে সীমাখালী হয়ে যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। জানতে চাইলে কর্মরত বিআরটিএ’র ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা বলবত রাখতে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন গাড়ি জরিমানা করেছি। কিন্তু জনসাধারণের সহযোগিতা পাচ্ছি না। এ সময় যদি সবাই সহযোগিতা না করে তাহলে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’ গাবতলী এলাকায় কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য প্রিয়াংকর রায় বলেন, ‘পিকআপ ভ্যান, গাড়িতে করে অনেকেই ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করছেন। আমরা তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, তারপরও অনেকেই আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন।’
ফেরিঘাটে প্রচ- ভিড়ে দলছুট হয়ে বিপাকে : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ গতকাল সোমবারও রাজধানী ছেড়ে গ্রামে ছুটেছেন। ফেরিঘাটে ভিড় এড়াতে শেষরাতে সাহ্রি খেয়ে অনেক রওনা হয়েছেন গ্রামের বাড়ির পথে। ঘাটে এসে ফেরিতে উঠতে গিয়ে প্রচ- ভিড়ের কারণে অনেকে সফরসঙ্গী হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সকালে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে এমন চিত্র চোখে পড়ে।
এদিকে ঢাকামুখী বেশ কিছু গাড়ি ফেরির জন্য দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। বেনাপোল থেকে লোহার কুচি বোঝাই করে কাভার্ড ভ্যান নিয়ে রওনা হয়েছেন বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম যেতে হবে। খুব সকালে ঘাটে এসে পৌঁছালে টিকিট না দেওয়ায় ঘাটের লম্বা লাইনে আটকে আছেন। দিনের বেলায় সাধারণ পণ্যবাহী গাড়ির টিকিট দিচ্ছে না বলে প্রায় ২০০ গাড়ি পারাপারের অপেক্ষায় আটকে আছে।
শিমুলিয়ায় জনস্রোত, ৬ ট্রলার আটক : শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে জনস্রোত ঠেকানোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলাচল করায় ছয়টি ট্রলার মাঝিসহ আটক করেছে পুলিশ। মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক সিরাজুল কবির জানান, সোমবার সকালে পদ্মা পার হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের আটক করা হয়। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটের আশপাশ থেকে পদ্মা পার হয়ে মাদারীপুরের বাংলাবাজার, কাঁঠালবাড়ি ও শরীয়তপুরের মাঝিকান্দি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন যাত্রীরা। ট্রলারে নারী ও শিশু-কিশোর ছিল বেশি। যাত্রীদের ফেরত পাঠিয়ে মাঝি ও ট্রলার আটক রাখা হয়েছে। তবে রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ১৫টি ফেরি চলাচল করেছে ওই নৌপথে। রাত ৩টা পর্যন্ত ছিল ঘাটে জনস্রোত। জনস্রোত ঠেকাতে দিনের বেলায় ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হযেছে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম মো. সফিকুল ইসলাম।
করোনাকালে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরতে নানাভাবে অনুৎসাহিত করা হলেও গত তিন দিন ধরে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার শিমুলিয়ায় ভিড় করছেন হাজার হাজার যাত্রী। দিনে ফেরি বন্ধ রেখে, রাতে পণ্যবাহী যান পারের নির্দেশনা থাকার পরেও মানুষের ভিড় বাড়ছেই। বিভিন্ন জরুরি পরিবহন পারাপারের জন্য থাকা ফেরিতে করে পারাপারও হচ্ছেন তারা।
চট্টগ্রাম থেকে নানা কৌশলে শহর ছাড়ছে মানুষ : ঈদকে সামনে রেখে লকডাউনের মধ্যেও দুরপাল্লার বাস, মাইক্রোসহ নানা কৌশলে চট্টগ্রাম নগরী ছেড়ে ভিন্ন জেলায় স্বজনদের কাছে চলে যাচ্ছে মানুষ। সরকারি নিষেধাজ্ঞায় দুরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও কখনো কখনো পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে অথবা কখনো পুলিশকে ম্যানেজ করে বাস চলাচল করছে। তবে এর মধ্যে রোববার (৯ মে) রাতে চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ১৮টি বাস আটক করেছে হাইওয়ে পুলিশ।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ছিনতাইয়ের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বাসায় আসামির ছেলে

ভয় নেই, বেপরোয়া মানুষ

আপডেট সময় : ০২:১২:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মে ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক : গত বছর ঈদুল ফিতরের সময় গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ঈদের অজুহাতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়। এরপরই বাড়ি ফিরতে মরিয়া হয়ে ওঠে সবাই। আর এবছর ঈদযাত্রা যেন ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে দেশে, আরেকদিকে বেপরোয়া মানুষ। নির্দেশনা, কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েও ঘরে রাখা যাচ্ছে লোকজনকে। বৃহস্পতিবার থেকে মানুষ ছুটছে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে।
ঈদে ঘুরমুখো যাত্রীরা ঘাটে দুর্ভোগে পড়েছেন। হঠাৎ ফেরি বন্ধের ঘোষণায় ঘাট এলাকায় ছোট গাড়ির লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন আটকে থাকা গাড়ির চালক ও সাধারণ যাত্রীরা। এরমধ্যে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি যান পারাপারে একটি ফেরি পাটুরিয়া ঘাটে ভেড়াতে গেলে যাত্রীরা দৌঁড়ে সেখানে ওঠার চেষ্টা করেন। ঘাট পারাপারে মরিয়া হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা। ঈদের ঘুরমুখো যাত্রীদের মানবিকতার কথা বিবেচনা করে সব রুটে ফেরি চলাচলের অনুমতি দিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। দু’দিন বন্ধ রাখার পর গতকাল সোমবার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, মাওয়া ঘাটে ফেরি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ঘাটে ঈদে ঘুরমুখো যাত্রীরা অনেক দুর্ভোগে পড়েছেন। এসব মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করেই ফেরি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মূলত মানবিক বিষয় চিন্তা করেই ফেরি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেসব মানুষ ঘাটে পৌঁছে গেছেন তারা যাবেন কোথায়? ঈদ পর্যন্ত ফেরি চলাচল করবে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ঈদ পর্যন্ত সব রুটেই ফেরি চলবে প্রাথমিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তী কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে করোনা সংক্রমণ কমাতে চলমান কঠোর বিধিনিষেধে দূরপাল্লার পরিবহন না চালানো ও দিনের বেলায় ফেরি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত থাকলেও ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের স্রোত আটকানো যাচ্ছে না। গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে ভোগান্তি টেনে ও অতিরিক্ত ভাড়া গুণে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে ছুটছে মানুষ।
গতকাল সোমবার রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল, শ্যামলী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, হাতে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে মানুষ। সিএনজি, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে যে যেভাবে পারছেন ঢাকা ছাড়ছেন। আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকলেও গাবতলী পুলিশ বক্সের আগে কয়েকটি বাসকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত যাত্রী নিতে দেখা যায়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে পরিবহন চালানো কিংবা জেলার বাইরে না যাওয়ার নিয়মকে তোয়াক্কা না করে এসব গাড়ি চলছে।
ডি লিংক, ঠিকানা পরিবহনের দুটো বাস যাত্রীপ্রতি ৩০০ টাকা করে ভাড়া নিয়ে গাবতলী থেকে পাটুরিয়া যাচ্ছে জানিয়ে ঠিকানা বাসের এক হেলপার বলেন, ‘এখন ফেরি বন্ধ; তবে রাতের দিকে ফেরি খুলে দেয়। আমিনবাজার থেকে উত্তরবঙ্গগামী বাসও ছাড়ে রাতে। এ কারণে যাত্রীদের ভিড় আছে।’
এদিকে সিএনজি, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ছোট ও হালকা যানবাহনে সাভার, বাইপাইল ও পাটুরিয়া যাচ্ছেন যাত্রীরা। এক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের। বেশিরভাগ মানুষই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। উপেক্ষিত হচ্ছে সামাজিক দূরত্বও।
ব্যবসায়ী নাজমুল হাসান ব্যাগ গুছিয়ে ছুটছেন আমিনবাজারের উদ্দেশ্যে। তার গন্তব্য যশোর। গাড়ি আমিনবাজার থেকে ছাড়বে শুনে তিনি গাবতলী থেকে ৫০ টাকায় ভ্যান ভাড়া করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমিনবাজার থেকে একটা ব্যবস্থা করবো, বাস যদি না পাই তাহলে আবার ফিরে আসবো।’ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত ভোগান্তি নিয়ে তারা গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে চান। মানসুর ও আবেদিন ঢাকার একটি পলিটেকনিক কলেজে পড়েন। লকডাউন, তীব্র রোদ উপেক্ষা করে দুই বন্ধু যাত্রা শুরু করেছেন। তাদের গন্তব্য পাবনার আরামবাড়িয়া।
রাজধানীর তেজগাঁও থেকে গাবতলীর যাত্রা সুখের হলেও এরপর শুরু অনিশ্চিত যাত্রা আর পদে পদে ভোগান্তি। আবেদিন বলেন, ঢাকার মেসে ঈদ কীভাবে করবো? ঈদ তো বছরে দুবার আসে। কষ্ট হলেও বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করবো।’
গোপনে চলছ দূরপাল্লার বাস : সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রশাসন ম্যানেজ করে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালক বলেন, ‘বাস রাতে ছাড়ে। আমিনবাজার, সাভারসহ বিভিন্ন জায়গা থেকেই বাস জেলার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আবার যাত্রীরা আরিচা, পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত কষ্ট করে যায়। ফেরি পার হলে অন্য জেলার বাস পাওয়া যায়।’
