ঢাকা ১২:৪৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ অগাস্ট ২০২৫

ভয়ংকর গেইম কালচারে বিপন্ন আগামী প্রজন্ম

  • আপডেট সময় : ০৯:৫৪:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ জুলাই ২০২১
  • ১২০ বার পড়া হয়েছে

অজয় দাশগুপ্ত : গেইম কালচারে আক্রান্ত দেশ। সমাজে বাড়ছে মারামারি খুনোখুনি। মাদকের চাইতেও সর্বনাশা এ গেইম। কী সব নাম! কী সব ধারণা! শুনতে পাই বর্তমানে দেশে তরুণ প্রজন্মের মাঝে জনপ্রিয় ফ্রি ফায়ার এবং পাবজি। দক্ষিণ কোরিয়ার গেইম ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ব্লু হোয়েল এর অনলাইন ভার্সন ২০১৭ সালে চালু হয়। এরপর থেকে এ গেইমটি দ্রুত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে চীনের প্রতিষ্ঠানের ২০১৯ সালে তৈরি করা যুদ্ধ গেইম ‘ফ্রি ফায়ার’ একইভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এ গেইম দুইটির জনপ্রিয়তার ফলে তরুণ প্রজন্ম চরমভাবে বিপথগামী হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’ কালচার। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে স্কুল, কলেজ, ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানই অনলাইনভিত্তিক ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছে। আর এ কারণে অভিভাবকরা তার সন্তানদের হাতে ল্যাপটপ, মোবাইল ডিভাইস তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। পাশাপাশি নজর রাখার বিষয়টাও তাদের কাছে কঠিন হয়ে উঠছে। এ সুযোগেই কিশোর-তরুণদের একাংশ জড়িয়ে পড়ছে গেইমভিত্তিক সহিংস কালচারে।

গেইম বিষয়টা কী আসলে? অভিভাবকরা নিশ্চয়ই জানেন তাদের সন্তানেরা কী কী গেইম খেলেন বা কোনটাতে তাদের আসক্তি। কী বললেন- অনেকে জানেন না? না জানার কারণ কী তবে? আপনি এটা খুব ভালো করে বোঝেন দরিদ্র-মুর্খ-অসহায় পরিবারের সন্তানেরা এগুলো জানে না। আর জানলেও তাদের সঙ্গী থাকে ‘বড়লোক’ এর সন্তান। এ কারণে যেসব অভিভাবক জানেন না, বা জানার চেষ্টা করেননি, তারা মূলত তাদের সন্তানদের ব্যাপারে উদাসীন। কারণ? দুটোরও যেকোনও একটি- হয় তাদের হাতে সময় নেই অথবা তারা নিজেরাও ব্যস্ত মোবাইল-ল্যাপটপে। তাদের সময় কেড়ে নিয়েছে ডিজিটাল মিডিয়া। তারা কিভাবে সন্তানদের দেখভাল করবেন!

অভিভাবকেরা না জানলেও পরিস্হিতি কতোটা সাংঘাতিক তার প্রমাণ নিচের খবরটি:

ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো জনপ্রিয় দুই গেইম বন্ধ হচ্ছে বাংলাদেশে। এর আগে পাবজি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হলেও পরে আবার চালু করা হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে এরইমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সুপারিশ করা হয়েছে । বিষয়টি নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও আলোচনা হয়। সেখানে ওই দুইই গেমের আসক্তি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। সম্প্রতি ফ্রি ফায়ার ও পাবজি নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওই দুটি গেইম কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে আসক্তি তৈরি করেছে।

একাধিক মন্ত্রণালয় এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও পরিবারগুলো এখনো জানে না। অন্যদিকে সরকারের সব আদেশ বা পরামর্শ কতোটা কার্যকর বা মানা হবে তা কিন্তু আমরা সবাই জানি। সে কারণে ফিরতে হবে মূলে।

