ঢাকা ০৫:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভয়ঙ্কর মাদক সিন্ডিকেট

  • আপডেট সময় : ০১:৩৫:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ মার্চ ২০২২
  • ১০৬ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : মিয়ানমার থেকে ইয়াবা-আইসসহ যেসব মাদক দেশে ঢোকে তার বেশির ভাগই আনা হয় বাকিতে। আগে এ জন্য কোনো কিছু বন্ধক রাখতে হতো না। এখন বন্ধক কিংবা জিম্মা দিয়ে আনতে হয় চালান। বন্ধক হিসেবে রাখা হয় মানুষ। কোনো কারণে চালানের টাকা পরিশোধ না হলে এই বন্ধকি মানুষটির লাশ পড়ে নাফ নদীতে।
এমনই ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে সংবাদসংস্থা ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে। যেসব উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং যাদের সঙ্গে আলাপ করে এই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে, তাদের ভাষ্য, ইতিমধ্যে এ রকম কয়েকটি মরদেহ নাফ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রায় সবাই রোহিঙ্গা নাগরিক।
এই জিম্মাদাররা একেক চালানের জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান। ওপারের চোরাকারবারিরা টাকা পেতে দেরি হলে জিম্মাদারের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যু।
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে নাফ নদী ও সমুদ্রসীমা পার হয়ে দেশে আসছে ভয়ংকর সব মাদক। এতে জড়িত দুই দেশের কারবারিদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। কিছুদিন আগেও নিয়ম ছিল বাংলাদেশে আসা মাদকের চালান বিক্রির পর টাকা পরিশোধ করা। আরেকটি সুবিধা ছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে চালান ধরা পড়ে গেলে, টাকা পরিশোধ করতে হতো না। শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত খবরের ‘পোপার কাটিং’ দেখালে চলত।
সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা। তারা মনে করছে, মাদক আটকের খবর কিংবা ঘটনায় কারসাজি হচ্ছে। বাহকদের সতর্কতায়ও ঠিলেমি ঘটে। তাই এখন তারা বাংলাদেশি কারবারিদের বাকিতে মাদক বিক্রি করলেও কোনোভাবে টাকা মাফ করতে নারাজ। তাই জিম্মাদার ব্যবস্থা নিয়েছে তারা।
এসব জিম্মার কাজ করছে রোহিঙ্গা নাগরিকরা, যাদের বেশির ভাগ দেশটিতে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। অভাবের তাড়নায় সাধারণ রোহিঙ্গারা জিম্মা পেশায় জড়াচ্ছেন। ঢাকা টাইমস এই প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মাদক বহনে জড়িত একাধিক মাঝির সঙ্গে কথা বলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকেও তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। সংগত কারণেই কারও নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
মাঝিদের কথা : একজন মাঝি জানান, বাকিতে আনা মাদকের পেমেন্ট (কারবারিদের ভাষায়) দিতে দেরি হলে জিম্মায় থাকা মানুষদের প্রথমে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। তাতেও পেমেন্টে না পেলে বাড়ানো হয় নির্যাতনের মাত্রা। যখন বুঝতে পারে পেমেন্ট অনিশ্চিত, জিম্মাদারকে হত্যা করে মরদেহ নাফ নদীতে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। গেল দুই মাসে জিম্মায় থাকা এমন পাঁচজনকে হত্যার তথ্য মিলেছে বলে জানান ওই মাঝি। তাদের মরদেহ নাফ নদীতে ভাসতে দেখেছে স্থানীয়রা। তবে রোহিঙ্গা হওয়ায় তাদের নাম-পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ‘র’ অদ্যক্ষরের একজন মাঝি মাঝেমধ্যে ওপার থেকে মাদক বহনের কাজ করেন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এখন মিয়ানমার থেকে চালান আনতে মানুষ জমা রাখতে হয়। আগে এই ব্যবস্থা ছিল না। এখন ওরা (মিয়ানমারের কারবারি) জিম্মা ছাড়া মাল (মাদক) ছাড়ে না।’
এই জিম্মা যে জীবনের জন্য কী ঝুঁকিপূর্ণ সে কথাও তুলে ধরেন ‘র’ অদ্যক্ষরের মাঝি। জিম্মা দিয়ে আনা মাল ঠিক ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে গেলে এবং টাকা পরিশোধ হলে কোনো সমস্যা নেই। জিম্মাদার তার পাওনা পেয়ে যান। কিন্তু চালানটি প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে গেলে, আর এপারের কারবারিরা পেমেন্টের দায়িত্ব না নিলে জিম্মাদারের বাঁচা-মরা চলে যায় ওপারের কারবারিদের হাতে।
‘র’ অদ্যক্ষরের মাঝি বলেন, গত দুই মাসে ওরা পাঁচজনকে মেরে নাফ নদীতে ফেলে দিয়েছে- এমন তথ্য জেনেছেন তিনি।
মাঝির ভাষ্য, এমনিতে এই অন্ধকার জগতের কোনো কারবারিই পেমেন্ট দিতে দেরি করে না, যদি না মাল ধরা পড়ে যায়। কেউ কেউ চালান মার খাওয়ার পরও ওপারের লোকদের সঙ্গে সমঝোতা করে পেমেন্ট কম-বেশি দিয়ে কারবার চালিয়ে যায়। তবে অনেকে সে পথে যায় না, যার খেসারত দিতে হয় জিম্মাদারকে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেরই অপেক্ষাকৃত অতিদরিদ্ররা কারবারিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এই জিম্মা পেশায় জড়াচ্ছেন বলে জানান মাঝি। মিয়ানমারে একজনকে জিম্মায় রেখে এক কেজি আইস আনা যায়। এক লাখ ইয়াবা আনতেও একজনকে জিম্মা রাখতে হয়। চালানের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কজন জিম্মা থাকবে।
বেশির ভাগ সময় বড় মাদক কারবারিরা প্রতি চালানে অন্তত পাঁচ কেজি আইস বা পাঁচ লাখ ইয়াবা দেশে আনার চেষ্টা করে। এতে বন্ধকি মানুষের সংখ্যাও বাড়ে। কক্সবাজারে মাদক পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে হাতবদল হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়। আর মিয়ানমার কারবারিদের জিম্মায় থাকা একজন প্রতি চালানে দশ থেকে পনের হাজার টাকা পান।
সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে প্রতিটি ইয়াবা কেনায় খরচ পড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। কক্সবাজারে এসে এর দাম হয়ে যায় ৪০ থেকে ৬০ টাকা। আর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় এসে দাম দাঁড়ায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। আর প্রতি কেজি আইসের দাম মিয়ানমারে পড়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। কক্সবাজারে এসে দাম হয় ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। এই কারবারিরা এক কেজি আইস চট্টগ্রামে পৌঁছে দিতে ১৫ লাখ এবং ঢাকায় পৌঁছে দিতে ৫০ লাখ নিয়ে থাকে। ঢাকায় খুচরা প্রতি ১০ গ্রাম আইস এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়, যা কেজিতে দাঁড়ায় এক কোটি টাকা।
মাদক ব্যবসায় কারা এবং জিম্মায় যাচ্ছে কীভাবে : স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দেড় শ থেকে দুই শতাধিক কারবারি ইয়াবা ও আইসের কারবারে জড়িত। এদের বেশির ভাগ রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে এদেশের মাদক কারবারিরা। মূলত, ওপার থেকে মাদক আনা, দাম নির্ধারণ, মানুষ বন্ধক- এই কাজগুলো করে রোহিঙ্গা কারবারিরা। আর এপারে মাদক আসার পর দেশের কারবারিরা তা ভাগ করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। কারবারিরা মিয়ানমার থেকে এক গ্রাম আইস কেনেন দেড় থেকে দুই হাজার টাকায়। আর দেশের ভেতরে এর দাম ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ইয়াবা-আইস আনার ক্ষেত্রে প্রথমে এপারে থাকা কারবারিরা ওপারের কারবারিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। এ ক্ষেত্রে তারা মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে। এরপর মাছ ধরার কৌশলে ছোট্ট ছোট্ট নৌকায় মিয়ানমার সীমান্তে চলে যায়। সেখান থেকে কৌশলে মানুষ বন্ধক দিয়ে মাছ ধরার ছদ্মবেশে সমুদ্রে অবস্থান করে। পরে সময়-সুযোগমতো তারা কক্সবাজার চলে আসে। কারবারিদের একটি সিন্ডিকেট আছে যারা অর্থের লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মানুষদের ফাঁদে ফেলে। পরে ওপারে জিম্মা বা বন্ধক রেখে আসে।
মাদকের টাকা লেনদেন যেভাবে : ওপার থেকে কিনে আনা মাদকের টাকা কখনো সরাসরি পাঠানো হয় না। বিশেষ করে ‘স্বর্ণ’ হিসেবে বা মিয়ানমারের কারবারিদের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে। তবে হুন্ডির মাধ্যমে এখন টাকা বেশি পাঠানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হুন্ডির ব্যবসা বেশ জমজমাট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালালেই মিলছে স্বর্ণ। বাংলাদেশি টাকায় স্বর্ণ কিনে তা মিয়ানমারে পাঠানো হচ্ছে। এতে টাকা পরিবহণের ঝামেলা কম। মাদক আনার সময় স্বর্ণ পৌঁছে দেওয়া হয় দেশটির কারবারিদের কাছে।
যেভাবে মাছ ধরার ট্রলারে আসছে ইয়াবা-আইস : ইয়াবা তৈরির প্রধান উপাদান রাসায়নিক অ্যাম্ফিটামিন চীন ও থাইল্যান্ড থেকে পাচার হয়ে মিয়ানমারে আসে। সেখানেই তৈরি হয় ইয়াবা। এরপর বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রথম দিকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে দেশে আইস আসত। বর্তমানে ওই উৎস থেকে আসা একেবারে কমে গেছে। এখন ইয়াবার মতো আইসও আসছে মিয়ানমার থেকে। টেকনাফ সীমান্তপথে দেশে ঢোকার পর এসব মাদক মজুত করা হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। একাধিক গোয়েন্দা সূত্র ঢাকা টাইমসকে জানায়, নাফ নদী ও টেকনাফের সমুদ্রসীমানার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে আসছে এসব মাদক। যোগাযোগের জন্য দুই পক্ষই মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে। দেশটির মোবাইল নেটওয়ার্ক কক্সবাজার শহরের কলাতলী বিচ পর্যন্ত কাজ করে বলে জানান গোয়েন্দারা। এতে দেশে আসা মাদকের চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে ধরা কঠিন হয়ে যায়। মাছ ধরার নৌকা যখন গভীর সমুদ্রে চলে যায়, তখন সুযোগ বুঝে রাত তিনটা থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে কারবারিরা লাইট সিগন্যাল ব্যবহার করে। নির্ধারিত সিগন্যাল পেলে চালানটি এদেশের জেলেদের নৌকায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ সময় মাদকের চালান নৌকায় নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে থাকে জেলেরা। পরে সুযোগ বুঝে ঘাটে ফিরে আসে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে : র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খাইরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘এমন খবর (মানুষ জিম্মা) আমরা মাঝেমধ্যেই পাচ্ছি। বেশ কয়েকটা গ্রুপ এই ধরনের কাজ করছে। তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক নাইমুল হক নাইম বলেন, ‘এটা নতুন তথ্য। আমরা খোঁজ-খবর নেব।’
নদীতে মাঝে মাঝে মরদেহ পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘নাফ নদীতে অনেক সময় ডেডবডি (মৃতদেহ) পাওয়া যায়। তবে সেগুলো জিম্মা রেখে আসা রোহিঙ্গা- এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। মৃতদেহগুলো অনেক সময় ডিকম্পোস্ট থাকে।’ পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘হঠাৎ করে শোনা যায়, সেন্ট মার্টিনের ওদিকে অথবা নাফ নদীতে মরদেহ। তবে অনেক সময় সেগুলো শনাক্ত করা যায় না; কিন্তু আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আর এ বিষয়ে (জিম্মা) অবশ্যই আমাদের গোয়েন্দারা খোঁজ-খবর নেবে। আমরা সম্ভবপর সব চেষ্টা করবো।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ভয়ঙ্কর মাদক সিন্ডিকেট

