নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ীকে মাথা থেঁতলে হত্যার ঘটনাটি ‘রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে’ ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই বিষয়টি নিয়ে যারা রাজনৈতিক পরিবেশকে নষ্ট করে জাতীয় নির্বাচনকে অনিশ্চিত করতে চান, তাদের চিহ্নিত করে প্রতিহত করা হবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
সোমবার (১৪ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ফখরুল। পাশাপাশি ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যার ঘটনায় একটি তদন্ত ও তথ্যানুসন্ধানী কমিটি বিএনপি গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের অন্তর্নিহিতি কারণ অনুসন্ধানের জন্য আমরা উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি ‘তদন্ত ও তথ্যানুসন্ধানী কমিটি’ গঠনরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যারা প্রকৃত সত্য উদঘাটন করবনে এবং তা প্রকাশ করবেন। এই বিষয় নিয়ে যারা রাজনৈতিক পরিবেশকে নষ্ট করছে এবং জাতীয় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত করতে চান এবং প্রকারান্তে ফ্যাসিবাদ উত্থানের পথ কারা সৃষ্টি করতে চান, তাদেরকে চিহ্নিত করা ও প্রতিহত করার প্রত্যয়ও একইসাথে উচ্চারণ করতে চাই। অপরাধীদের বিষয়ে দলের ‘কঠোর অবস্থান’ পুনর্ব্যক্ত করে মির্জা ফখরুল বলেন, অপরাধীর কোনো দলীয় পরিচয় থাকতে পারে না। ব্যক্তির অপরাধের সাথে দলের কোনো সম্পর্ক নাই।
গত বুধবার (৯ জুলাই) ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে কংক্রিট বোল্ডার দিয়ে শরীর ও মাথা থেতলে হত্যা করা হয় সোহাগকে। এ ঘটনায় তার বড় বোন কোতয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন, যেখানে ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭ জনকে। এছাড়া এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠায় ও গ্রেপ্তারের পর বিএনপির তিন অঙ্গ সংগঠনের পাঁচজনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা হলেন- যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকি; স্বেচ্ছাসেবক দলের কালু ওরফে ‘স্বেচ্ছাসেবক কালু’ এবং ছাত্রদলের চকবাজার শাখার সদস্য সচিব অপু দাস ও মাহমুদুল হাসান মাহিন।
সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের গ্রেপ্তার না করায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব। মির্জা ফখরুল বলেন, একটি বিবেকবান রাজনৈতিক দল হিসেবে লালচাঁদ সোহাগ হত্যাকাণ্ডে বিএনপি তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও দৃষ্টামূলক শাস্তি দাবি করছে। এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা বা উপস্থিতির প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও ঘটনার সাথে জড়িত বলে যাদের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলার আলোকে আজীবন বহিস্কারের মতো সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরূপ দৃঢ দলীয় অবস্থান থাকা সত্ত্বেও একটি চিহ্নিত মহল পরিকল্পতিভাবে আমাদের দল এবং র্শীষ নেতৃত্বের (তারেক রহমান) শালীনতা ও চরিত্রহননের দুঃসাহস প্রর্দশন করছে।
নৃশংস হত্যাকান্ডের নেপথ্য বিষয়: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সার্বিক বিবেচনায় আমাদের বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বরে সাথে অনুধাবন করা প্রয়োজনীয় বলে মনে করছি। কারণ বিষয়গুলো জনমনে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
১। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কোনো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার হচ্ছে কি না এবং এর মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করার জন্য বিশেষ কোনো মহলের প্ররোচণায় এই ধরনের ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সন্দহে করার যথেষ্ঠ অবকাশ রয়েছে।
২। কুমিল্লার মুরাদনগরে সংঘটিত তিনটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড, কুমিল্লার এক মসজিদের ইমামের ওপর নৃশংসভাবে হামলা, খুলনায় যুবদল নেতা মাহবুব মোল্লাকে হত্যা ও রগকাটা, এমন হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে সকলের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সমমানের ছিল কী না সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে।
৩। পরিকল্পিভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
৪। প্রকাশ্য দিবালোকে অসংখ্য মানুষের সামনে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নিকটবর্তী অবস্থান থাকা সত্ত্বেও এই রূপ ঘটনার কোনো প্রতিরোধ না হওয়ায় পুরো ঘটনাটি সর্ম্পকে জনমনে প্রশ্নের উদ্রেকের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