যাত্রীরা বলছেন, ভেঙে ভেঙে যেতে তাদের বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। পাবনার যাত্রী মানসুর বলেন, ‘এক জায়গায় কথা হয়েছে। বলছে রাতে গাড়ি ছাড়বে আমিনবাজার থেকে। ভাড়া ২ হাজার টাকা বলছে। ভাবছি ভেঙে ভেঙে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড়ে যাব। মোটরসাইকেলে ব্রিজ পাড় হয়ে ওপার থেকে আবার গাড়ি, অটোরিকশা যা পাই তা দিয়ে বাড়ি চলে যাব। সেতু পাড় করে দিতে মোটরসাইকেলে ৪০০ টাকা দিতে হবে শুনেছি। এভাবে দেখা যাচ্ছে বাড়ি যেতে এ হাজার থেকে পনেরশ টাকা খরচ হবে।’ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলগামী যাত্রীরা ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে রাজবাড়ীর বাসে ফরিদপুরের সীমানা সাইনবোর্ড পর্যন্ত, ফরিদপুর থেকে কামারখালী ব্রিজ পর্যন্ত, মাগুরার বাসে সীমাখালী হয়ে যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। জানতে চাইলে কর্মরত বিআরটিএ’র ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা বলবত রাখতে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন গাড়ি জরিমানা করেছি। কিন্তু জনসাধারণের সহযোগিতা পাচ্ছি না। এ সময় যদি সবাই সহযোগিতা না করে তাহলে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’ গাবতলী এলাকায় কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য প্রিয়াংকর রায় বলেন, ‘পিকআপ ভ্যান, গাড়িতে করে অনেকেই ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করছেন। আমরা তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, তারপরও অনেকেই আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন।’
ফেরিঘাটে প্রচ- ভিড়ে দলছুট হয়ে বিপাকে : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ গতকাল সোমবারও রাজধানী ছেড়ে গ্রামে ছুটেছেন। ফেরিঘাটে ভিড় এড়াতে শেষরাতে সাহ্রি খেয়ে অনেক রওনা হয়েছেন গ্রামের বাড়ির পথে। ঘাটে এসে ফেরিতে উঠতে গিয়ে প্রচ- ভিড়ের কারণে অনেকে সফরসঙ্গী হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সকালে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে এমন চিত্র চোখে পড়ে।
এদিকে ঢাকামুখী বেশ কিছু গাড়ি ফেরির জন্য দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। বেনাপোল থেকে লোহার কুচি বোঝাই করে কাভার্ড ভ্যান নিয়ে রওনা হয়েছেন বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম যেতে হবে। খুব সকালে ঘাটে এসে পৌঁছালে টিকিট না দেওয়ায় ঘাটের লম্বা লাইনে আটকে আছেন। দিনের বেলায় সাধারণ পণ্যবাহী গাড়ির টিকিট দিচ্ছে না বলে প্রায় ২০০ গাড়ি পারাপারের অপেক্ষায় আটকে আছে।
শিমুলিয়ায় জনস্রোত, ৬ ট্রলার আটক : শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে জনস্রোত ঠেকানোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলাচল করায় ছয়টি ট্রলার মাঝিসহ আটক করেছে পুলিশ। মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক সিরাজুল কবির জানান, সোমবার সকালে পদ্মা পার হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের আটক করা হয়। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটের আশপাশ থেকে পদ্মা পার হয়ে মাদারীপুরের বাংলাবাজার, কাঁঠালবাড়ি ও শরীয়তপুরের মাঝিকান্দি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন যাত্রীরা। ট্রলারে নারী ও শিশু-কিশোর ছিল বেশি। যাত্রীদের ফেরত পাঠিয়ে মাঝি ও ট্রলার আটক রাখা হয়েছে। তবে রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ১৫টি ফেরি চলাচল করেছে ওই নৌপথে। রাত ৩টা পর্যন্ত ছিল ঘাটে জনস্রোত। জনস্রোত ঠেকাতে দিনের বেলায় ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হযেছে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম মো. সফিকুল ইসলাম।
করোনাকালে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরতে নানাভাবে অনুৎসাহিত করা হলেও গত তিন দিন ধরে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার শিমুলিয়ায় ভিড় করছেন হাজার হাজার যাত্রী। দিনে ফেরি বন্ধ রেখে, রাতে পণ্যবাহী যান পারের নির্দেশনা থাকার পরেও মানুষের ভিড় বাড়ছেই। বিভিন্ন জরুরি পরিবহন পারাপারের জন্য থাকা ফেরিতে করে পারাপারও হচ্ছেন তারা।
চট্টগ্রাম থেকে নানা কৌশলে শহর ছাড়ছে মানুষ : ঈদকে সামনে রেখে লকডাউনের মধ্যেও দুরপাল্লার বাস, মাইক্রোসহ নানা কৌশলে চট্টগ্রাম নগরী ছেড়ে ভিন্ন জেলায় স্বজনদের কাছে চলে যাচ্ছে মানুষ। সরকারি নিষেধাজ্ঞায় দুরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও কখনো কখনো পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে অথবা কখনো পুলিশকে ম্যানেজ করে বাস চলাচল করছে। তবে এর মধ্যে রোববার (৯ মে) রাতে চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ১৮টি বাস আটক করেছে হাইওয়ে পুলিশ।