ঢাকা ০৭:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

ভেজাল খাদ্য: স্বাস্থ্যহানি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দ্বৈত সংকট

  • আপডেট সময় : ০৭:০১:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
  • ১ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

মো. জসিম উদ্দিন

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে নীরব অথচ ভয়াবহ এক স্বাস্থ্যবিনাশের মহামারি চলছে—তা হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। আমরা প্রতিদিন তিনবেলা পেট ভরে খাচ্ছি, কিন্তু আসলে শরীরে প্রবেশ করছে বিষ। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, দুধ, ফল, মশলা—কোনোটাই নিরাপদ নয়। খাদ্যশস্যের খেত থেকে শুরু করে শহরের হোটেল পর্যন্ত, ভেজালের ছোবল এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে আজ ‘নিরাপদ খাবার’ যেন এক স্বপ্নের নাম। রাষ্ট্র যতই উন্নয়নের গল্প বলুক, পুষ্টিহীন ও বিষাক্ত প্রজন্ম নিয়ে কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারে না।

ভেজালের ভয়ংকর বাস্তবতা: বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বাজারে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খাদ্যপণ্য কোনো না কোনোভাবে ভেজালযুক্ত। তবে কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এ হার তুলনামূলকভাবে কম বা বেশি হতে পারে।

যত ভয়াবহই হোক, খাদ্যে ভেজালের এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব, প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ। আমরা যদি চাই, খুব অল্প সময়েই ‘ভেজাল অর্থনীতি’ থেকে ‘নিরাপদ খাদ্য সংস্কৃতি’তে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের ত্রিমাত্রিক উদ্যোগ- যেখানে আইন, নৈতিকতা ও সচেতনতা একসাথে কাজ করবে।

বাজারের দুধে আছে ফরমালিন, ডিটারজেন্ট ও সোডা; মাছ ও ফলমূল সংরক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল; মাংসে ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে বাড়তি ওজনের জন্য; এমনকি শিশুখাদ্যেও মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রং ও স্টার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে বিক্রি হওয়া মিষ্টান্নের ৯০ শতাংশেই ক্ষতিকর বর্ণ ও সংরক্ষণকারী পদার্থ রয়েছে; যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনি, লিভার, হৃদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এ যেন এক প্রকার বিষ-অর্থনীতি; যেখানে লাভই একমাত্র উদ্দেশ্য, মানবতা সেখানে গৌণ।

অর্থনীতির দৃষ্টিতে ভেজালের বিপর্যয়: একজন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিতে খাদ্যে ভেজাল শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি এক প্রকার ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক ক্ষতি’। বিষাক্ত খাবারের কারণে দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, চিকিৎসা খাতে বাড়ছে ব্যয়, কর্মক্ষমতা কমছে শ্রমজীবী শ্রেণির। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের হিসাবে ভেজালজনিত অসুস্থতায় উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় প্রতি বছর অর্থনীতি প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ে। এ ছাড়া চিকিৎসা খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সঞ্চয় কমে, দারিদ্র্য বাড়ে, এবং সমাজে আর্থিক বৈষম্য আরো গভীর হয়। অর্থাৎ ভেজাল কেবল পেটের রোগ নয়, এটি এখন জাতীয় অর্থনীতির ক্যানসার। এই ক্যানসার যতদিন আমাদের বাজার, নীতি ও ব্যবস্থাপনায় রয়ে যাবে, ততদিন উন্নয়নের গল্প যতই জাঁকজমকপূর্ণ শোনাক না কেন, তা থাকবে অসম্পূর্ণ। কারণ অসুস্থ মানুষ দিয়ে কোনো দেশের অর্থনীতি সুস্থ হতে পারে না।

নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি: ভেজাল আমাদের সামাজিক মূল্যবোধেরও এক ভয়ংকর প্রতিফলন। এক সময় মানুষ ব্যবসাকে ‘সেবা’ ভাবত, এখন সেটি পরিণত হয়েছে ‘প্রতারক প্রতিযোগিতায়’। খাদ্য উৎপাদক থেকে পাইকার, খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবাই জানে- তাদের পণ্য মানুষের ক্ষতি করছে, তবুও তারা থামে না। কারণ তাদের চোখে টাকার অঙ্কটাই বড়; নৈতিকতা, মানবতা বা বিবেক- সবই আজ ব্যবসার বিজ্ঞাপনে হারিয়ে গেছে। এ ভেজাল সংস্কৃতি শুধু বাজারেই নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতিতে মিথ্যার ভেজাল, শিক্ষায় অনিয়মের ভেজাল, পেশায় দায়িত্বহীনতার ভেজাল—সব মিলিয়ে জনগণ যেন এক ‘নৈতিক বিষক্রিয়া’য় আক্রান্ত।

আইনের দুর্বল প্রয়োগ: বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে একাধিক আইন আছে—ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এসব আইন কাগজে শক্তিশালী হলেও প্রয়োগে প্রায় অকার্যকর। বাজারে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়, কয়েকজন বিক্রেতাকে জরিমানা করে—এর পর সব আবার আগের মতোই চলে; যেখানে একটি বিষাক্ত কেমিক্যালের জন্য পুরো জাতি ঝুঁকির মধ্যে, সেখানে কয়েক হাজার টাকার জরিমানা আসলে একধরনের আইনি প্রহসন। ভেজালকারীরা জানে, ধরা পড়লেও বড় ক্ষতি নেই। তাই তাদের মধ্যে ভয় নেই, লজ্জাও নেই।

জনস্বাস্থ্য ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ: জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৩ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে, যার বড় কারণ খাদ্যের গুণগতমানের অবনতি। একই সঙ্গে ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের রোগ ভয়ংকর হারে বাড়ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে ওই ভেজাল প্রজন্মের জিনগত গঠনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অর্থাৎ আজ আমরা যে বিষ খাচ্ছি, তার প্রতিক্রিয়া শুধু আমাদের নয়, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের শরীরেও ছাপ ফেলবে। এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসের প্রক্রিয়া।

সরকারি উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতার গল্প: সরকার বিভিন্ন সময়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে- বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর- সবই আছে। কিন্তু সমস্যা হলো সমন্বয়ের অভাব ও দায়বদ্ধতার ঘাটতি। একটি সংস্থা অভিযান চালালে অন্য সংস্থা নিষ্ক্রিয় থাকে; ফলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেখা যায় না। আরো বড় সমস্যা হলো, দূষণের মূল উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যেমন- কেমিক্যাল আমদানি, মজুত ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভেজাল অনেকটাই রোধ করা যেত। কিন্তু এখানে ব্যবসায়িক প্রভাবশালীরা এত শক্তিশালী যে প্রশাসনও প্রায়শই অসহায়।

সচেতনতার ঘাটতি ও ভোক্তার দায়: আমরা ক্রেতারাও অনেক সময় ভেজালের সহযোগী হয়ে উঠি। সস্তার লোভে রাস্তার খোলা খাবার কিনি, প্যাকেটের লেবেল পড়ি না, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যও ব্যবহার করি। এই অজ্ঞানতা ও উদাসীনতাই ভেজালকারীদের সাহস জোগায়।

যদি ভোক্তারা একসাথে সচেতন হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়- ভেজাল পণ্য বর্জন করে, সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে, ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ দেয়; তাহলে বাজারের চিত্র অনেকটাই বদলানো সম্ভব। কারণ সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক হলো সচেতন জনগণ।

ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ: ইসলামে বলা হয়েছে—“যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” খাদ্যে ভেজাল শুধু অপরাধ নয়, এটি একটি গুনাহের কাজ, যা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে। এই ধর্মীয় সচেতনতা যদি পরিবার ও সমাজে জাগ্রত করা যায়, তাহলে আইনের প্রয়োগ ছাড়াও একধরনের নৈতিক নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি হবে। মসজিদ, মাদরাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা গণমাধ্যমের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ক প্রচারণা চালানো এখন সময়ের দাবি।

সমাধানের পথ ও ভেজালমুক্তির ত্রিমাত্রিক উদ্যোগ: ‎যত ভয়াবহই হোক, খাদ্যে ভেজালের এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব, প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ। আমরা যদি চাই, খুব অল্প সময়েই “ভেজাল অর্থনীতি” থেকে “নিরাপদ খাদ্য সংস্কৃতি”-তে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের ত্রিমাত্রিক উদ্যোগ- যেখানে আইন, নৈতিকতা ও সচেতনতা একসাথে কাজ করবে।