৫। জনসম্মুখে এই রূপ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে ছাড়া বিনা বাধায় ভিডিও ধারণ যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
৬। পুলিশের বক্তব্য থেকে জানা যায় গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের রাজনৈতিক পরিচয় সর্ম্পকে কোনো তথ্য উদঘাটিত হয়নি।
৭। মাত্র গুটিকয়েক সন্ত্রাসী দ্বারা প্রকাশ্যে এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় মাত্র এক বছর আগে সংঘটিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সর্ম্পূণ বিপরীতে পুনরায় আইনের শাসন ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলে বিবেচিত হতেই পারে।
৮। সরকার পরিচালনায় দায়িত্বে না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল ও তার প্রধান নেতৃত্বকে দায়ী করে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন এবং অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আবারও সেই ফ্যাসিবাদের যুগে আমাদরে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।
৯। দেশে সুস্থধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার গণআকাঙ্খার বিপরীতে পরিকল্পিত অপপ্রচার, অশ্লীল স্লোগানের মাধ্যমে আবারো ফ্যাসিস্ট হাসিসা ও আওয়ামী লীগরে কণ্ঠস্বরের প্রতিধব্বনিই শোনা যাচ্ছে।
১০। পূর্বপরিকল্পিতভাবে ৯ জুলাইয়ের ঘটনা ১১ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজের পর, সবচেয়ে প্রাইম টাইমে ইন্টারনেটে ছড়ানো শুরু হয়।
১১। পরিকিল্পতিভাবে নির্দিষ্ট কিছু সোশাল মিডিয়া আইডি ও পেজ থেকে আগে থেকেই তৈরি করে রাখা ফটো কার্ডগুলো অনলাইনে ছড়ানো শুরু হয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অনলাইনে ভুয়া তথ্য প্রচারের ক্যাস্পেইন শুরুর আগে থেকেই অপপ্রচার সামগ্রী তৈরি করে রাখা হয়েছিল।
১২। অপরাধীর জন্য কোনো অনুকম্পার সুযোগ যেমন নেই তেমনি পক্ষ অবলম্বনের প্রশ্নই উঠে না। শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে দলীয় পদ থেকে অপসারণের এমন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপকে স্বাগত না জানিয়ে পরিকল্পিতভাবে চরিত্রহনন দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে প্রশ্নবদ্ধি করে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের আইনি সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার থেকে তাদের বিচ্যুত হবার সুযোগ নেই। নিহত সোহাগের রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং তিনি দেশের একজন নাগরিক, যিনি সন্ত্রাসের নির্মম শিকার। ফলে তার পরিবারের সঙ্গে আমরাও এই অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত র্কাযকর করার বিষয়ে আমাদের দলীয় অবস্থান সুদৃঢ় এবং অপরিবর্তিত।
সরকারের উদাসীনতা: মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ আজ উন্মোচিত। এই অপরাজনীতি প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতার প্রতি আমরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি। আমরা দৃঢভাবে আশা করি- দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির ভয়াবহ পরিণাম সর্ম্পকে দায়িত্বশীল সকল রাজনৈতিক দল সচতেন হবেন। রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত এই জাতীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বাধাগ্রস্ত হলে তার দায় সংশ্লিষ্টদেরই বহন করতে হবে।
গুটিকয়েক ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীর অপচষ্টোয়’ বাংলাদেশ ব্যর্থ হতে পারে না বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, যে তারুণ্য ফ্যাসিবাদের পতনে আমাদের সাথে অগ্রসৈনিক ছিল, আজ দেশের প্রয়োজনে তাদের সাথে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশে ষড়যন্ত্রকারীদের কোনো অপচেষ্টাই আমাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হতে পারবে না।
ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না: সংঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিকল্পিত ফাঁদে পা না দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করার যে কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, আমরা কুণ্ঠিত হই, যখন লক্ষ্য করি বিকৃত রুচির এই বিকারগ্রস্ত গোষ্ঠী তাদের অশ্লীল-কদর্য মানসকিতা কোমলমতি শিশু-কিশোরদের কন্ঠে প্রতধ্বিনতি করিয়ে আমাদের প্রজন্মের মূল্যবোধ ধ্বংস করছে শুধু মাত্র তাদের কুৎসিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে। সবশেষে ফখরুল বলেন বিগত ১৭ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের কষ্টার্জিত সফলতা ব্যর্থ করার সুযোগ নেই।
গুলশানের এই সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, সালাহ উদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন।