ঢাকা ১১:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫

ভয়াবহ বন্যার কবলে দেশ

  • আপডেট সময় : ০১:৪৭:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জুন ২০২২
  • ১৪২ বার পড়া হয়েছে

দেশের খবর ডেস্ক : সিলেট থেকে শুরু হলেও বন্যা এখন দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। এরকম বন্যা আগে কখনও দেখা যায়নি বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে- এই বন্যার ফলে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্যায় সিলেটের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া হবিগঞ্জ, নীলফামারি, কুড়িগ্রামেও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। জানাচ্ছেন প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারাঃ
সিলেটে ভয়াবহ বিপর্যয়
সিলেটবাসীদের অভিজ্ঞতায় এরকম বন্যা আগে কখনও দেখা যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে- এই বন্যার ফলে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্যায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সিলেট নগরীর বিশ্বরোডেও পানি। সোবাহানীঘাট-চালিবন্দর এ বিশ্বরোডে এর আগে পানি ওঠেনি। প্রশাসন বলছে সিলেটে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদিকে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের মধ্যে পানি ঢুকে পড়ায় সিলেট-সুনামগঞ্জের গোটা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিলেটের স্থানীয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ছোট যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। রিকশা ও বড় যান পানি ডিঙিয়ে চলছে। শুধু বিশ্বরোডে নয়, নগরীর সুবিদবাজার রোডসহ একাধিক মূল সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া নগরীর চারদিকে থৈ থৈ পানি। রাস্তা, দোকানপাট, বাসাবাড়ি, ঘরের মধ্যে পানি। কোথাও কোথাও হাটু পানি আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত। সিলেট নগরীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত উপশহর এখন পুরো বিপর্যস্ত, এটি যেন আলাদা দ্বীপ। পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রবল বর্ষণ অব্যাহত থাকায় রাস্তায় কম মানুষ দেখা গেছে। এদিকে চালিবন্দর, মিরাবাজার, আগপাড়া, শাহীঈদগাহ, টিবি গেট, কাজলশাহসহ ২০-৩০টি এলাকায় নতুন করে পানি প্রবেশে করেছ। সবমিলিয়ে শতাধিক মহল্লার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুর থেকে তারা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নৌবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য নৌবাহিনীরও সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বানভাসীদের উদ্ধারকাজ আরও বেগবান হবে। এরই মধ্যে বন্যা কবলিত সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনী। দুই জেলার ৮ উপজেলায় সেনাবাহিনীর ১০ প্লাটুন এবং ৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। নৌকা দিয়ে বাড়িঘর থেকে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয় আসছেন সেনা সদস্যরা। সিলেট সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক গণমাধ্যমকে জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় সিলেটের ৩ উপজেলা ও সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলায় সেনাবাহিনী পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার ও সহায়তা কার্যক্রম চালাবে। এর মধ্যে সিলেট জেলার সদর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ জেলার সদর, দিরাই, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও জামালগঞ্জ উপজেলা রয়েছে। জিওসি জানান, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বন্যা কবলিত এলাকায় পাঁচটি কাজ করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করা। বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পানিবন্দি মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। বন্যা আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা। স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সীমিত পরিসরে খাদ্য সামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা।
হবিগঞ্জে ভয়াবহ রূপ
হবিগঞ্জেও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা। গত কয়েক দিনের উজানের পাহাড়ি ঢল এবং প্রবল বর্ষণে কুশিয়ারা, খোয়াই ও কালনীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জেলার আজমিরীগঞ্জ ও নবীগঞ্জ উপজেলার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু স্থানে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। আজমিরীগঞ্জ সরকারি কলেজ, মিয়াধন মিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, পাহাড়পুর কলেজ, কাকাইলছেও মমচাঁন ভুঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত গ্রামের মানুষদের উদ্ধার করে প্রশাসন নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। জানা যায়, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুর অংশে কালনী ও কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ডুবে এবং পাহাড়পুর এলাকার কৈয়ারঢালা রাস্তা ভেঙে পানি হাওরে প্রবেশ করছে। এতে বদলপুরের পাহাড়পুর, পিরোজপুর, কাকাইলছেও এবং পৌর এলাকার কয়েকটি ওয়ার্ড পানিতে তলিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে উপজেলার কাকাইলছেও সরকারি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে পানি ওঠায় সেখানে থাকা ৬০টি পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এদিকে, নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে রাধাপুর, ফাদুল্লাহ, পাহাড়পুর, পারকুল, দুর্গাপুর, উমরপুর গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। উপজেলার দীঘলবাকের মাধবপুর, পশ্চিম মাধবপুর ও গালিমপুর গ্রাম পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে গেছে। ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের কসবা ইনাতগঞ্জ সড়ক ডুবে দ্রুতগতিতে পানি প্রবেশ করছে বিভিন্ন গ্রামে। এ ছাড়া করগাঁও ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন সাধারণ মানুষ। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিনহাজ আহমেদ শোভন বলেন, ‘টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কুশিয়ারা, কালনী ও খোয়াই নদীর পানি ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। নবীগঞ্জে বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করছে এবং আজমিরীগঞ্জে রাস্তা ভেঙে পানি ঢুকছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।’ নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নবীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়পুর, রাধাপুরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে ও ইনাতগঞ্জ-কসবা সড়ক ডুবে পানি বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করছে। ইতোমধ্যে নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি।’
কুড়িগ্রামে পানিবন্দি ২ লাখ মানুষ
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই লাখ মানুষ। বানভাসী এলাকায় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, শনিবার সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ২২ সেন্টিমিটার ও ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ২২ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানির তীব্র স্রোতে নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মরিয়াহাট এলাকার একটি বেড়িবাঁধের প্রায় ২০ থেকে ২২ ফুট অংশ শুক্রবার ভেঙে যায় বলে জানান তিনি। গত তিনদিনে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামের নয় উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের ১৫০টি গ্রামের প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এবং ৬০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে হয়েছে বলে জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সরকার জানান। তিনি বলেন, “রৌমারী, উলিপুর ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির বেশি অবনতি হয়েছে। বন্যায় জেলায় প্রায় ৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। বানভাসী এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্যে ও জ্বালানীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নদীভাঙন ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বানভাসী মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে রৌমারীতে ৬ হাজার এবং সদর উপজেলায় প্রায় ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার দুর্গতদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের এক হাজার দুইশ বাড়ি পানিতে ডুবে গেছে এবং প্রায় ৬ হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে বলে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান। তিনি বলেন, “যাত্রাপুরে গত ৫ দিনে তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। এছাড়া নদী ভাঙ্ন এবং পানির তোড়ে আরাজিপাড়া, রলাকাটা ও চর যাত্রাপুরের ৬০ পরিবার বাড়িঘর হারিয়েছে।” এদিকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় জেলায় মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ে বেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আর একটি প্রতিষ্ঠান আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম জানান। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, এ পরিস্থিতিতে রৌমারীতে ৪৪টি এবং কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ১১টিসহ ৫৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাসেদুল হাসান বলেন, তারা দুর্গত এলাকা পরির্দশন করে এরই মধ্যে উদ্ধার ও শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছেন। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুর রশীদ জানান, দ্বিতীয় দফা বন্যায় তলিয়ে যাওয়া ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা বেড়েছে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করে কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে, যাতে বন্যা পুনর্বাসন প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় তাদেরকে সহযোগিতা করা যায়। পাশপাশি বন্যা কবলিতদের চিকিৎসা সেবা দিতে ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে সিভিল সার্জন ডা. মো. মনজুর এ মুর্শেদ সাংবাদিকদের জানান। বন্যায় মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে নয় উপজেলার বন্যাদুর্গত মানুষের সহায়তার জন্য ২৯৫ মেট্রিকটন চাল, নগদ ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশু খাদ্য ক্রয় বাবদ ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং গোখাদ্য ক্রয় বাবদ ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসব তথ্য জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, “উপজেলা পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করে ত্রাণ বিতরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৮ লাখ টাকা এবং ৩০৮ মেট্রিকটন চাল মজুদ রয়েছে। আরও পাঁচশ মেট্রিকটন চাল, ১০ লাখ টাকা ও ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার নতুন করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