আপডেট সময় : ০১:৩৫:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ মার্চ ২০২২

প্রত্যাশা ডেস্ক : মিয়ানমার থেকে ইয়াবা-আইসসহ যেসব মাদক দেশে ঢোকে তার বেশির ভাগই আনা হয় বাকিতে। আগে এ জন্য কোনো কিছু বন্ধক রাখতে হতো না। এখন বন্ধক কিংবা জিম্মা দিয়ে আনতে হয় চালান। বন্ধক হিসেবে রাখা হয় মানুষ। কোনো কারণে চালানের টাকা পরিশোধ না হলে এই বন্ধকি মানুষটির লাশ পড়ে নাফ নদীতে।
এমনই ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে সংবাদসংস্থা ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে। যেসব উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং যাদের সঙ্গে আলাপ করে এই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে, তাদের ভাষ্য, ইতিমধ্যে এ রকম কয়েকটি মরদেহ নাফ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রায় সবাই রোহিঙ্গা নাগরিক।
এই জিম্মাদাররা একেক চালানের জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান। ওপারের চোরাকারবারিরা টাকা পেতে দেরি হলে জিম্মাদারের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যু।
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে নাফ নদী ও সমুদ্রসীমা পার হয়ে দেশে আসছে ভয়ংকর সব মাদক। এতে জড়িত দুই দেশের কারবারিদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। কিছুদিন আগেও নিয়ম ছিল বাংলাদেশে আসা মাদকের চালান বিক্রির পর টাকা পরিশোধ করা। আরেকটি সুবিধা ছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে চালান ধরা পড়ে গেলে, টাকা পরিশোধ করতে হতো না। শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত খবরের ‘পোপার কাটিং’ দেখালে চলত।
সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা। তারা মনে করছে, মাদক আটকের খবর কিংবা ঘটনায় কারসাজি হচ্ছে। বাহকদের সতর্কতায়ও ঠিলেমি ঘটে। তাই এখন তারা বাংলাদেশি কারবারিদের বাকিতে মাদক বিক্রি করলেও কোনোভাবে টাকা মাফ করতে নারাজ। তাই জিম্মাদার ব্যবস্থা নিয়েছে তারা।
এসব জিম্মার কাজ করছে রোহিঙ্গা নাগরিকরা, যাদের বেশির ভাগ দেশটিতে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। অভাবের তাড়নায় সাধারণ রোহিঙ্গারা জিম্মা পেশায় জড়াচ্ছেন। ঢাকা টাইমস এই প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মাদক বহনে জড়িত একাধিক মাঝির সঙ্গে কথা বলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকেও তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। সংগত কারণেই কারও নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
মাঝিদের কথা : একজন মাঝি জানান, বাকিতে আনা মাদকের পেমেন্ট (কারবারিদের ভাষায়) দিতে দেরি হলে জিম্মায় থাকা মানুষদের প্রথমে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। তাতেও পেমেন্টে না পেলে বাড়ানো হয় নির্যাতনের মাত্রা। যখন বুঝতে পারে পেমেন্ট অনিশ্চিত, জিম্মাদারকে হত্যা করে মরদেহ নাফ নদীতে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। গেল দুই মাসে জিম্মায় থাকা এমন পাঁচজনকে হত্যার তথ্য মিলেছে বলে জানান ওই মাঝি। তাদের মরদেহ নাফ নদীতে ভাসতে দেখেছে স্থানীয়রা। তবে রোহিঙ্গা হওয়ায় তাদের নাম-পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ‘র’ অদ্যক্ষরের একজন মাঝি মাঝেমধ্যে ওপার থেকে মাদক বহনের কাজ করেন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এখন মিয়ানমার থেকে চালান আনতে মানুষ জমা রাখতে হয়। আগে এই ব্যবস্থা ছিল না। এখন ওরা (মিয়ানমারের কারবারি) জিম্মা ছাড়া মাল (মাদক) ছাড়ে না।’