‎প্রথমত, ভেজালকারীদের জন্য কঠোর ও উদাহরণযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই—এই বাস্তবতা বদলাতে হবে। ফরমালিন, কেমিক্যাল বা রং মিশিয়ে খাদ্য বিক্রেতাদের জন্য আজীবন কারাদণ্ড ও সম্পদ বাজেয়াপ্তির বিধান কার্যকর করতে হবে। যাতে অন্যদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়।

‎দ্বিতীয়ত, খাদ্যশিল্পে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিকের আমদানি, সংরক্ষণ ও বিক্রয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই কেমিক্যালগুলোই ভেজালের মূল অস্ত্র। সরকার চাইলে লাইসেন্স, কোটা ও মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে এই প্রবাহ অনেকাংশে বন্ধ করতে পারে।

তৃতীয়ত, প্রতিটি জেলা শহরে আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার স্থাপন এবং দ্রুত ফলাফল প্রদানের ব্যবস্থা জরুরি। এখন অধিকাংশ পরীক্ষার ফলাফল পেতে দেরি হয়, ফলে অপরাধীরা পালিয়ে যায় বা প্রভাব খাটিয়ে মুক্ত হয়ে যায়। দ্রুত ফলাফল নিশ্চিত করা গেলে অপরাধীকে সঙ্গে সঙ্গে বিচারের আওতায় আনা সহজ হবে।

‎চতুর্থত, স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা স্বাস্থ্য দপ্তর ও ভোক্তা অধিকার সংস্থার মধ্যে সমন্বিত মনিটরিং টিম গঠন করা দরকার, যাতে তারা নিয়মিত বাজার তদারকি করতে পারে এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম চালায়।

পঞ্চমত, ভোক্তাদেরও আরো সচেতন হতে হবে। ক্রেতা যদি সঠিকভাবে পণ্য বাছাই করে, মেয়াদ দেখে কেনে, লেবেল পরীক্ষা করে এবং সন্দেহজনক কিছু পেলে অভিযোগ দেয়—তাহলে বাজারে চাপ তৈরি হয়। এই নাগরিক প্রতিরোধই ভেজালের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষেধক।

‎ষষ্ঠত, গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করতে হবে জাতীয় সচেতনতা সৃষ্টিতে। বিদ্যালয় ও কলেজে ‘খাদ্যনিরাপত্তা শিক্ষা’ বা ‘সচেতনতামূলক ক্লাব’ গঠন করা যেতে পারে; যা তরুণদের নৈতিকভাবে দায়িত্ববান করে তুলবে।

সপ্তমত, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি সমাজে আলোচিত হওয়া উচিত। খুতবা, মসজিদ ও মাদরাসায় ‘ভেজাল হারাম’- এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারলে সমাজের নৈতিক প্রতিরোধ শক্তি বহুগুণে বাড়বে। যা আইনের প্রয়োগ ছাড়াও একধরনের নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করবে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশন ও রপ্তানির সাফল্যের গল্প বলছে। কিন্তু এক জাতি যদি নিরাপদ খাবার না পায়, তাহলে সেই উন্নয়ন টেকসই নয়। খাদ্য হলো জীবনের ভিত্তি- যদি সেই ভিত্তিই বিষে পরিণত হয়, তাহলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎও বিষাক্ত হয়ে উঠবে।

‘খাদ্য নয়, বিষ খাচ্ছে জনগণ’- এটি কোনো অলঙ্কার নয়, এক কঠিন বাস্তবতা। এখনই যদি আমরা ভেজালের এই দুষ্টচক্র ভাঙতে না পারি, তাহলে একদিন হাসপাতাল হবে আমাদের নতুন বাজার, ওষুধ হবে নতুন খাদ্য।
এখন সময় এসেছে জেগে ওঠার- মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেবে, জাতি হিসেবে। কারণ ভেজাল বন্ধ করা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়; আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়, মানবতার পরীক্ষাও বটে।
লেখক: কলেজ শিক্ষক
jasim6809786@gmail.com