আমাদের শৈশবে এমনকি সেদিনও বাংলাদেশে গেইম বলতে আমরা জানতাম ফুটবল, ক্রিকেট, হাডুডু, মেয়েদের দৌড় এসব। আর এখনকার গেইম হচ্ছে মাঠের বাইরে- ঘরে বা অন্ধকার কোন একটা জায়গায় বসে মোবাইল-ল্যাপটপে চোখের বারোটা বাজিয়ে ঘামতে ঘামতে বোতাম টেপা। এই বোতাম টেপা নিরীহ কিছু না। এর সাথে আছে উন্মাদনা, আছে জোশ। আজকাল গেইমের চেহারা কিভাবে পাল্টেছে তার একটা নমুনা দেওয়া যেতে পারে।

আমাদের সন্তানেরা যখন বড় হচ্ছিল তখন ডিজিটাল গেইম বাজারে এসে গেছে। কিন্তু মোবাইল বা কম্পিউটারে নয়, টিভির বড় পর্দায়। সে পর্দায় গোপনে খেলার সুযোগ ছিল না। দরকার পড়তো অভিভাবকদের সম্মতি। আর অভিভাবকরা নিজেরাই গেইম প্লেয়ার ও গেইম কিনে দিতেন। ফলে তারা জানতে তারা কী দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন। এখন হয়তো সামান্য কয়েকজন অভিভাবক ছাড়া কেউ জানেনই তাদের সন্তানরা কী খেলছে, কেন খেলছে। ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটছে অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে। ‘গেইম জোন’ নামে পরিচিত দোকানগুলো এখানে লাটে উঠেছে আগেই। ইদানিং ঘরে ঘরে গেইমের প্রকোপও কমে গেছে। এর দুটো কারণ :

বাংলাদেশের মতো এতো দীর্ঘমেয়াদী স্কুল কলেজ বন্ধ থাকেনি কোথাও। বিশেষত আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-কানাডা-ইউরোপে করোনাকালে স্কুল তেমন বন্ধ থাকেনি। যতোটা সম্ভব খোলা রাখার কারণ, স্কুল বন্ধ থাকলে বহু মা-বাবা কাজে যেতে পারবেন না। আইনের সমাজে কোন্ বয়সী বাচ্চা একা থাকতে পারবে, আর কারা পারবে না- তার একটা হিসেব আছে। তার ওপর আছে একক পরিবারের ঝামেলা। মা-বাবা দুই জনই কাজ করের বলে আত্মীয়-স্বজনহীন সংসারে কে দেখবে বাচ্চাদের? দূরে কোথাও থাকা কোন আত্মীয় না পারেন আসতে, না সাহায্য করতে। তাই স্কুল খোলা রাখাই দস্তুর। কিংবা চাইল্ড কেয়ার। তাছাড়া বাচ্চাদের মনমেজাজ সময় ভালো রাখতে গৃহবন্দি করে রাখাটা সঠিক নয়।

বাংলাদেশে তা মানা হয়নি। মানার পরিবেশ ছিল কিনা, তারচেয়ে বড় কথা পারা যায় নি। আর না পারার কারণে বেড়েছে গেইম আসক্তি। আসলে তো গেইম না, এ হচ্ছে উন্মাদনা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে চাইল্ড পর্নোগ্রাফির শুরুটাও এখানেই। কিশোর গ্যাং নামে পরিচিত গ্যাং এখন সমাজের আতংক। প্রতিবেদন বলছে- এসব গ্যাং এর করা অপরাধের পেছনে যে কৌশল বা কায়দা তা তারা শিখছে গেইম থেকে। অনেকে জানেন, টিন এজারদের যৌনচাহিদা ও বিকৃতি ভর করেছে নানা গেইমে। এগুলো তাদের কাছে উত্তেজক বটিকার মতো।

সব আমরা জানি ও বুঝি। কিন্তু সমাধান কী? সমাধান বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। তাদের স্কুল-কলেজ খোলাটা যখন ঝুঁকিপূর্ণ, তখন তাদের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়িতে হোমটাস্ক দেওয়া জরুরী। আর তাতে এমন সব বিষয় যোগ করা উচিত, যা আনন্দপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক। এ ঘরবন্দি সময়ে তাদের বন্ধুদের সাথে কানেকটিভিটির পথ খুলতে পারেন টিচার। পারে স্কুল কলেজ। আশা করি, এটা বলে দিতে হবে না কি ধরনের আনন্দ, সৃজন ও মিলনের যোগসূত্র তৈরী করতে হবে।