এই জিম্মা যে জীবনের জন্য কী ঝুঁকিপূর্ণ সে কথাও তুলে ধরেন ‘র’ অদ্যক্ষরের মাঝি। জিম্মা দিয়ে আনা মাল ঠিক ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে গেলে এবং টাকা পরিশোধ হলে কোনো সমস্যা নেই। জিম্মাদার তার পাওনা পেয়ে যান। কিন্তু চালানটি প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে গেলে, আর এপারের কারবারিরা পেমেন্টের দায়িত্ব না নিলে জিম্মাদারের বাঁচা-মরা চলে যায় ওপারের কারবারিদের হাতে।
‘র’ অদ্যক্ষরের মাঝি বলেন, গত দুই মাসে ওরা পাঁচজনকে মেরে নাফ নদীতে ফেলে দিয়েছে- এমন তথ্য জেনেছেন তিনি।
মাঝির ভাষ্য, এমনিতে এই অন্ধকার জগতের কোনো কারবারিই পেমেন্ট দিতে দেরি করে না, যদি না মাল ধরা পড়ে যায়। কেউ কেউ চালান মার খাওয়ার পরও ওপারের লোকদের সঙ্গে সমঝোতা করে পেমেন্ট কম-বেশি দিয়ে কারবার চালিয়ে যায়। তবে অনেকে সে পথে যায় না, যার খেসারত দিতে হয় জিম্মাদারকে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেরই অপেক্ষাকৃত অতিদরিদ্ররা কারবারিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এই জিম্মা পেশায় জড়াচ্ছেন বলে জানান মাঝি। মিয়ানমারে একজনকে জিম্মায় রেখে এক কেজি আইস আনা যায়। এক লাখ ইয়াবা আনতেও একজনকে জিম্মা রাখতে হয়। চালানের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কজন জিম্মা থাকবে।
বেশির ভাগ সময় বড় মাদক কারবারিরা প্রতি চালানে অন্তত পাঁচ কেজি আইস বা পাঁচ লাখ ইয়াবা দেশে আনার চেষ্টা করে। এতে বন্ধকি মানুষের সংখ্যাও বাড়ে। কক্সবাজারে মাদক পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে হাতবদল হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়। আর মিয়ানমার কারবারিদের জিম্মায় থাকা একজন প্রতি চালানে দশ থেকে পনের হাজার টাকা পান।
সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে প্রতিটি ইয়াবা কেনায় খরচ পড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। কক্সবাজারে এসে এর দাম হয়ে যায় ৪০ থেকে ৬০ টাকা। আর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় এসে দাম দাঁড়ায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। আর প্রতি কেজি আইসের দাম মিয়ানমারে পড়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। কক্সবাজারে এসে দাম হয় ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। এই কারবারিরা এক কেজি আইস চট্টগ্রামে পৌঁছে দিতে ১৫ লাখ এবং ঢাকায় পৌঁছে দিতে ৫০ লাখ নিয়ে থাকে। ঢাকায় খুচরা প্রতি ১০ গ্রাম আইস এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়, যা কেজিতে দাঁড়ায় এক কোটি টাকা।
মাদক ব্যবসায় কারা এবং জিম্মায় যাচ্ছে কীভাবে : স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দেড় শ থেকে দুই শতাধিক কারবারি ইয়াবা ও আইসের কারবারে জড়িত। এদের বেশির ভাগ রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে এদেশের মাদক কারবারিরা। মূলত, ওপার থেকে মাদক আনা, দাম নির্ধারণ, মানুষ বন্ধক- এই কাজগুলো করে রোহিঙ্গা কারবারিরা। আর এপারে মাদক আসার পর দেশের কারবারিরা তা ভাগ করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। কারবারিরা মিয়ানমার থেকে এক গ্রাম আইস কেনেন দেড় থেকে দুই হাজার টাকায়। আর দেশের ভেতরে এর দাম ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ইয়াবা-আইস আনার ক্ষেত্রে প্রথমে এপারে থাকা কারবারিরা ওপারের কারবারিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। এ ক্ষেত্রে তারা মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে। এরপর মাছ ধরার কৌশলে ছোট্ট ছোট্ট নৌকায় মিয়ানমার সীমান্তে চলে যায়। সেখান থেকে কৌশলে মানুষ বন্ধক দিয়ে মাছ ধরার ছদ্মবেশে সমুদ্রে অবস্থান করে। পরে সময়-সুযোগমতো তারা কক্সবাজার চলে আসে। কারবারিদের একটি সিন্ডিকেট আছে যারা অর্থের লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মানুষদের ফাঁদে ফেলে। পরে ওপারে জিম্মা বা বন্ধক রেখে আসে।