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

হাদিসের ভিত্তি, চর্চা ও স্তর

ভেজাল খাদ্য: স্বাস্থ্যহানি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দ্বৈত সংকট

আপডেট সময় : ০৭:০১:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

মো. জসিম উদ্দিন

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে নীরব অথচ ভয়াবহ এক স্বাস্থ্যবিনাশের মহামারি চলছে—তা হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। আমরা প্রতিদিন তিনবেলা পেট ভরে খাচ্ছি, কিন্তু আসলে শরীরে প্রবেশ করছে বিষ। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, দুধ, ফল, মশলা—কোনোটাই নিরাপদ নয়। খাদ্যশস্যের খেত থেকে শুরু করে শহরের হোটেল পর্যন্ত, ভেজালের ছোবল এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে আজ ‘নিরাপদ খাবার’ যেন এক স্বপ্নের নাম। রাষ্ট্র যতই উন্নয়নের গল্প বলুক, পুষ্টিহীন ও বিষাক্ত প্রজন্ম নিয়ে কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারে না।

ভেজালের ভয়ংকর বাস্তবতা: বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বাজারে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খাদ্যপণ্য কোনো না কোনোভাবে ভেজালযুক্ত। তবে কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এ হার তুলনামূলকভাবে কম বা বেশি হতে পারে।

যত ভয়াবহই হোক, খাদ্যে ভেজালের এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব, প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ। আমরা যদি চাই, খুব অল্প সময়েই ‘ভেজাল অর্থনীতি’ থেকে ‘নিরাপদ খাদ্য সংস্কৃতি’তে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের ত্রিমাত্রিক উদ্যোগ- যেখানে আইন, নৈতিকতা ও সচেতনতা একসাথে কাজ করবে।

বাজারের দুধে আছে ফরমালিন, ডিটারজেন্ট ও সোডা; মাছ ও ফলমূল সংরক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল; মাংসে ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে বাড়তি ওজনের জন্য; এমনকি শিশুখাদ্যেও মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রং ও স্টার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে বিক্রি হওয়া মিষ্টান্নের ৯০ শতাংশেই ক্ষতিকর বর্ণ ও সংরক্ষণকারী পদার্থ রয়েছে; যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনি, লিভার, হৃদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এ যেন এক প্রকার বিষ-অর্থনীতি; যেখানে লাভই একমাত্র উদ্দেশ্য, মানবতা সেখানে গৌণ।

অর্থনীতির দৃষ্টিতে ভেজালের বিপর্যয়: একজন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিতে খাদ্যে ভেজাল শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি এক প্রকার ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক ক্ষতি’। বিষাক্ত খাবারের কারণে দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, চিকিৎসা খাতে বাড়ছে ব্যয়, কর্মক্ষমতা কমছে শ্রমজীবী শ্রেণির। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের হিসাবে ভেজালজনিত অসুস্থতায় উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় প্রতি বছর অর্থনীতি প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ে। এ ছাড়া চিকিৎসা খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সঞ্চয় কমে, দারিদ্র্য বাড়ে, এবং সমাজে আর্থিক বৈষম্য আরো গভীর হয়। অর্থাৎ ভেজাল কেবল পেটের রোগ নয়, এটি এখন জাতীয় অর্থনীতির ক্যানসার। এই ক্যানসার যতদিন আমাদের বাজার, নীতি ও ব্যবস্থাপনায় রয়ে যাবে, ততদিন উন্নয়নের গল্প যতই জাঁকজমকপূর্ণ শোনাক না কেন, তা থাকবে অসম্পূর্ণ। কারণ অসুস্থ মানুষ দিয়ে কোনো দেশের অর্থনীতি সুস্থ হতে পারে না।

নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি: ভেজাল আমাদের সামাজিক মূল্যবোধেরও এক ভয়ংকর প্রতিফলন। এক সময় মানুষ ব্যবসাকে ‘সেবা’ ভাবত, এখন সেটি পরিণত হয়েছে ‘প্রতারক প্রতিযোগিতায়’। খাদ্য উৎপাদক থেকে পাইকার, খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবাই জানে- তাদের পণ্য মানুষের ক্ষতি করছে, তবুও তারা থামে না। কারণ তাদের চোখে টাকার অঙ্কটাই বড়; নৈতিকতা, মানবতা বা বিবেক- সবই আজ ব্যবসার বিজ্ঞাপনে হারিয়ে গেছে। এ ভেজাল সংস্কৃতি শুধু বাজারেই নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতিতে মিথ্যার ভেজাল, শিক্ষায় অনিয়মের ভেজাল, পেশায় দায়িত্বহীনতার ভেজাল—সব মিলিয়ে জনগণ যেন এক ‘নৈতিক বিষক্রিয়া’য় আক্রান্ত।

আইনের দুর্বল প্রয়োগ: বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে একাধিক আইন আছে—ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এসব আইন কাগজে শক্তিশালী হলেও প্রয়োগে প্রায় অকার্যকর। বাজারে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়, কয়েকজন বিক্রেতাকে জরিমানা করে—এর পর সব আবার আগের মতোই চলে; যেখানে একটি বিষাক্ত কেমিক্যালের জন্য পুরো জাতি ঝুঁকির মধ্যে, সেখানে কয়েক হাজার টাকার জরিমানা আসলে একধরনের আইনি প্রহসন। ভেজালকারীরা জানে, ধরা পড়লেও বড় ক্ষতি নেই। তাই তাদের মধ্যে ভয় নেই, লজ্জাও নেই।

জনস্বাস্থ্য ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ: জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৩ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে, যার বড় কারণ খাদ্যের গুণগতমানের অবনতি। একই সঙ্গে ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের রোগ ভয়ংকর হারে বাড়ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে ওই ভেজাল প্রজন্মের জিনগত গঠনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অর্থাৎ আজ আমরা যে বিষ খাচ্ছি, তার প্রতিক্রিয়া শুধু আমাদের নয়, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের শরীরেও ছাপ ফেলবে। এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসের প্রক্রিয়া।

সরকারি উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতার গল্প: সরকার বিভিন্ন সময়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে- বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর- সবই আছে। কিন্তু সমস্যা হলো সমন্বয়ের অভাব ও দায়বদ্ধতার ঘাটতি। একটি সংস্থা অভিযান চালালে অন্য সংস্থা নিষ্ক্রিয় থাকে; ফলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেখা যায় না। আরো বড় সমস্যা হলো, দূষণের মূল উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যেমন- কেমিক্যাল আমদানি, মজুত ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভেজাল অনেকটাই রোধ করা যেত। কিন্তু এখানে ব্যবসায়িক প্রভাবশালীরা এত শক্তিশালী যে প্রশাসনও প্রায়শই অসহায়।

সচেতনতার ঘাটতি ও ভোক্তার দায়: আমরা ক্রেতারাও অনেক সময় ভেজালের সহযোগী হয়ে উঠি। সস্তার লোভে রাস্তার খোলা খাবার কিনি, প্যাকেটের লেবেল পড়ি না, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যও ব্যবহার করি। এই অজ্ঞানতা ও উদাসীনতাই ভেজালকারীদের সাহস জোগায়।

যদি ভোক্তারা একসাথে সচেতন হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়- ভেজাল পণ্য বর্জন করে, সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে, ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ দেয়; তাহলে বাজারের চিত্র অনেকটাই বদলানো সম্ভব। কারণ সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক হলো সচেতন জনগণ।

ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ: ইসলামে বলা হয়েছে—“যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” খাদ্যে ভেজাল শুধু অপরাধ নয়, এটি একটি গুনাহের কাজ, যা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে। এই ধর্মীয় সচেতনতা যদি পরিবার ও সমাজে জাগ্রত করা যায়, তাহলে আইনের প্রয়োগ ছাড়াও একধরনের নৈতিক নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি হবে। মসজিদ, মাদরাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা গণমাধ্যমের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ক প্রচারণা চালানো এখন সময়ের দাবি।

সমাধানের পথ ও ভেজালমুক্তির ত্রিমাত্রিক উদ্যোগ: ‎যত ভয়াবহই হোক, খাদ্যে ভেজালের এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব, প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ। আমরা যদি চাই, খুব অল্প সময়েই “ভেজাল অর্থনীতি” থেকে “নিরাপদ খাদ্য সংস্কৃতি”-তে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের ত্রিমাত্রিক উদ্যোগ- যেখানে আইন, নৈতিকতা ও সচেতনতা একসাথে কাজ করবে।

‎প্রথমত, ভেজালকারীদের জন্য কঠোর ও উদাহরণযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই—এই বাস্তবতা বদলাতে হবে। ফরমালিন, কেমিক্যাল বা রং মিশিয়ে খাদ্য বিক্রেতাদের জন্য আজীবন কারাদণ্ড ও সম্পদ বাজেয়াপ্তির বিধান কার্যকর করতে হবে। যাতে অন্যদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়।

‎দ্বিতীয়ত, খাদ্যশিল্পে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিকের আমদানি, সংরক্ষণ ও বিক্রয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই কেমিক্যালগুলোই ভেজালের মূল অস্ত্র। সরকার চাইলে লাইসেন্স, কোটা ও মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে এই প্রবাহ অনেকাংশে বন্ধ করতে পারে।

তৃতীয়ত, প্রতিটি জেলা শহরে আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার স্থাপন এবং দ্রুত ফলাফল প্রদানের ব্যবস্থা জরুরি। এখন অধিকাংশ পরীক্ষার ফলাফল পেতে দেরি হয়, ফলে অপরাধীরা পালিয়ে যায় বা প্রভাব খাটিয়ে মুক্ত হয়ে যায়। দ্রুত ফলাফল নিশ্চিত করা গেলে অপরাধীকে সঙ্গে সঙ্গে বিচারের আওতায় আনা সহজ হবে।

‎চতুর্থত, স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা স্বাস্থ্য দপ্তর ও ভোক্তা অধিকার সংস্থার মধ্যে সমন্বিত মনিটরিং টিম গঠন করা দরকার, যাতে তারা নিয়মিত বাজার তদারকি করতে পারে এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম চালায়।

পঞ্চমত, ভোক্তাদেরও আরো সচেতন হতে হবে। ক্রেতা যদি সঠিকভাবে পণ্য বাছাই করে, মেয়াদ দেখে কেনে, লেবেল পরীক্ষা করে এবং সন্দেহজনক কিছু পেলে অভিযোগ দেয়—তাহলে বাজারে চাপ তৈরি হয়। এই নাগরিক প্রতিরোধই ভেজালের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষেধক।

‎ষষ্ঠত, গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করতে হবে জাতীয় সচেতনতা সৃষ্টিতে। বিদ্যালয় ও কলেজে ‘খাদ্যনিরাপত্তা শিক্ষা’ বা ‘সচেতনতামূলক ক্লাব’ গঠন করা যেতে পারে; যা তরুণদের নৈতিকভাবে দায়িত্ববান করে তুলবে।

সপ্তমত, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি সমাজে আলোচিত হওয়া উচিত। খুতবা, মসজিদ ও মাদরাসায় ‘ভেজাল হারাম’- এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারলে সমাজের নৈতিক প্রতিরোধ শক্তি বহুগুণে বাড়বে। যা আইনের প্রয়োগ ছাড়াও একধরনের নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করবে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশন ও রপ্তানির সাফল্যের গল্প বলছে। কিন্তু এক জাতি যদি নিরাপদ খাবার না পায়, তাহলে সেই উন্নয়ন টেকসই নয়। খাদ্য হলো জীবনের ভিত্তি- যদি সেই ভিত্তিই বিষে পরিণত হয়, তাহলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎও বিষাক্ত হয়ে উঠবে।

‘খাদ্য নয়, বিষ খাচ্ছে জনগণ’- এটি কোনো অলঙ্কার নয়, এক কঠিন বাস্তবতা। এখনই যদি আমরা ভেজালের এই দুষ্টচক্র ভাঙতে না পারি, তাহলে একদিন হাসপাতাল হবে আমাদের নতুন বাজার, ওষুধ হবে নতুন খাদ্য।
এখন সময় এসেছে জেগে ওঠার- মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেবে, জাতি হিসেবে। কারণ ভেজাল বন্ধ করা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়; আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়, মানবতার পরীক্ষাও বটে।
লেখক: কলেজ শিক্ষক
jasim6809786@gmail.com

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