বন্যার শঙ্কা, ‘বিপদজনক’ তিস্তা
নীলফামারীতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বৃষ্টি বাড়াতে পারে বিপদ। গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় তিস্তা বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বৃষ্টি নামতে থাকায় বন্যার শঙ্কা এখনও কাটেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ডিমলা উপজেলার পুর্ব ছাতনাই, খগাখাড়বাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ী ও জলঢাকার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকায় ১০টি চর গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর আগে, শুক্রবার (১৭ জুন) সন্ধ্যা পর্যন্ত ডালিয়া পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল। তিস্তার ব্যারাজের বিপৎসীমা ৫২.৬০ সেন্টিমিটার। পানি বাড়ায় চর ও নি¤œাঞ্চলেন কয়েক শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নূল ইসলাম জানান, নি¤œাঞ্চল ও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে সন্ধ্যা নাগাদ ব্যারেজ পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এলাকার লোকজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ জানান, ঝাড়সিংশ্বর এলাকাসহ জলঢাকার ডাউয়াবাড়ী, হলদিবাড়ী, গোপালঝাড় ও আলসিয়া পাড়ায় বন্যার পানি ছুঁই ছুঁই করছে। ডালিয়া ডিভিশনের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের (৪৪টি) স্লুইচ গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ডালিয়া ডিভিশনের উপসহকারী প্রকৌশলী (পানি শাখা) ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘উজানের ভারি বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও গত তিন দিনের অনবরত বৃষ্টিতে তিস্তায় পানি ওঠানামা করছে। এতে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নি¤œাঞ্চল তলিয়ে গেছে।’ পাউবো’র ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আশফাউদৌলা জানান, গত দুই দিনের ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যায়। টানা বর্ষণ ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকলে আবারও পানি বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যার পানি সামাল দিতে ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইচ গেট খুলে রাখা হয়েছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘তিস্তার পানি ওঠানামা করছে। নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বন্যা এলাকায় নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
বাড়ছে পদ্মার পানি, নি¤œাঞ্চল প্লাবিত
এদিকে হঠাৎ বন্যার প্রভাব পড়তে শুধু করেছে ফরিদপুরে। ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পদ্মার পানি অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে চর অধ্যুষিত নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। পদ্মার গোয়ালন্দ পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জেলার পদ্মা, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নি¤œাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হতে শুরু করেছে। বর্তমানে বিপৎসীমার ১ মিটার নিচে দিয়ে পদ্মার পানি প্রবাহিত হলেও আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে তা অতিক্রম করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফরিদপুর সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের আইজুদ্দিন মাতুব্বরের ডাঙ্গী এলাকার মাসুদ সরদার জানান, গত ৭-৮ দিন ধরে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেলেও দু’দিন ধরে সেটির মাত্রা আরও বেড়েছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি পেলে কয়েকদিনের মধ্যে অনেক বাড়িতে পানি ওঠা শুরু হবে। একই ইউনিয়নের কাইমুদ্দিন ডাঙ্গী এলাকার হাজেরা খাতুন (৭০) বলেন, দু’দিন ধইরা যেমন কইরা পানি বাইড়্যা বাইস্যা অ্যয়ে, তাতে বয়্যে (ভয়ে) আছি। কি থ্যাইকা কি অ্যয়ে (হয়ে) যায়। ফরিদপুর জেলা সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান মুস্তাক বলেন, ইউনিয়নে হু হু করে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দু’দিনে প্রায় ১ ফুট পানি বেড়েছে। এ ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলের প্রায় ৫০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাদামসহ অন্যন্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিদিনই ফরিদপুরের পদ্মা, মধুমতি নদী ও আড়িয়াল খাঁ নদের পানি বাড়ছে। পদ্মার পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বিপৎসীমার ১ মিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমার লেভেল ৮ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার)। তবে এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দুই-তিন দিনে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দীপক কুমার রায় বলেন, ত্রাণ বিতরণের মতো বন্যা এখনও হয়নি। তবে, বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে ফরিদপুরের ৯টি উপজেলার ইউএনওকে সাত টন করে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৫০ টনের বেশি ত্রাণ মজুদ আছে। বন্যা মোকাবিলায় তেমন কোনো সমস্যা হবে না আশা রাখছি।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