সমাজ-শৃঙ্খলা আর পরিবারে শান্তি জরুরী। মানুষ সবসময় প্রকৃতির নিয়মবন্দি। অনাদিকাল থেকে দেখে শেখার যে প্রক্রিয়া, শিশু-কিশোরেরা তার অনুগামী। তাই অভিভাবকদের মনোভাব ও কর্মকা- মনিটরিং জরুরী। মা যদি সারাদিন মোবাইলে থাকেন, পিতার আচরণ যদি সন্দেহজনক হয়- সন্তান কী করবে? তাছাড়া দেশে সারাদিন যেসব ঘটনা ঘটে, যা কিছু মিডিয়ায় খবর হয়ে প্রাধান্য পায়- সেখানে কিভাবে আশা করবো, একদল বাচ্চা বা কিশোর-কিশোরী ব্যতিক্রম হবে?

সময় থেমে নেই। সে কাউকে মাফ করে না। প্রাপ্য যদি তারুণ্য ও কিশোরবেলার সর্বনাশ হয়ে থাকে তবে তা ঠেকানোর এটাই সময়। গেইমের নামে যে অসাধু ব্যবসা, যে নীলনকশা বিশ্বব্যাপী জীবন ও সুন্দরকে বিষিয়ে তুলেছে তার আগ্রাসন থেকে মুক্তির উপায় নৈতিক বাতাবরণ বেছে নেওয়া। মানসিক সুস্থতা আর শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক মনোজগত গঠনের নানা ব্যাপারে এখন থেকেই মনোযোগী হতে হবে আমাদের। আমরা তা পারি। যখন দুনিয়ার অনেক দেশ ধুঁকছিল, আমরা তখন ছিলাম শীর্ষে। আর আজকে অর্থনীতি ও উন্নয়নে এগোলেও সমাজে আমরা অসহায় আর বিপন্ন। আগামী প্রজন্মের গেইম আসক্তি থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজে বের করাই হবে এখন কাজের কাজ।
লেখক : কলামিস্ট

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ভয়ংকর গেইম কালচারে বিপন্ন আগামী প্রজন্ম

আপডেট সময় : ০৯:৫৪:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ জুলাই ২০২১

অজয় দাশগুপ্ত : গেইম কালচারে আক্রান্ত দেশ। সমাজে বাড়ছে মারামারি খুনোখুনি। মাদকের চাইতেও সর্বনাশা এ গেইম। কী সব নাম! কী সব ধারণা! শুনতে পাই বর্তমানে দেশে তরুণ প্রজন্মের মাঝে জনপ্রিয় ফ্রি ফায়ার এবং পাবজি। দক্ষিণ কোরিয়ার গেইম ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ব্লু হোয়েল এর অনলাইন ভার্সন ২০১৭ সালে চালু হয়। এরপর থেকে এ গেইমটি দ্রুত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে চীনের প্রতিষ্ঠানের ২০১৯ সালে তৈরি করা যুদ্ধ গেইম ‘ফ্রি ফায়ার’ একইভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এ গেইম দুইটির জনপ্রিয়তার ফলে তরুণ প্রজন্ম চরমভাবে বিপথগামী হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’ কালচার। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে স্কুল, কলেজ, ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানই অনলাইনভিত্তিক ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছে। আর এ কারণে অভিভাবকরা তার সন্তানদের হাতে ল্যাপটপ, মোবাইল ডিভাইস তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। পাশাপাশি নজর রাখার বিষয়টাও তাদের কাছে কঠিন হয়ে উঠছে। এ সুযোগেই কিশোর-তরুণদের একাংশ জড়িয়ে পড়ছে গেইমভিত্তিক সহিংস কালচারে।