মাদকের টাকা লেনদেন যেভাবে : ওপার থেকে কিনে আনা মাদকের টাকা কখনো সরাসরি পাঠানো হয় না। বিশেষ করে ‘স্বর্ণ’ হিসেবে বা মিয়ানমারের কারবারিদের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে। তবে হুন্ডির মাধ্যমে এখন টাকা বেশি পাঠানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হুন্ডির ব্যবসা বেশ জমজমাট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালালেই মিলছে স্বর্ণ। বাংলাদেশি টাকায় স্বর্ণ কিনে তা মিয়ানমারে পাঠানো হচ্ছে। এতে টাকা পরিবহণের ঝামেলা কম। মাদক আনার সময় স্বর্ণ পৌঁছে দেওয়া হয় দেশটির কারবারিদের কাছে।
যেভাবে মাছ ধরার ট্রলারে আসছে ইয়াবা-আইস : ইয়াবা তৈরির প্রধান উপাদান রাসায়নিক অ্যাম্ফিটামিন চীন ও থাইল্যান্ড থেকে পাচার হয়ে মিয়ানমারে আসে। সেখানেই তৈরি হয় ইয়াবা। এরপর বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রথম দিকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে দেশে আইস আসত। বর্তমানে ওই উৎস থেকে আসা একেবারে কমে গেছে। এখন ইয়াবার মতো আইসও আসছে মিয়ানমার থেকে। টেকনাফ সীমান্তপথে দেশে ঢোকার পর এসব মাদক মজুত করা হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। একাধিক গোয়েন্দা সূত্র ঢাকা টাইমসকে জানায়, নাফ নদী ও টেকনাফের সমুদ্রসীমানার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে আসছে এসব মাদক। যোগাযোগের জন্য দুই পক্ষই মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে। দেশটির মোবাইল নেটওয়ার্ক কক্সবাজার শহরের কলাতলী বিচ পর্যন্ত কাজ করে বলে জানান গোয়েন্দারা। এতে দেশে আসা মাদকের চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে ধরা কঠিন হয়ে যায়। মাছ ধরার নৌকা যখন গভীর সমুদ্রে চলে যায়, তখন সুযোগ বুঝে রাত তিনটা থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে কারবারিরা লাইট সিগন্যাল ব্যবহার করে। নির্ধারিত সিগন্যাল পেলে চালানটি এদেশের জেলেদের নৌকায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ সময় মাদকের চালান নৌকায় নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে থাকে জেলেরা। পরে সুযোগ বুঝে ঘাটে ফিরে আসে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে : র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খাইরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘এমন খবর (মানুষ জিম্মা) আমরা মাঝেমধ্যেই পাচ্ছি। বেশ কয়েকটা গ্রুপ এই ধরনের কাজ করছে। তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক নাইমুল হক নাইম বলেন, ‘এটা নতুন তথ্য। আমরা খোঁজ-খবর নেব।’
নদীতে মাঝে মাঝে মরদেহ পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘নাফ নদীতে অনেক সময় ডেডবডি (মৃতদেহ) পাওয়া যায়। তবে সেগুলো জিম্মা রেখে আসা রোহিঙ্গা- এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। মৃতদেহগুলো অনেক সময় ডিকম্পোস্ট থাকে।’ পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘হঠাৎ করে শোনা যায়, সেন্ট মার্টিনের ওদিকে অথবা নাফ নদীতে মরদেহ। তবে অনেক সময় সেগুলো শনাক্ত করা যায় না; কিন্তু আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আর এ বিষয়ে (জিম্মা) অবশ্যই আমাদের গোয়েন্দারা খোঁজ-খবর নেবে। আমরা সম্ভবপর সব চেষ্টা করবো।’