ভয়াবহ বন্যার কবলে দেশ

আপডেট সময় : ০১:৪৭:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জুন ২০২২

দেশের খবর ডেস্ক : সিলেট থেকে শুরু হলেও বন্যা এখন দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। এরকম বন্যা আগে কখনও দেখা যায়নি বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে- এই বন্যার ফলে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্যায় সিলেটের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া হবিগঞ্জ, নীলফামারি, কুড়িগ্রামেও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। জানাচ্ছেন প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারাঃ
সিলেটে ভয়াবহ বিপর্যয়
সিলেটবাসীদের অভিজ্ঞতায় এরকম বন্যা আগে কখনও দেখা যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে- এই বন্যার ফলে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্যায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সিলেট নগরীর বিশ্বরোডেও পানি। সোবাহানীঘাট-চালিবন্দর এ বিশ্বরোডে এর আগে পানি ওঠেনি। প্রশাসন বলছে সিলেটে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদিকে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের মধ্যে পানি ঢুকে পড়ায় সিলেট-সুনামগঞ্জের গোটা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিলেটের স্থানীয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ছোট যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। রিকশা ও বড় যান পানি ডিঙিয়ে চলছে। শুধু বিশ্বরোডে নয়, নগরীর সুবিদবাজার রোডসহ একাধিক মূল সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া নগরীর চারদিকে থৈ থৈ পানি। রাস্তা, দোকানপাট, বাসাবাড়ি, ঘরের মধ্যে পানি। কোথাও কোথাও হাটু পানি আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত। সিলেট নগরীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত উপশহর এখন পুরো বিপর্যস্ত, এটি যেন আলাদা দ্বীপ। পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রবল বর্ষণ অব্যাহত থাকায় রাস্তায় কম মানুষ দেখা গেছে। এদিকে চালিবন্দর, মিরাবাজার, আগপাড়া, শাহীঈদগাহ, টিবি গেট, কাজলশাহসহ ২০-৩০টি এলাকায় নতুন করে পানি প্রবেশে করেছ। সবমিলিয়ে শতাধিক মহল্লার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুর থেকে তারা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নৌবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য নৌবাহিনীরও সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বানভাসীদের উদ্ধারকাজ আরও বেগবান হবে। এরই মধ্যে বন্যা কবলিত সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনী। দুই জেলার ৮ উপজেলায় সেনাবাহিনীর ১০ প্লাটুন এবং ৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। নৌকা দিয়ে বাড়িঘর থেকে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয় আসছেন সেনা সদস্যরা। সিলেট সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক গণমাধ্যমকে জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় সিলেটের ৩ উপজেলা ও সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলায় সেনাবাহিনী পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার ও সহায়তা কার্যক্রম চালাবে। এর মধ্যে সিলেট জেলার সদর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ জেলার সদর, দিরাই, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও জামালগঞ্জ উপজেলা রয়েছে। জিওসি জানান, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বন্যা কবলিত এলাকায় পাঁচটি কাজ করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করা। বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পানিবন্দি মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। বন্যা আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা। স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সীমিত পরিসরে খাদ্য সামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা।
হবিগঞ্জে ভয়াবহ রূপ
হবিগঞ্জেও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা। গত কয়েক দিনের উজানের পাহাড়ি ঢল এবং প্রবল বর্ষণে কুশিয়ারা, খোয়াই ও কালনীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জেলার আজমিরীগঞ্জ ও নবীগঞ্জ উপজেলার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু স্থানে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। আজমিরীগঞ্জ সরকারি কলেজ, মিয়াধন মিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, পাহাড়পুর কলেজ, কাকাইলছেও মমচাঁন ভুঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত গ্রামের মানুষদের উদ্ধার করে প্রশাসন নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। জানা যায়, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুর অংশে কালনী ও কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ডুবে এবং পাহাড়পুর এলাকার কৈয়ারঢালা রাস্তা ভেঙে পানি হাওরে প্রবেশ করছে। এতে বদলপুরের পাহাড়পুর, পিরোজপুর, কাকাইলছেও এবং পৌর এলাকার কয়েকটি ওয়ার্ড পানিতে তলিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে উপজেলার কাকাইলছেও সরকারি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে পানি ওঠায় সেখানে থাকা ৬০টি পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এদিকে, নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে রাধাপুর, ফাদুল্লাহ, পাহাড়পুর, পারকুল, দুর্গাপুর, উমরপুর গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। উপজেলার দীঘলবাকের মাধবপুর, পশ্চিম মাধবপুর ও গালিমপুর গ্রাম পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে গেছে। ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের কসবা ইনাতগঞ্জ সড়ক ডুবে দ্রুতগতিতে পানি প্রবেশ করছে বিভিন্ন গ্রামে। এ ছাড়া করগাঁও ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন সাধারণ মানুষ। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিনহাজ আহমেদ শোভন বলেন, ‘টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কুশিয়ারা, কালনী ও খোয়াই নদীর পানি ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। নবীগঞ্জে বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করছে এবং আজমিরীগঞ্জে রাস্তা ভেঙে পানি ঢুকছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।’ নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নবীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়পুর, রাধাপুরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে ও ইনাতগঞ্জ-কসবা সড়ক ডুবে পানি বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করছে। ইতোমধ্যে নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি।’
কুড়িগ্রামে পানিবন্দি ২ লাখ মানুষ
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই লাখ মানুষ। বানভাসী এলাকায় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, শনিবার সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ২২ সেন্টিমিটার ও ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ২২ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানির তীব্র স্রোতে নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মরিয়াহাট এলাকার একটি বেড়িবাঁধের প্রায় ২০ থেকে ২২ ফুট অংশ শুক্রবার ভেঙে যায় বলে জানান তিনি। গত তিনদিনে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামের নয় উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের ১৫০টি গ্রামের প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এবং ৬০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে হয়েছে বলে জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সরকার জানান। তিনি বলেন, “রৌমারী, উলিপুর ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির বেশি অবনতি হয়েছে। বন্যায় জেলায় প্রায় ৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। বানভাসী এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্যে ও জ্বালানীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নদীভাঙন ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বানভাসী মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে রৌমারীতে ৬ হাজার এবং সদর উপজেলায় প্রায় ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার দুর্গতদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের এক হাজার দুইশ বাড়ি পানিতে ডুবে গেছে এবং প্রায় ৬ হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে বলে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান। তিনি বলেন, “যাত্রাপুরে গত ৫ দিনে তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। এছাড়া নদী ভাঙ্ন এবং পানির তোড়ে আরাজিপাড়া, রলাকাটা ও চর যাত্রাপুরের ৬০ পরিবার বাড়িঘর হারিয়েছে।” এদিকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় জেলায় মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ে বেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আর একটি প্রতিষ্ঠান আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম জানান। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, এ পরিস্থিতিতে রৌমারীতে ৪৪টি এবং কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ১১টিসহ ৫৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাসেদুল হাসান বলেন, তারা দুর্গত এলাকা পরির্দশন করে এরই মধ্যে উদ্ধার ও শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছেন। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুর রশীদ জানান, দ্বিতীয় দফা বন্যায় তলিয়ে যাওয়া ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা বেড়েছে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করে কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে, যাতে বন্যা পুনর্বাসন প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় তাদেরকে সহযোগিতা করা যায়। পাশপাশি বন্যা কবলিতদের চিকিৎসা সেবা দিতে ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে সিভিল সার্জন ডা. মো. মনজুর এ মুর্শেদ সাংবাদিকদের জানান। বন্যায় মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে নয় উপজেলার বন্যাদুর্গত মানুষের সহায়তার জন্য ২৯৫ মেট্রিকটন চাল, নগদ ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশু খাদ্য ক্রয় বাবদ ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং গোখাদ্য ক্রয় বাবদ ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসব তথ্য জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, “উপজেলা পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করে ত্রাণ বিতরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৮ লাখ টাকা এবং ৩০৮ মেট্রিকটন চাল মজুদ রয়েছে। আরও পাঁচশ মেট্রিকটন চাল, ১০ লাখ টাকা ও ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার নতুন করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