গেইম বিষয়টা কী আসলে? অভিভাবকরা নিশ্চয়ই জানেন তাদের সন্তানেরা কী কী গেইম খেলেন বা কোনটাতে তাদের আসক্তি। কী বললেন- অনেকে জানেন না? না জানার কারণ কী তবে? আপনি এটা খুব ভালো করে বোঝেন দরিদ্র-মুর্খ-অসহায় পরিবারের সন্তানেরা এগুলো জানে না। আর জানলেও তাদের সঙ্গী থাকে ‘বড়লোক’ এর সন্তান। এ কারণে যেসব অভিভাবক জানেন না, বা জানার চেষ্টা করেননি, তারা মূলত তাদের সন্তানদের ব্যাপারে উদাসীন। কারণ? দুটোরও যেকোনও একটি- হয় তাদের হাতে সময় নেই অথবা তারা নিজেরাও ব্যস্ত মোবাইল-ল্যাপটপে। তাদের সময় কেড়ে নিয়েছে ডিজিটাল মিডিয়া। তারা কিভাবে সন্তানদের দেখভাল করবেন!

অভিভাবকেরা না জানলেও পরিস্হিতি কতোটা সাংঘাতিক তার প্রমাণ নিচের খবরটি:

ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো জনপ্রিয় দুই গেইম বন্ধ হচ্ছে বাংলাদেশে। এর আগে পাবজি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হলেও পরে আবার চালু করা হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে এরইমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সুপারিশ করা হয়েছে । বিষয়টি নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও আলোচনা হয়। সেখানে ওই দুইই গেমের আসক্তি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। সম্প্রতি ফ্রি ফায়ার ও পাবজি নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওই দুটি গেইম কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে আসক্তি তৈরি করেছে।

একাধিক মন্ত্রণালয় এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও পরিবারগুলো এখনো জানে না। অন্যদিকে সরকারের সব আদেশ বা পরামর্শ কতোটা কার্যকর বা মানা হবে তা কিন্তু আমরা সবাই জানি। সে কারণে ফিরতে হবে মূলে।

আমাদের শৈশবে এমনকি সেদিনও বাংলাদেশে গেইম বলতে আমরা জানতাম ফুটবল, ক্রিকেট, হাডুডু, মেয়েদের দৌড় এসব। আর এখনকার গেইম হচ্ছে মাঠের বাইরে- ঘরে বা অন্ধকার কোন একটা জায়গায় বসে মোবাইল-ল্যাপটপে চোখের বারোটা বাজিয়ে ঘামতে ঘামতে বোতাম টেপা। এই বোতাম টেপা নিরীহ কিছু না। এর সাথে আছে উন্মাদনা, আছে জোশ। আজকাল গেইমের চেহারা কিভাবে পাল্টেছে তার একটা নমুনা দেওয়া যেতে পারে।

আমাদের সন্তানেরা যখন বড় হচ্ছিল তখন ডিজিটাল গেইম বাজারে এসে গেছে। কিন্তু মোবাইল বা কম্পিউটারে নয়, টিভির বড় পর্দায়। সে পর্দায় গোপনে খেলার সুযোগ ছিল না। দরকার পড়তো অভিভাবকদের সম্মতি। আর অভিভাবকরা নিজেরাই গেইম প্লেয়ার ও গেইম কিনে দিতেন। ফলে তারা জানতে তারা কী দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন। এখন হয়তো সামান্য কয়েকজন অভিভাবক ছাড়া কেউ জানেনই তাদের সন্তানরা কী খেলছে, কেন খেলছে। ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটছে অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে। ‘গেইম জোন’ নামে পরিচিত দোকানগুলো এখানে লাটে উঠেছে আগেই। ইদানিং ঘরে ঘরে গেইমের প্রকোপও কমে গেছে। এর দুটো কারণ :

বাংলাদেশের মতো এতো দীর্ঘমেয়াদী স্কুল কলেজ বন্ধ থাকেনি কোথাও। বিশেষত আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-কানাডা-ইউরোপে করোনাকালে স্কুল তেমন বন্ধ থাকেনি। যতোটা সম্ভব খোলা রাখার কারণ, স্কুল বন্ধ থাকলে বহু মা-বাবা কাজে যেতে পারবেন না। আইনের সমাজে কোন্ বয়সী বাচ্চা একা থাকতে পারবে, আর কারা পারবে না- তার একটা হিসেব আছে। তার ওপর আছে একক পরিবারের ঝামেলা। মা-বাবা দুই জনই কাজ করের বলে আত্মীয়-স্বজনহীন সংসারে কে দেখবে বাচ্চাদের? দূরে কোথাও থাকা কোন আত্মীয় না পারেন আসতে, না সাহায্য করতে। তাই স্কুল খোলা রাখাই দস্তুর। কিংবা চাইল্ড কেয়ার। তাছাড়া বাচ্চাদের মনমেজাজ সময় ভালো রাখতে গৃহবন্দি করে রাখাটা সঠিক নয়।

