লাইফস্টাইল ডেস্ক: প্রত্নতাত্ত্বিক, স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী মুড়াপাড়া জমিদারবাড়ি। ঐতিহাসিক জমিদারবাড়িটি সারা দেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে দারুণ আকর্ষণের নাম। প্রাচীনকালের মানুষের জীবন-জীবিকা, চাল-চলন, আনন্দ-বিনোদন আর শৌখিনতার পরিচয় পাওয়া যায় বাড়িটি দেখলে। সবুজ-শ্যামল গ্রাম মুড়াপাড়ায় জমিদারবাড়িটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক স্থাপনাটি পর্যটকদের কাছে খুবই পছন্দের। ফলে বারো মাসজুড়েই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু ছুটে আসেন। এর পাশাপাশি বিদেশ থেকেও অসংখ্য পর্যটক ও দর্শনার্থী ছুটে আসেন।
ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের পথ। ইট, পাথর আর কোলাহলপূর্ণ রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের কিছতা পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে ঐতিহাসিক এ বাড়ির অবস্থান। পাখি ডাকা ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে গড়ে ওঠা মনোমুগ্ধকর জমিদারবাড়িটির ভবনগুলোর নির্মাণশৈলী ও কারুকাজ রুচিসম্মত পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়।
বলা হয়ে থাকে, প্রাচীনকালে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার জমিদারবাড়িটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জের ইতিহাস, কৃষ্টি, সভ্যতা ও এখানকার জনবসতি। বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন সময় ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়িটি কয়েকজন জমিদার কর্তৃক সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। এর গোড়পত্তন করেন বাবু রামরতন ব্যানার্জি। এরপর তার কয়েকজন বংশধর প্রাসাদটি সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন।
১৮৮৯ সালে প্রায় ৬২ বিঘা জমির ওপর বাবু রামরতন ব্যানার্জী প্রতিষ্ঠিত জমিদারবাড়িটি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বাবু রামরতন ব্যানার্জীর বংশধরেরা মূল ভবনের সামনের ও পেছনের অংশ সম্প্রসারণ, পুকুর খনন ও দালানের উঁচুতলার কাজ করেছেন। ১৭৯ বছর আগে নির্মিত বিশাল দোতলা জমিদারবাড়িটিতে আছে কারুকার্যমণ্ডিত ৯৫টি কক্ষ; যেখানে মন্দির, ভান্ডার, কাছারি ঘর, অতিথিশালা, বৈঠকখানা, আস্তাবল, দৃষ্টিনন্দন নাচের ঘর এবং সামনে-পেছনে দুটি পুকুর আছে।
বিশালাকৃতির প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকতে হয় ভেতরে। অন্দরমহলে আছে আরো দুটি ফটক। সর্বশেষ ফটক পেরিয়ে নারীদের গোসলের জন্য শানবাঁধানো পুকুর। পুকুরের চারধার উঁচু দেওয়ালে ঘেরা। এখানে প্রবেশ বাইরের লোকদের জন্য ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাড়ির সামনে আছে আরো একটি বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারদিক নকশি কাটা ঢালাই লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা, চারদিকে চারটি শানবাঁধানো ঘাট। মূলত পুকুরটি তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধন এবং পুরুষ মেহমানদের গোসলের জন্য। ভবনের সামনের পুকুরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, পানি কম-বেশি হওয়ার ব্যাপারটি ছিল শীতলক্ষ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ এই পুকুর মাটির নিচ দিয়ে নদীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
জমিদারবাড়ির সামনের দিকে নদীর তীরসংলগ্ন রাস্তার পাশে আছে দুটি মন্দির। তা প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। মন্দিরের পাশ ঘেঁষে আছে ছায়াঘেরা শান্ত-শ্যামল আম্রকানন। গাছগুলো বেশ পুরোনো। একই মাপের ঝাঁকড়ানো গাছ। ডালপালা ছড়ানো, অনেকটা ছাতার মতো। অসংখ্য গাছ। প্রায় প্রতিটি আমগাছের গোড়া পাকা করা। এ ছাড়া জমিদারবাড়ির প্রবেশমুখেই আছে সারি সারি ঝাউগাছ।
ভবনের প্রবেশমুখে বিশাল ফটক জমিদারবাড়ির বিশালতার আভাস দেয় আগে থেকেই।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর জমিদার পরিবারের সবাই কলকাতা চলে যান। তখন বাড়িটি কিছুদিনের জন্য পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার এখানে কিশোরী সংশোধন কেন্দ্র ও হাসপাতাল চালু করে। পরে ১৯৬৬ সালের দিকে ভবনটি স্কুল-কলেজের কাজ পরিচালনা করার জন্য ব্যবহার করা হতো। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মুড়াপাড়া জমিদারবাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার তালিকাভুক্ত করে। বর্তমানে মুড়াপাড়া জমিদারবাড়িতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা মুড়াপাড়া সরকারি কলেজ নামে পরিচিত। কালের বিবর্তনে জমিদারবাড়িটি আজ শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পর্যটক ও দর্শনার্থীদের পদচারণায়ও মুখর থাকে।
এখানে ভ্রমণে আসতে পারেন সপ্তাহের যে কোনোদিন। অনিন্দ্য সুন্দর ও প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন মুড়াপাড়া জমিদারবাড়ির ভেতরে যেতে কোনো প্রবেশ ফি দিতে হয় না। দর্শনার্থীদের জন্য সব সময়ই উন্মুক্ত থাকে। তবে কক্ষগুলোকে কলেজের ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করার কারণে সেখানে প্রবেশ অধিকার সংরক্ষিত থাকে। ছুটির দিনে এলে ভালো হয়, তাতে কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণে যেমন ব্যাঘাত ঘটবে না; তেমনই নিজেও পরিপূর্ণভাবে ঘুরে দেখতে পারবেন জমিদারবাড়িটি। সঙ্গে শিশুরা থাকলে তারাও কলেজের বিশাল সবুজ মাঠে খেলাধুলা করতে পারবে মনের আনন্দে।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে চিন্তার কিছু নেই। কাছেই মুড়াপাড়া বাজার। সেখানে হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে। তবে দূরদূরান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুদের রাতযাপনের কোনো আবাসিক হোটেল নেই। এ জন্য দিনে এসে দিনে ফেরার প্ল্যানে আসলেই ভালো হয়। দর্শনার্থীদের ব্যাগসহ বিভিন্ন মালপত্র রাখার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। এগুলো হাতে ও কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হয় দর্শনার্থীদের।
ঢাকা থেকে জমিদারবাড়িতে আসতে যানবাহনভেদে সময় লাগে মাত্র ৩০-৪০ মিনিট। বাস, সিএনজি, প্রাইভেটকারে করে আসতে পারেন এখানে। ঢাকার সায়েদাবাদ, গুলিস্তান অথবা যাত্রাবাড়ী থেকে যে কোনো বাসে রূপসী বাসস্ট্যান্ড অথবা ভুলতা নামতে হবে। তারপর সেখান থেকে সিএনজি অথবা রিকশাযোগে জমিদারবাড়ি। এ ছাড়া ডেমড়া স্টাফ কোয়ার্টার থেকে চুপাড়ার পাশ দিয়ে মাঝিনা গাজী সেতু দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পার হলেই জমিদারবাড়ি। অন্যদিকে রাজধানীর কুড়িল থেকে ভুলতা গাউছিয়া পর্যন্ত চলাচলকারী বিআরটিসি বাসে ভুলতা আসা যাবে। সেখান থেকে সিএনজি বা রিকশাযোগে মুড়াপাড়া জমিদারবাড়ি।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

