বন্যার শঙ্কা, ‘বিপদজনক’ তিস্তা
নীলফামারীতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বৃষ্টি বাড়াতে পারে বিপদ। গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় তিস্তা বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বৃষ্টি নামতে থাকায় বন্যার শঙ্কা এখনও কাটেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ডিমলা উপজেলার পুর্ব ছাতনাই, খগাখাড়বাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ী ও জলঢাকার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকায় ১০টি চর গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর আগে, শুক্রবার (১৭ জুন) সন্ধ্যা পর্যন্ত ডালিয়া পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল। তিস্তার ব্যারাজের বিপৎসীমা ৫২.৬০ সেন্টিমিটার। পানি বাড়ায় চর ও নি¤œাঞ্চলেন কয়েক শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নূল ইসলাম জানান, নি¤œাঞ্চল ও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে সন্ধ্যা নাগাদ ব্যারেজ পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এলাকার লোকজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ জানান, ঝাড়সিংশ্বর এলাকাসহ জলঢাকার ডাউয়াবাড়ী, হলদিবাড়ী, গোপালঝাড় ও আলসিয়া পাড়ায় বন্যার পানি ছুঁই ছুঁই করছে। ডালিয়া ডিভিশনের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের (৪৪টি) স্লুইচ গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ডালিয়া ডিভিশনের উপসহকারী প্রকৌশলী (পানি শাখা) ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘উজানের ভারি বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও গত তিন দিনের অনবরত বৃষ্টিতে তিস্তায় পানি ওঠানামা করছে। এতে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নি¤œাঞ্চল তলিয়ে গেছে।’ পাউবো’র ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আশফাউদৌলা জানান, গত দুই দিনের ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যায়। টানা বর্ষণ ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকলে আবারও পানি বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যার পানি সামাল দিতে ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইচ গেট খুলে রাখা হয়েছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘তিস্তার পানি ওঠানামা করছে। নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বন্যা এলাকায় নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
বাড়ছে পদ্মার পানি, নি¤œাঞ্চল প্লাবিত
এদিকে হঠাৎ বন্যার প্রভাব পড়তে শুধু করেছে ফরিদপুরে। ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পদ্মার পানি অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে চর অধ্যুষিত নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। পদ্মার গোয়ালন্দ পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জেলার পদ্মা, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নি¤œাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হতে শুরু করেছে। বর্তমানে বিপৎসীমার ১ মিটার নিচে দিয়ে পদ্মার পানি প্রবাহিত হলেও আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে তা অতিক্রম করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফরিদপুর সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের আইজুদ্দিন মাতুব্বরের ডাঙ্গী এলাকার মাসুদ সরদার জানান, গত ৭-৮ দিন ধরে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেলেও দু’দিন ধরে সেটির মাত্রা আরও বেড়েছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি পেলে কয়েকদিনের মধ্যে অনেক বাড়িতে পানি ওঠা শুরু হবে। একই ইউনিয়নের কাইমুদ্দিন ডাঙ্গী এলাকার হাজেরা খাতুন (৭০) বলেন, দু’দিন ধইরা যেমন কইরা পানি বাইড়্যা বাইস্যা অ্যয়ে, তাতে বয়্যে (ভয়ে) আছি। কি থ্যাইকা কি অ্যয়ে (হয়ে) যায়। ফরিদপুর জেলা সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান মুস্তাক বলেন, ইউনিয়নে হু হু করে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দু’দিনে প্রায় ১ ফুট পানি বেড়েছে। এ ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলের প্রায় ৫০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাদামসহ অন্যন্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিদিনই ফরিদপুরের পদ্মা, মধুমতি নদী ও আড়িয়াল খাঁ নদের পানি বাড়ছে। পদ্মার পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বিপৎসীমার ১ মিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমার লেভেল ৮ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার)। তবে এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দুই-তিন দিনে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দীপক কুমার রায় বলেন, ত্রাণ বিতরণের মতো বন্যা এখনও হয়নি। তবে, বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে ফরিদপুরের ৯টি উপজেলার ইউএনওকে সাত টন করে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৫০ টনের বেশি ত্রাণ মজুদ আছে। বন্যা মোকাবিলায় তেমন কোনো সমস্যা হবে না আশা রাখছি।