বাংলাদেশে তা মানা হয়নি। মানার পরিবেশ ছিল কিনা, তারচেয়ে বড় কথা পারা যায় নি। আর না পারার কারণে বেড়েছে গেইম আসক্তি। আসলে তো গেইম না, এ হচ্ছে উন্মাদনা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে চাইল্ড পর্নোগ্রাফির শুরুটাও এখানেই। কিশোর গ্যাং নামে পরিচিত গ্যাং এখন সমাজের আতংক। প্রতিবেদন বলছে- এসব গ্যাং এর করা অপরাধের পেছনে যে কৌশল বা কায়দা তা তারা শিখছে গেইম থেকে। অনেকে জানেন, টিন এজারদের যৌনচাহিদা ও বিকৃতি ভর করেছে নানা গেইমে। এগুলো তাদের কাছে উত্তেজক বটিকার মতো।

সব আমরা জানি ও বুঝি। কিন্তু সমাধান কী? সমাধান বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। তাদের স্কুল-কলেজ খোলাটা যখন ঝুঁকিপূর্ণ, তখন তাদের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়িতে হোমটাস্ক দেওয়া জরুরী। আর তাতে এমন সব বিষয় যোগ করা উচিত, যা আনন্দপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক। এ ঘরবন্দি সময়ে তাদের বন্ধুদের সাথে কানেকটিভিটির পথ খুলতে পারেন টিচার। পারে স্কুল কলেজ। আশা করি, এটা বলে দিতে হবে না কি ধরনের আনন্দ, সৃজন ও মিলনের যোগসূত্র তৈরী করতে হবে।

সমাজ-শৃঙ্খলা আর পরিবারে শান্তি জরুরী। মানুষ সবসময় প্রকৃতির নিয়মবন্দি। অনাদিকাল থেকে দেখে শেখার যে প্রক্রিয়া, শিশু-কিশোরেরা তার অনুগামী। তাই অভিভাবকদের মনোভাব ও কর্মকা- মনিটরিং জরুরী। মা যদি সারাদিন মোবাইলে থাকেন, পিতার আচরণ যদি সন্দেহজনক হয়- সন্তান কী করবে? তাছাড়া দেশে সারাদিন যেসব ঘটনা ঘটে, যা কিছু মিডিয়ায় খবর হয়ে প্রাধান্য পায়- সেখানে কিভাবে আশা করবো, একদল বাচ্চা বা কিশোর-কিশোরী ব্যতিক্রম হবে?

সময় থেমে নেই। সে কাউকে মাফ করে না। প্রাপ্য যদি তারুণ্য ও কিশোরবেলার সর্বনাশ হয়ে থাকে তবে তা ঠেকানোর এটাই সময়। গেইমের নামে যে অসাধু ব্যবসা, যে নীলনকশা বিশ্বব্যাপী জীবন ও সুন্দরকে বিষিয়ে তুলেছে তার আগ্রাসন থেকে মুক্তির উপায় নৈতিক বাতাবরণ বেছে নেওয়া। মানসিক সুস্থতা আর শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক মনোজগত গঠনের নানা ব্যাপারে এখন থেকেই মনোযোগী হতে হবে আমাদের। আমরা তা পারি। যখন দুনিয়ার অনেক দেশ ধুঁকছিল, আমরা তখন ছিলাম শীর্ষে। আর আজকে অর্থনীতি ও উন্নয়নে এগোলেও সমাজে আমরা অসহায় আর বিপন্ন। আগামী প্রজন্মের গেইম আসক্তি থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজে বের করাই হবে এখন কাজের কাজ।
লেখক : কলামিস্ট